somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রধান প্রধান সমস্যা ও সমাধানের উপায় - ৩

২২ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পর্ব - ২ এর পর থেকে

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার পরীক্ষাগারে, সাধারণ ছাত্র ছাত্রী গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহ্নত হচ্ছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থার পরীক্ষাগারে পরীক্ষা নিরীক্ষায় সধারন ছাত্র ছাত্রীর জীবন অতিষ্ঠিত।'গ্রাম পুরে ছাই হয়ে যাক, তাতে কি, আমার গায়ে আগুনের উত্তাপ চাই'। এই হলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নীতি নির্ধারকদের ভুমিকা। এত সবের পরেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কাছুটা হলেও উন্নতির পথে এও কম কথা নয়, কিন্তু এখানেও সমস্যা। সেশন জট, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ইত্যাদি, কিন্তু কেন? এর উত্তর খোজলে একাধিক কারনের মধ্যে যে কারনটি বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনীয়, তা হলো ছাত্র রাজনীতি।
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি মানেই লেজুর বৃত্তি। স্বর্থের আশায় একে অন্যের পা চাটা। ছাত্র রাজনীতি মনেই পিতার স্কন্ধে সন্তানের লাশ, অকালে তরতাজা প্রান ঝরে যাওয়া। ছাত্র রাজনীতি মানেই চর দখলের মত হল দখলের স্বসস্ত্র মহড়া। ছাত্র রাজনীতি মানেই রাজনৈতিক দলের শক্তি বৃদ্ধি করা।ছাত্র রাজনীতি মানেই ছাত্রীতে ছাত্রীতে চুলাচুলি, দিগম্বর করে অপমান করা। ছাত্র রাজনীতি মানেই ন্যায্য প্রতিবাদের ভাষা রোধ করে দেয়া আর যা ইচ্ছে তাই করা, বম ফাটানো, কথায় কথায় গাড়ী ভাঙ্গা, যাকে তাকে আক্রমন চালানো, লুটপাট, চাদাবাজী ইত্যাদি ইত্যাদি।
ছাত্র রাজনীতি নিয়ে অভিভাবক মহলে আতংকের শেষ নেই। কারণ ছাত্র রাজনীতির নামে কোন বাবাই দেখতে চাননা তার যুবক ছেলের লাশ কিংবা সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ। তাই অভিভাবক মহল ছাত্র রাজনীতি নামের লেজুর বৃত্তির রাজনীতি বন্ধের পক্ষেই অভিমত পোষন করেন। কিন্তু কোন কোন বুদ্ধিজীবী আবার ছাত্র রাজনীতি বন্ধের তীব্র সমালোচনাও করেন। যুক্তি দেখান ছাত্র রাজনীতি বহালের পক্ষে। কিন্তু তাদের এই যুক্তি কতটুকু গ্রহন যোগ্য তাও বিবেচ্য বিষয়।


