অপলক দৃষ্টিতে ছেলেটা তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। যদিও তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছুই তার দৃষ্টিতে পরছে না। কখনো মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে সূর্যকে, আবার মেঘকে ফাঁকি দিয়ে মিষ্টি হাসছে সূর্যটা। সেই হাসি ছড়িয়ে পরছে সাড়া পৃথিবীময়। সূর্য আর মেঘের এই লুকোচুরি খেলা মোটেও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না ছেলেটার।
ময়লা হাফ প্যান্ট আর আধছেড়া গেঞ্জি পরে নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে বারান্দায় দাড়িয়ে। সেই নির্বাক চোখ বেয়ে বেয়ে পরছে শত ঝর্ণার জল। কতক্ষন ধরে স্কুলের বারান্দায় দাড়িয়ে আছে বাবু নিজেও জানে না।
হ্যাঁ ওর নাম বাবু। ক্লাস থ্রিতে পরা এই ছোট্ট ছেলেটার কি এমন বয়স হয়েছে? কিন্তু এই বয়েসেই সে দেখে চলছে বাস্তবতার নির্মম রূপ। আজো তাকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
তোর স্কুলের জামা নাই খাতা কলম নাই। তরে না বলসি আর স্কুলে আসবি না? ঠিক মত খেতে পাসনা পরালেখা করে কি করবি? এসব বলে সার ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছে।
তাই নিস্পাপ ছেলেটি স্কুলের বারান্দায় দাড়িয়ে কষ্টকে অশ্রুতে পরিণত করছে। কিন্তু ওর যে ভীষণ পড়তে ইচ্ছে করে। সবার সাথে স্কুলে যেতে ইছে করে। গরিব বলে সে কি পরালেখা করতে পারবে না? কিছুক্ষণ চুপচাপ সবুজ মাঠের দিকে তাকিয়ে থেকে গায়ের আঁকাবাঁকা পথে ফিরে চলে বাড়ির দিকে।
যে বয়েসের ছেলে মনের আনন্দে ছুটে বেড়ানোর কথা মাঠে ঘাটে, মুক্ত আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর কথা কিন্তু নির্মম বাস্তবতার আঘাতে সেই ছেলে হেটে চলে ধীর গতিতে।
বাবুর মা বাড়িতে এসে দেখে তার ছেলে চুপচাপ বসে আছে কুঁড়ে ঘরের বারান্দায়
-কি বাজান এইখানে বইসা আছ ক্যান?
-বাবু চুপ
-মন খারাপ আমার রাজপুত্তের? কেডায় বকসে তোমারে?
-মাষ্টারে আইজ কেলাস থেইকা বাইর কইরা দিসে। কয় আমার কাপড় নাই, খাতা কলম নাই। আমার পড়ন লাগব না।
-থাউক বাজান মন খারাপ কইর না। দেখ তোমার লইগা নাড়ু মুরি লইয়া আইসি
-না খামু না
-খাইবা না ক্যান?
-খামুনা আমি স্কুলে যামু
-আইচ্ছা যাইওনে
-আমারে খাতা কলম আইনা দিবা
-আইচ্ছা দিমুনে
-তুমি আগেও কইস আইন্না দিমু। দেউ নাই
-এইবার সত্যই আইন্না দিমু। লউ এহন খায়া লউ দেখি
বাবুর বাবা যখন মারা যায় বাবু তখন আরও ছোট ছিল। কোনোমত কথা বলতে শিখেছে।
অসুখে মারা যায় বাবুর বাবা। টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসা করাতে পারেনি। ভালো কোন ডাক্তার দেখাতে পারেনি।
হাঁটে দিন মজুরের কাজ করত বাবুর বাবা। খেয়ে পরে ভালই কাটছিল তাদের দিন।
কিন্তু বাবা মারা যাবার পর থেকে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে তাদের। বাবুর মা এখানে সেখানে কাজ করে বলে কোনরকম খেয়ে পরে বেঁচে আছে তারা।
বাবুকে মা কিছুতেই বোঝাতে পারে না যে তার বাবা মারা গেছে। আর কোনদিনই ফিরে আসবে না। রাতে ঘুমাতে গিয়ে বাবুর প্রশ্ন
-মা! আমরা মেলা গরিব ক্যান?
-বাজানরে আল্লায় গরিব বানাইসে। আমরা কি করমু কউ
-বাবায় থাকলে আমগো এতো কষ্ট হইত না। না মা?
-হ
-আইচ্ছা মা! বাবায় কি আর আইব না?
-নারে বাজান আর আইব না
-ক্যান? রফিক্কার বাবায় তো ঠিকই আহে গঞ্জের থেইকা
-তুমার আব্বায় তো আকাশে চইলা গেসে তাই আর আইব না
-মা আকাশ কি মেলা দূর??
-হ মেলা দূর
-তাইলে চান যে দেখা যায়?
-বুকা পোলায় কয় কি? চান তো দেখা যাইবোই। চান আকাশে থাকে যে!
-তাইলে বাবারে দেখা যায় না ক্যান?
-কে কইসে দেখা যায় না? যায় তো
-কই আমি তো দেখি না
-আকাশে যে বড় তারাটা দেখা যায়। ওইটা তোমার বাবায়
-মা তোমার মেলা কষ্ট করতে অয় না??
-হরে বাজান, কষ্টতো হইবই। কষ্ট না করলে কি আর খাওন পামু
-দেইখো মা আমি পরালেখা কইরা মেলা বড় হমু
তোমার আর কুনু কষ্ট থাকব না তহন
-হ বাজান তুমি মেলা বড় হইবা। তাইলেই আমার কুনু কষ্ট থাকব না
মেলা কথা কইস অহন ঘুমাউ চুপ কইরা
বাবুর বাবা অসুখের সময় অনেক টাকা খরচ হয়। এখন বিপদের সম্বল বলতে শুধুই একটা স্বর্ণের আংটি আছে, বাবুর মায়ের কাছে। সে ঠিক করে কাল আংটি বিক্রি করেই ছেলেকে স্কুল ড্রেস খাতা কলম কিনে দিবে। যত কষ্টই হোক ছেলেকে পড়ালেখা শেখাবে।
ছেলেই যে তার সবচেয়ে বড় সম্বল। পড়ালেখা করে বাবু অনেক বড় হবে, মানুষের মত মানুষ হবে, এই স্বপ্ন নিয়েই বাবুর মা ঘুমিয়ে পরে একটি সোনালী দিনের আশায়. . .
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:০৩