somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রধান প্রধান সমস্যা ও সমাধানের উপায় - ৫

২২ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পর্ব - ৪ এর পর থেকে

প্রশাসনকে ই-গভার্মেন্টে রূপান্তরিত করা
আমাদের দেশের অন্যান্য সেকটরের মতো শিক্ষা ক্ষেত্রেও দুর্নীতি মহীরুহে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে শিক্ষা বাজেটের একটা বিরাট অংশ দুর্নীতিবাজদের পকেটে চালান হয়ে যাচ্ছে। তাই সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি ঠেকানোর জন্য সর্বপ্রথমে শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে দেশের সব সরকারী কলেজগুলোকে ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে। তাছাড়া সব সরকারী শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট, আলিয়া মাদ্রাসা, শিক্ষা বোর্ড, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকেও এ সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তথ্য আদান-প্রদান করা হবে ই-মেইল ও ওয়েব সাইটের মাধ্যমে। আর ইন্টারনেটের মাসিক বিল প্রদান করতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারী তহবিল থেকে।

শিক্ষা প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো
শিক্ষক-অভিভাবক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য গতানুগতিক অনমনীয় প্রশাসন থেকে বেরিয়ে এসে নমনীয় বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় ফিরে আসা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন অথবা সাপ্তাহিক কর্মসূচীতে অভিভাবকদের সাথে মত বিনিময়ের জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখা যেতে পারে । বর্তমান ব্যবস্থাপনায় অভিভাবকরা প্রয়োজনে প্রধান শিক্ষকের সাথে আলোচনা করতে পারেন, কিন্তু একজন প্রধান শিক্ষক বা সহকারী প্রধান শিক্ষকের পক্ষে সকল অভিভাবকের সাথে আলোচনা করা অনেকটাই অসম্ভব । তাছাড়া প্রশাসনিক বিষয় ছাড়া একাডেমিক বিষয়ে অভিভাবকদের সাথে আলোচনা খুব কমই হয়ে থাকে । বিদ্যালয় কর্মসূচিতে সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও যে বিষয়টি বিবেচ্য তা হলো অভিভাবকদের পেশাগত দিক । কারণ অনেক পরিবারেই অভিভাবক সদস্যই কোন পেশায় জড়িত থাকতে পারেন।

যথাযথ শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করা
দেশে এমন একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা যাতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের তুলনায় কোন অংশে কম না হয়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষানীতি এখনো সেই সনাতনধর্মী কেরানী তৈরীর শিক্ষা ব্যবস্থা রয়ে গেছে। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে, শিক্ষা ব্যবস্থায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষানীতিটাকে ঢেলে সাজিয়ে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন করা সম্ভব করা যাবে। শত বাধা বিপত্তির মাঝেও দেশের আপামর জনগনের কল্যানে ও দেশের মানুষের ভাগ্য নির্মানের জন্য যথাযথ একটি শিক্ষানীতি থাকা প্রয়োজন।

শিক্ষা প্রশাসনকে দূর্ণীতিমুক্ত করা
বাংলাদেশে পুলিশ প্রশাসনের পর শিক্ষা প্রশাসনের দূর্ণীতি। এখানের দূর্ণীতির কারণে এর শিকার হয় প্রথমেই শিক্ষক সমাজ, অত:পর শিক্ষার্থীরা। একে একে জাতির প্রত্যেকটি মানুষ দূর্ণীতির শিকারের আওতায় পড়ে। বিশেষ করে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এর দূর্ণীতির শিকার। এদের নিজেদের এমপিও ভুক্ত করার জন্য প্রথমে বিদ্যালয়ের প্রধনিশিক্ষক ও সভাপতি। অত:পর উপজেলা শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিসার সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হয়, যদিও এ কাজটির জন্য সেই কর্মকর্তা চাকুরী করে থাকে। শিক্ষা বোর্ডগুলিও দূর্ণীতির আখড়া। সেখানে বিদ্যালয়ের কোন একটি বিষয় অনুমোদন, রেজিষ্ট্রেশন করা, ফর্মফিলাপ করা, কমিটি অনুমোদন ইত্যাদি কাজের জন্য যেতে হয়। কিন্তু কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে টাকা না দিয়ে কোন কাজ করা যায় না। শিক্ষার এসকল প্রশাসনকেদূর্ণীতি মুক্ত করা উচিৎ।

শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করা
কোন জাতির শিক্ষার বাহক হলো শিক্ষক। শিক্ষকদের যদি সঠিকভাবে গঠন করা যায় তাহলে জাতির শিক্ষার বিস্তার হবে পৃথিবীর অন্যান্য জাতির শিক্ষার বিস্তারের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে। বাংলাদেশের শিক্ষকদের পৃথিবীর অন্যান্য সকল দেশের চেয়ে সর্ব নিম্ন বেতন দেয়া হয় এবং ভাল কোন প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তার দক্ষতা উন্নয়নের কোন রকম চিন্তা করা হয়না। সরকারকে দেশের শিক্ষক সমাজের উন্নততর প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করে তাদের দক্ষতা অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষাকে আরো দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ অতি জরুরী।

শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তৃতীয় বিশ্বের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যতগুলো সমস্যা থাকার কথা তার সবগুলোই এখানে আছে। তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ যত বেশি তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের পকেট ভারী করার সুযোগও তত বেশি। এই প্রজেক্ট, সেই প্রজেক্ট-প্রজেক্টের কোন অভাব নেই। যত্রতত্র এনজিও’রও অভাব নেই। বিদেশি ডোনারদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতানোই এদের কাজ। যখন রাষ্ট্র তার অবশ্য পালনীয় কর্তব্যে ব্যর্থ হয় তখন বিদেশি দাতা গোষ্ঠীর মাধ্যমে ধনী রাষ্ট্রগুলো কিছু ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে শিক্ষা উন্নয়ন নিয়ে বহু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। একটি প্রকল্প শেষ হয়েছে তার দ্বিতীয় ফেজ শুরু হয়েছে। দেশি বুদ্ধিজীবিরা বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়েছে মোটা অংকের টাকা আর সাদা চামড়া ও চকচকে কালো চামড়ার বিদেশি বিশেষজ্ঞরা নিয়েছে মোটা অংকের ডলার। কিছু গ্রামীণ বিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে, পাঠ্যক্রমে বিদেশি পাঠ্যপুস্তকের জটিল অনুবাদ কপি-পেস্ট করা হয়েছে। এতে পাঠ্যক্রমের ধারাবাহিকতায় অসামঞ্জস্যতা প্রকট হয়েছে। আর যেটা হয়েছে সেটা হল বছরে বছরে শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন। প্রচুর শিক্ষার্থী হয়েছে গিনিপিগ। শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক গুণগত পরিবর্তন খুব সামান্যই হয়েছে। এর পেছনের কারণ খতিয়ে দেখলে দেখা যায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শেষে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি গ্রহণ, বিদেশ গমন, শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ না করা আমলা কর্তৃক শিক্ষাক্রম প্রস্তুতকরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণকে গণহারে শিক্ষাবিদ উপাধি দিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে কাজ করানো। শিক্ষাবিজ্ঞান এখন এত বড় একটি ক্ষেত্র যে এটি নিয়ে দীর্ঘ সময়ে কাজ না করলে এবং তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক পর্যায়ে যথাক্রমে পড়াশোনা ও কাজ না করলে কোন স্থায়ী, গ্রহণযোগ্য ও মানসম্মত শিক্ষা পদ্ধতি উপহার দেওয়া সম্ভব নয়। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল, প্রচলিত শিক্ষাক্রমেই অনেক উন্নতমানের শিক্ষা নিশ্চিত করা যেত যদি মেধাবী ও উন্নত মানসিকতার তরুণরা গণহারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিত। আইন যেমনই হোক না কেন যোগ্য ও সৎ বিচারপতি ঠিকই ন্যায়বিচার উপহার দিতে পারেন। ঠিক তেমনি শুধুমাত্র সমাজের উচ্চ মেধাস্তরের ছেলেমেয়েদের স্কুল পর্যায়ের শিক্ষকতা পেশায় সম্পৃক্ত করা গেলেই বর্তমান শিক্ষা সমস্যার সিংহভাগ সমাধান হয়ে যেত।

শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা
মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে স্বশাসন বা স্বনিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত । শিক্ষাক্ষেত্রেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানুষ জন্মগ্রহণ করে স্বাধীনতা ভোগ করার নিমিত্তে। শিশুকে খাওয়ানোর সময় সে হাত দিয়ে চামচ ধরতে চায় এবং নিজে খেতে চায়, হাঁটার জন্য নিজে পা বাড়ায়, বড় হলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য কাজ খোঁজে। এগুলো সবই স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রচেষ্টাসমূহ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই জন্মগত স্বাধীনতার প্রবৃত্তি শিশু স্কুলে অনুসরণ করতে পারে না। শিশু শিক্ষার্থীরা সব সময়ই খুব বেশি উত্তেজিত থাকে এবং বিমোহিত হয় নতুন কিছু জানার জন্য এবং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। কিন্তু তাদের নিয়মানুবর্তী করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তাদের সৃষ্টিশীল প্রতিভা বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাড়ায় স্কুলের শাসন এবং শিক্ষার্থী বঞ্চিত হয় তার স্বাধীনতা থেকে। এই স্বাধীনতা হরণ চলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত। অথচ এই সময় একজন শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠার প্রকৃত সময়।
প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা জ্ঞান অর্জন করি বা করার বৃত্তের মধ্যে অবস্থান করি। ’ক্রিটিক্যাল পেডাগজি’ বলছে যে, শিক্ষক শিক্ষার্থীর কাছেও শেখে,শুধু শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে শিখে না। ধরুন, উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তার ছেলে বা মেয়ে তার পরিবার এবং তার চারপাশ থেকে অনেক বিষয় শিখে যেগুলো একজন শিক্ষকের জানা নাও থাকতে পারে। আমার এক সহকর্মী বলেছিলেন, (উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার মেয়েরা যখন কলেজে পড়ছে) ওদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। দেখলাম ব্যাপারটি আসলেই সত্য। অতএব, পেডাগজি শুধু শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হবে না, হবে শিক্ষাকেন্দ্রিক। শিখন পরিবেশ সৃষ্টিশীল হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মত ও ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যমে। এভাবে বলা যায়, কেহই পূর্ণ শিক্ষিত নয়। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী পূর্ব অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাস অনুযায়ী শিখতে পারে এবং জীবনের বাস্তবতার জন্য নতুন পথের সন্ধান পেতে পারে।
সরকারকে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে
একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষার অবদান অপরিসীম। একটি দেশের শিক্ষাখাতে সরকারের ব্যয় মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) শতকরা কত ভাগ তার উপর সেদেশের কর্মপরিকল্পনায় শিক্ষাকে কতটুকু অগ্রাধিকার প্রদান করা হচ্ছে সেটার নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। শিক্ষা খাতে সরকারী ব্যয়- যেমন বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান যেগুলো শিক্ষা সেবার সাথে সম্পৃক্ত সেগুলোর জন্য সরকারের ব্যয়িত অর্থের দ্বারা নির্ধারিত হয়। এ ব্যয় শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ের সাথে সম্পৃক্ত নয়, শিক্ষার্থীদের ও তাদের পরিবারগুলোর অন্যান্য পরিসেবা যেগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়ে থাকে, তার সাথেও জড়িত।
জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ অপরিহার্য। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের সুফল আসে ধীরে ধীরে। আর তাই সেটা অনেক সময় তাৎক্ষনিকভাবে আমাদের চোখে পড়ে না। এ কারণেই হয়তো আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ক্রমাগত কমছে। অথচ অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। অর্থনীতিবিদ আর্থার শুলজ্ দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করা সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ। শিক্ষার অর্থনীতি (Economics of Education) নিয়ে গবেষণা করে মৌলিক অবদান রাখার জন্য রবার্ট সলো এবং আর্থার শুলজ্ অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত লাভ করেন।