অবকাঠামোর সমস্যা
শিক্ষানীতির প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে যে বিনিয়োগ ঘটাতে হবে, তা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রলম্বিত করা, শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাত ১:৩০, বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য কমিশন, উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত প্রলম্বিত করা এবং স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন স্থাপন করা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য সামনে রেখে এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার সচেতনতা থেকে শুরু করে সামাজিক মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, বৈষম্যহীন আর্থসামাজিক পরিবেশ, মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা উৎসাহিত করা, শিক্ষার অনুকূল আনন্দময় পরিবেশ তৈরি এবং শিক্ষার সর্বস্তরে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ব্যবহার এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
শিক্ষার উন্নয়নে আমাদের অঙ্গীকার যতই প্রবল হোক না কেন, অন্যান্য উন্নয়নকামী দেশের মতোই সীমিত সম্পদের সুবিশাল চাহিদার দেশে যোগ্য বিনিয়োগ ঘটানো নিঃসন্দেহে কঠিন বিষয়। সুযোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে ইতিমধ্যে বিদ্যালয়গুলোতে যথাসময়ে বিনা মূল্যে পুস্তক সরবরাহের কাজটি যে সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে, তা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১-০২ সালে শিক্ষায় জাতীয় বাজেটের শতকরা ৮ দশমিক ৩৪ ভাগ বরাদ্দ ছিল, অথচ তা ২০১০-১১ সালে নেমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪৩ ভাগে। এই তথ্যটি নতুন শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে আমাদের অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বর্তমান শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য সম্পদের যে বিনিয়োগ ঘটাতে হবে, তা স্বাধীন বাংলাদেশ কখনো এর আগে প্রত্যক্ষ করেনি। এর মধ্যে যদি ১০ বছর আগের বরাদ্দের থেকেও জাতীয় বাজেটের ভগ্নাংশ হ্রাস পেতে থাকে, তাহলে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কিছুদিন আগে একটি পরিসংখ্যান নজরে পড়ল—প্রাথমিক শিক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু ব্যয় পাঁচ হাজার ডলারের বেশি, নেপাল ও ভারতে তা মাত্রই ১৩ ডলার, স্বাধীন বাংলাদেশে নিশ্চয়ই আরও কম। সুতরাং, শুধু কথায় নয়, প্রকৃতপক্ষে শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করার কোনো বিকল্প নেই।

প্রাইভেট টিউশনি ও বিদ্যালয় ব্যবস্থা
প্রাইভেট টিউশনি নিয়ে সাম্প্রতিককালে নানা মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত অভিভাবকদের এ উদ্বেগ বেশি। শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার খরচ অনেক অভিভাবকই বহন করতে সক্ষম নন; কিন্তু কষ্ট করে অভিভাবকদের এ খরচটুকু জোগাড় করতে হচ্ছে। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার প্রবণতা যেভাবে বেড়েছে, তা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। অপরদিকে শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে যথাযথভাবে না পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোয় আগ্রহী বলেও কথা উঠেছে। ফলে কিছুদিন আগে একবার শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো বন্ধে আইন প্রণয়নের কথা শোনা গিয়েছিল। সম্প্রতি অবশ্য এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছে না।
আমাদের দেশে প্রাইভেট পড়া বা পড়ানোর প্রবণতাটি নতুন কিছু নয়। গ্রামাঞ্চল বা মফস্বল শহরে আগে বাড়িতে শিক্ষক রেখে বা শিক্ষকের বাড়িতে ব্যাচে পড়ানো হতো। যেসব শিক্ষার্থী পড়ালেখায় দুর্বল ছিল, যাদের পঞ্চম বা অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার কিংবা এসএসসি বা এইচএসসিতে প্রথম বিভাগ বা স্টার মার্কস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, মূলত তাদের বিদ্যালয়ের পড়াশোনার বাইরেও আলাদা প্রাইভেট পড়তে হতো। অনেক সময় বিদ্যালয় থেকেই এ ধরনের আয়োজন করা হতো– বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষক উদ্যোগী হয়ে ভালো ও দুর্বল শিক্ষার্থীদের বাড়তি পড়ার ব্যবস্থা করতেন। অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা প্রাইভেট পড়ত, তাদের অধিকাংশই ইংরেজি বা গণিত বা এরকম কোন ‘কঠিন’ বিষয়ে প্রাইভেট পড়ত। বর্তমান সময়ের চিত্র পুরোপুরি অন্যরকম। এখন এমন শিক্ষার্থীও রয়েছে, যাদের সব বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে দেখা যায়। আগে যে বিষয়গুলোতে (বাংলা, সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি) প্রাইভেট পড়ার কথা অনেকে ভাবতই না, শিক্ষার্থীরা এখন সেসব বিষয়েও প্রাইভেট পড়ছে। বলা বাহুল্য, এ প্রবণতা গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে বেশি।
প্রাইভেট পড়ার এ প্রবণতা উচ্চমাধ্যমিক বা মাধ্যমিক পর্যায় ছড়িয়ে প্রাথমিক পর্যায়েও হানা দিয়েছে। গবেষণা থেকে দেখা যায়, ২০০৫ সালে সারাদেশে প্রথম শ্রেণীর ২২.৩ ও পঞ্চম শ্রেণীর ৩৮.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী অর্থের বিনিময়ে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ছে। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের এবং গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার হার বেশি। প্রাথমিক পর্যায়ে এই প্রাইভেট পড়ার হার প্রতি বছর দুই শতাংশ করে বাড়ছে (সমীর রঞ্জন নাথ, ২০০৬)। এই চিত্র উদ্বেগজনক। ফলে প্রাইভেট টিউশনি পদ্ধতিটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে।
প্রাইভেট পড়ার রীতি সব সময়ই ছিল; কিন্তু আগেকার দিনের প্রাইভেট পড়ার সঙ্গে এখনকার কিছু পার্থক্য রয়েছে। আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগেও শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোতে ‘সহায়তা করা’ বা কোন কিছুর বিনিময় ছাড়াই শিক্ষার্থীদের ‘পড়া দেখিয়ে দেয়ার’ প্রবণতাটা বেশি ছিল। সেখানে বর্তমানে প্রাইভেট পড়া বা পড়ানো পুরোপুরিই ব্যবসায়িক উদ্যোগ, অর্থের বিনিময়ে পড়া তৈরি করে দেয়াটাই এক্ষেত্রে মুখ্য। এমনও দেখা যায়, একজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের বেতন, পরীক্ষা-ফি ও বই-খাতা-কলম ইত্যাদিতে মাসে যত খরচ করছে, তার চেয়েও বেশি খরচ করছে প্রাইভেট শিক্ষকের পেছন। প্রাইভেট পড়ার ফলে কিছু শিক্ষার্থী হয়তো ভালো ফলাফল করছে; কিন্তু এতে লেখাপড়ার সার্বিক মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে; প্রশ্নের সম্মুখীন প্রচলিত স্কুল-সিস্টেমও।
প্রাইভেট পড়া বা পড়ানো খারাপ কিনা– অনেকে সে প্রশ্ন করেন। অনেকে প্রাইভেট টিউশনির পক্ষে, অধিকাংশই বিপক্ষে। যারা বিপক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে, প্রাইভেট টিউশনি ক্ষতিকর। এতে প্রচুর অর্থ খরচ ও সময় নষ্ট হয়, প্রাইভেট পড়ার ফলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে পড়ার প্রতি আগ্রহী হয় না, শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে ইত্যাদি। যারা পক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে, বিদ্যালয়ে যথাযথ পড়ালেখা হয় না বলেই শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতে হয়। তাছাড়া কোন অভিভাবক বিদ্যালয়ের পড়ালেখার বাইরে সন্তানকে আরও বেশি পড়াতে চাইতে পারেনই। যার সামর্থ্য আছে, তিনি চাইবেন তার সন্তান অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যাক। শিক্ষা যেহেতু এখন ‘পণ্যে’র কাতারে এবং শিক্ষার খরচকে সময়ের ‘শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ’ বলে মনে করা হয়, সেখানে যার সামর্থ্য আছে তিনি তো সে সামর্থ্যরে প্রতিফলন ঘটাবেনই। বর্তমান বৈষম্যমূলক সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেহেতু ‘ফ্রিডম অব চয়েজ’ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে একজন অভিভাবকের অধিকার রয়েছে বিদ্যালয়ের পড়ালেখার বাইরেও সন্তানকে ‘বেটার ট্রিটমেন্ট’ দেয়ার। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, যাদের সামর্থ্য নেই তাদের কী হবে? আর এতে কি বিদ্যালয়-ব্যবস্থা আস্তে-আস্তে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে?
বিজ্ঞান শিক্ষায় আমাদের পশ্চাৎপদতা
স্কুল-কলেজ পর্যায়ে আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার অবস্থা খুব খারাপ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন কার্যকরী ব্যবস্থা এখনো নেয়া হচ্ছে না। শহর পর্যায়ে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখনো হতাশাজনক না হলেও গ্রাম-পর্যায়ের স্কুল কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে। তার মানে আগামী দশ বছর পরে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকেরও অভাব দেখা দেবে। ইউনিভার্সিটি পর্যায়েও এখন মৌলিক বিজ্ঞান বিষয়ের কোন কদর নেই।