একটি দেশের মানব সম্পদ উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে জাতীয় উন্নয়নের জন্য জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। তাই রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিক্ষা ফোরাম ২০০৬ বিশ্বের সব দেশগুলোকে তাদের জিডিপি-র কমপক্ষে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয়ের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, শুধু প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ নয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় বিনিয়োগ উদীয়মান অর্থনীতির জন্য অধিক ফলপ্রদ। কারণ দক্ষ ও জ্ঞান-ভিত্তিক জনবল তৈরীর জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা প্রধান নিয়ামক। ফোরামের মতে, জ্ঞান ও সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে স্থানান্তরের মাধ্যম হিসেবে শিক্ষা ব্যবহৃত হওয়া উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমরা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছি।
উত্তরণের উপায়ে কিছু সুপারিশ
শিক্ষা ব্যবস্থায় সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন-
১. শিক্ষকতা পেশায় মেধা সম্পন্নদের সুযোগ করে দেয়ার জন্য নিয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
২. প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক পাসের বাধ্যবাধকতা তুলে দিতে হবে। কেননা এম.পি.ও. চালু রাখার জন্য শিক্ষকরাই নকলে সহায়তা করেন।
৩. শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীরা যেন বেয়াদবী না করে, আনুগত্য বজায় রেখে চলা-ফেরা করে সে জন্য টিউটোরিয়াল, টার্মিনাল ও মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নিতে হবে।
৫. প্রশ্ন প্রণয়নের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া যাবেনা। বিশেষ করে সমিতির প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া বন্ধ করতে হবে।
৬. এমন আইন প্রণয়ন করতে হবে, যেন কোন অবস্থাতেই শিক্ষকরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াতে কিংবা কোচিং করাতে না পারে।
৭. শিক্ষকদের কাজে উৎসাহী ও মনোযোগী করে তোলার লক্ষ্যে ন্যায়নিষ্ঠ-নীতিবান শিক্ষকদের মূল্যায়ন করে পুরস্কৃত করতে হবে এবং গোপন রিপোর্টের ভিত্তিতে যোগ্য, সৎ ও দক্ষ শিক্ষকদের কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রমোশন দিতে হবে।
৮. অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে বদলির ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. শিক্ষা ভবনের ঘুষ বাণিজ্য দূর করতে হবে, যেন শিক্ষকরা তাদের টাইমস্কেলের কাজসহ অন্যান্য কাজ নির্বিঘ্নে এবং বিনা পয়সায় করতে পারেন।
১০. কলেজ এবং মাদ্রাসার শিক্ষকদের (প্রভাষক) বেতনের অনুপাতের প্রচলিত ঘৃণ্য নিয়ম বাতিল করতে হবে।
১১. মানবিক মূল্যবোধ তৈরী করে এমন শিক্ষা (নৈতিকতা সম্বলিত) সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
১২.প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার (১ম সাময়িক, ২য় সাময়িক ও বার্ষিক) খাতা মূল্যায়নের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। প্রয়োজনে এক প্রতিষ্ঠানের খাতা অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককে দিয়ে মূল্যায়ন করাতে হবে।
১৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুকুল পরিবেশ গড়ে তুলতে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রাখতে হবে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এ ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দলের একমতে পৌঁছানো উচিত।
১৪. সেশন জট দূর করে সময়ের পরীক্ষা সময়ে নিতে হবে।
১৫. শিক্ষার্থীর আর্থিক সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে বৃত্তির সংখ্যা এবং টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।
১৬. রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রসাশনের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সন্তানের স্কলারশীপ ও উচ্চতর ডিগ্রী ব্যতীত পড়া-লেখার জন্য বিদেশে পাঠানো নিষিদ্ধ করতে হবে।
১৭. লেজুর ভিত্তিক রাজনীতিতে জড়ানো থেকে ছাত্রদের রক্ষা করতে হবে।
১৮. কঠোর আইন করে শিক্ষক রাজনীতি ্বন্ধ করতে হবে।
১৯.শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রসাশনিক ও আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।
২০. প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে রাজনৈতিক ব্যক্তির পরিবর্তে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে।