নামী-দামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য অভিভাবকদের প্রাণান্তকর চেষ্টা
শহরের নামী স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য কত হাজার টাকার ব্যবসা চলছে তার যদি সঠিক পরিসংখ্যান থাকতো – আমরা দেখতে পেতাম – ভর্তি বাণিজ্যে এখন কত লাভ! অভিভাবকরা ভর্তি-বণিকদের হাতে জিম্মি। ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে পারলে ছেলে-মেয়ে ভাল পড়াশোনা শিখবে – এটাই যে প্রধান লক্ষ্য তা বলা যাবে না। তথাকথিত ভালো স্কুলগুলো ঠিক কোন মাপকাঠিতে ভাল তার কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম আমাদের জানা নেই। হয়তো বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপন আর প্রচারের কল্যাণে।

শহর ও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য
বছর দশেক আগেও দেখা যেতো একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল কলেজ থেকেও কোন না কোন শিক্ষার্থী জাতীয় পর্যায়ের মেধাতালিকায় স্থান পাচ্ছে। এখন সে সংখ্যা কমতে কমতে একেবারে শূন্যের কোঠায় এসে পৌছেছে। এখন গ্রামের স্কুল-কলেজগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। গ্রামেও যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সামান্য ভালো – তারা তাদের ছেলেমেয়েদের শহরের স্কুলে লেখাপড়া করানোর চেষ্টা করেন। আর শহরের অলিতে গলিতে এখন ইংরেজি বাংলা মেশানো নানারকম নামের নানারকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একই বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়, কমিউনিটি সেন্টার, সেলুন, সুপারমার্কেট সব একসাথে দেখা যায়। প্রচুর উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে এখন সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হচ্ছেন – কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার মান একটুও বাড়ছে না।


গ্রেডিং পদ্ধতি
গ্রেডিং পদ্ধতিকে ভালো পদ্ধতি বলে মনে করি। আগের মেধাতালিকার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল তার চেয়ে গ্রেডিং পদ্ধতি অনেক ভালো। এ পদ্ধতির ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো আস্তে আস্তে কমে আসছে। কিন্তু রেজাল্টের পদ্ধতির চেয়েও বেশি জরুরি হলো আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নয়ন করা। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু হলে একটা বিরাট গুণগত উত্তরণ ঘটবে বলে আমি মনে করি।

এক্সট্রা-কারিকুলার এক্টিভিটিজের অভাব
বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের – বিশেষ করে শহর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার পেছনে যত সময় ব্যয় করে তা উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের শিক্ষার্থীর চেয়ে অনেক বেশি। একবার স্কুল-কলেজের ক্লাস করে প্রায় প্রত্যেকেই আবার কোচিং সেন্টারে যায়। সেখানে এক্সট্রা -কারিকুলার কিছু করার সময় কোথায়? তারপরও যে শিক্ষার্থীরা যে সাংস্কৃতিক চর্চা করে, ছবি আঁকে তাতেই তো অবাক হতে হয়।

শিক্ষক সমাজের মধ্যে পেশার প্রতি অনীহা
বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন খুব কম। গ্রামের শিক্ষকদের অবস্থা আসলেই খুব খারাপ। কিন্তু শহরের নামী কোন স্কুল-কলেজের শিক্ষক হতে পারলে – এবং নীতি বিসর্জন দিয়ে সুযোগের সদ্‌ব্যাবহার করতে জানলে শিক্ষকদের পক্ষে মাসে লাখ টাকা উপার্জন করা এখন কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু তারপরও শিক্ষকতা পেশায় কেউ আসতে চান না। সে কারণেই দেখা যায় – বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষকতার অপশানের চেয়ে পুলিশের বা কাস্টমসের চাহিদা কয়েকশ গুণ বেশি। এর কারণ বাংলাদেশের নিরিখে আমরা সবাই জানি।

বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি
ব্যবসায়ীরা যখন স্কুল-কলেজ খোলেন তখন তা তাদের অন্য ব্যবসার মত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে আমরা তাদের গালাগালি করি ঠিকই- আবার আমরাই টাকার লোভে ছুটে যাই সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিছু দাক্ষিণ্য পেতে। বাংলাদেশে এখন অনেক বেসরকারী মেডিকেল কলেজ। সেখানে সরকারী মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকরা ঘন্টায় দশহাজার টাকা সম্মানী (আসলে পারিশ্রমিক) নিয়ে ক্লাস নিতে যান। তো এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি এক ধরণের মমত্ববোধ তো তৈরি হয়েই যায়। এখন বেসরকারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে শুরু করে কী নেই! কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই তো টাকার বিনিময়ে ডিগ্রি বেচে।

বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ মিডিয়াম আর মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য
তিন মিডিয়ার বৈষম্য আছে এটা সবাই জানেন। ইংলিশ মিডিয়াম মাদ্রাসাও আছে এখন। মিঃ অধিকারী ‘ও লেভেল’ ‘এ লেভেল’ বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে, আবার দেশীয় সিলেবাসের ইংরেজি মিডিয়াম রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি। আরো একটি পদ্ধতি আমাদের দেশে চালু আছে – ক্যাডেট কলেজ পদ্ধতি। কয়েক বছর আগেও সেখানে বাংলা মিডিয়াম চলতো। এখন ক্যাডেট কলেজগুলোতে নাকি বাংলায় কথা বলতেও নিরুৎসাহিত করা হয়। আমি ঠিক জানি না এভাবে ইংরেজি শেখা যায় কিনা, বা গেলেও সেটা কী কাজে লাগে। আর মাদ্রাসা শিক্ষা আমাদের মত দেশের কোন উৎপাদনশীল খাতকে উন্নত করছে কি না। আমাদের দরকার প্রচুর কারিগরী শিক্ষা, দক্ষ প্রযুক্তির শ্রমিক তৈরির প্রতিষ্ঠান।

শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতি
আমাদের দেশের কোন নিয়োগ পদ্ধতিই প্রশ্নাতীত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের যে পদ্ধতি প্রচলিত আছে তা লজ্জাজনক। এই সিস্টেমের যারা শিকার হয়েছেন তারা জানেন কতটা অপমানজনক অসমপ্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় অনেক যোগ্য ও মেধাবী মানুষকে যাদের মেধা ছাড়া আর কোন সম্বল নেই। বিসিএস পরীক্ষায় দুর্নীতি তো ওপেন সিক্রেট। দেখা যায় দুর্নীতি যারা করেন তাদের কিছুই হয় না – অথচ দুর্নীতির যারা শিকার তাদেরই কষ্ট পেতে হয় পদে পদে। ২৭ তম বিসিএস এর দুর্নীতির রেশ এখনো পুরোপুরি কাটেনি।