উপসংহার
সাধারণত আচরণের ধনাত্বক পরিবর্তনকে শিক্ষা বলা হয়। একজন মানুষকে ভালভাবে বাঁচতে হলে প্রথমে যে কয়টি মৌলিক বিষয় দরকার তার একটি হল শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের অন্তর্নিহিত গুনাবলীর প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে।
শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পারেনা। অতি প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের দেশে শিক্ষার প্রচলন ছিল। সেই সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষার কাঠামো সবই ছিল বেশ সহজ ও সরল। কিস্তু দিন বদলের সাথে সাথে তা হয়ে উঠেছে জটিল থেকে জটিলতর। এর সাথে যুক্ত হয়েছে নানান মুখি শিক্ষা ব্যবস্থা। দিন যত যাচ্ছে ততই আবিষ্কার হচ্ছে ভিন্ন ধরনের শিক্ষা কাঠামো, শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষণ পদ্ধতি, প্রশাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি। আর এর সব কিছু মিলে গঠিত হয় একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা।

আমাদের শিক্ষার্থীরা বর্তমানে কিছু জানার চেয়ে ভালো রেজাল্টের দিকেই বেশি আগ্রহী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নত প্রযুক্তি-ইণ্টারনেট থাকলেও এগুলোর যথাযথ ব্যবহার না করে শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুক ব্যবহার করছে। কিন্তু এই তথাকথিত ভালো রেজাল্ট তাদের কি কোন সাহায্য করছে? এইসব মেধাবীরা অনেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। পরবর্তীতে তথাকথিত ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা স্মার্ট মানুষ তৈরির কারখানা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে স্মার্টনেসের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই নামসর্বস্ব। একটি উদাহরণ দিচ্ছি-বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়(World University)। বিশ্ব নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয় অথচ সেখানে বিশ্বের অন্য কোন দেশের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আছে কিনা সন্দেহ! অর্থাৎ নামের সাথে কাজের কোন মিলই নেই। যার নামেরই ঠিক নেই, তার কাছ থেকে নিশ্চয়ই ভাল কাজ আশা করা বলাই বাহুল্য। বর্তমান সরকার শিক্ষার উন্নয়নের জন্য সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করেছে। কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কেউ এটি ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারেনি।শিক্ষকগণ এখনো বুঝেই উঠতে পারেননি প্রশ্নপদ্ধতি কি রকম হওয়া উচিত। যে দেশের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান বলেন, এটি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সে দেশের শিক্ষা কীভাবে উন্নত হবে? এটি কথার কথা নয়, একটি বাস্তব উদাহরণ। শিক্ষকদের বেশিরভাগেরই শিক্ষক নিবন্ধন সার্টিফিকেট নেই। অনেকের শিক্ষকতার জন্য প্রয়োজনীয় ডিগ্রি বি.এড-ও নেই।

এতকিছু সত্ত্বেও আশা করছি, শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব বুঝে শিক্ষকসুলভ মানসিকতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করবেন। আমরা আমাদের স্বপ্নের দেশ পাবো।


সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৪:৪৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেট্রোরেল পেয়েছি অথচ হলি আর্টিজানে নিহত জাপানিজদের ভুলে গেছি

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৫ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:১১

জাপানে লেখাপড়া করেছেন এমন একজনের কাছে গল্পটা শোনা৷ তিনি জাপানে মাস্টার্স করেছিলেন৷ এ কারণে তার অনেক জাপানিজ বন্ধু-বান্ধব জুটে যায়৷ জাপান থেকে চলে আসার পরেও জাপানি বন্ধুদের সাথে তার যোগাযোগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুদ্ধে নিহত মনোজ দা’র বাবা

লিখেছেন প্রামানিক, ২৫ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৭১ সালের এপ্রিলের ছব্বিশ তারিখ। দেশে তখন ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। উচ্চ শিক্ষিত এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের নিয়েই বেশি সমস্যা। তাদেরকে খুঁজে খুঁজে ধরে নিয়ে হত্যা করছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিয়ে থেতে ভাল্লাগে।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৫ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৯

আমার বিয়ে বাড়ির খাবার খেতে ভালো লাগে। আমাকে কেউ বিয়ের দাওয়াত দিলে আমার খুসি লাগে। বিয়ের দিন আমি সেজে গুজে বিয়ে বাড়িতে আয়োজন করা খাবার থেতে যাই। আমাদের এলাকায় বর্তমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুর সামনের পাতার ৯টি পোষ্টে শুন্য (০ ) মন্তব্য।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৫ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০



আজকে সকালে একটু দেরীতে ( নিউইয়র্ক সময়, সকাল ৮:২১ ) সামুতে লগিন করলাম; লগিন করে আজকাল প্রথমে নিজের লগিন স্ট্যাটাস পরীক্ষা করি: এখনো সেমিব্যানে আছি। মোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

উসমানীয় সাম্রাজ্যের উসমান এখন বাংলাদেশে

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৫ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২০



জনপ্রিয় ''কুরুলুস উসমান'' সিরিজের নায়ক Burak Ozcivit এখন বাংলাদেশে। বিগত কয়েক বছর ধরে তার্কির অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সুলতানদের নিয়ে নির্মিত সিরিজগুলো বিশ্বব্যপী বেশ সারা ফেলেছে। মুসলিমদের মাঝেতো বটেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×