শিশুদের দেরিতে ভর্তি ও আগাম ঝরে পড়া
সাধারণভাবে, অন্যান্য অঞ্চলের শিশুদের তুলনায় শিশুরা স্কুলে ভর্তি হয় দেরিতে, আবার আগাম ঝরে পড়ার হারও তাদের মধ্যে বেশি। বয়সভিত্তিক নিট ভর্তি হারের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, প্রতিটি বয়স গ্র“পের শিশুদের নিট ভর্তি হার এ সংক্রান্ত জাতীয় গড় হারের চেয়ে কম। যেখানে বাংলাদেশের ছয় বছর বয়সী শিশুদের ৬৫% স্কুলে ভর্তি হয় সেখানে একই বয়সী শিশুদের মধ্যে এই হার পাওয়া গেছে মাত্র ৫২%। অভিভাবকদের একটি অংশ বলেছেন যে, শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানোর বয়স সম্পর্কে তারা অবহিত নন। আর একটি অংশ ভর্তি না করানোর কোনো অজুহাত দেখাতে পারেননি। অবশ্য এটাও জানা গেছে যে, উক্ত বয়সী শিশুদের একটি অংশকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি করায়নি, যদিও মা-বাবারা তাদের স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। শিশুর বয়স ১৫ বছর হতেই সমতল ভূমির অর্ধেক শিশু, হাওর অঞ্চলের ৬০% শিশু এবং চা-বাগান, পাহাড় ও বনভূমির ৭৩% শিশু বিদ্যালয়-বহির্ভূত শিশুতে পরিণত হয়। এ সংক্রান্ত তুলনামূলক জাতীয় হার ৪০%-এরও নিচে। ঝরে পড়া শিশুদের একটি অংশের পরিবারগুলো পড়ালেখার ব্যয়ভার বহন করতে নিতান্তই অপারগ আর অন্যরা অল্প বয়সেই আয়-উপার্জনের জন্য নানা ধরনের কাজে যোগ দেয়। বিদ্যালয়ে শিক্ষণ-শিখনের দুর্বল মান, শেখানোর ক্ষেত্রে যতেœর অভাব শিক্ষার্থীদের ঝওে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।

ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা
বিদ্যালয় পরিচালনার মৌলিক বিষয়সমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালনের ব্যাপারে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি এবং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কর্মোদ্যোগ খুব কমই লক্ষ করা গেছে। বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত এক বছরে একবারও পরিদর্শন করা হয়নি। আবার বেশ ক’টি মাত্র এক বা দুই বার পরিদর্শন করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। উপজেলা রিসোর্স সেন্টার থেকে পরিদর্শনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্বলতা পাওয়া গেছে। প্রায় ৭৩% প্রাথমিক বিদ্যালয় এক বছরে (২০০৯ সালে) একবারও পরিদর্শন করা হয়নি। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার বিবরণী পর্যালোচনা করে শিক্ষকদের সময়ানুবর্তিতার অভাবের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কার্যতালিকায় বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে কিন্তু এ নিয়ে তারা কোনো কাজ করেছেন বা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে মনে হয়নি। বিদ্যালয় পরিদর্শন সাধারণভাবে খুবই সাধামাটাভাবে করা হয়ে থাকে। পরিদর্শনকালে যা আলোচনা হয় সেগুলো সরাসরি শিক্ষার মানোন্নয়নের সমস্যা বা সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের পথ অনুসন্ধানের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তার অভাব একটা বড় কারণ হিসেবে বের হয়ে এসেছে।


পর্ব - ৩ (চলমান)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৪:৫৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামীলীগে শুধুমাত্র একটি পদ আছে, উহা সভাপতি পদ!

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৪ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪১


বাঙ্গালীদের সবচেয়ে বড়, পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই দলটির প্রতি মানুষের ভালোবাসা আছে। মানুষ এই দলের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছে। ৭০ এর নির্বাচনে এই দলটিকে নিরঙ্কুশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমপি আনারের মৃত্যু এবং মানুষের উষ্মা

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:২৯


সম্প্রতি ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পর আনোয়ারুল আজীম আনার নামে একজন বাংলাদেশি এমপি নিখোঁজ এবং পরবর্তীতে তাকে শ্বাসরোধে হত্যার পর তার মরদেহের হাড়-মাংস আলাদা করে হাপিত্যেশ করে দেওয়া হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

দোয়া ও ক্রিকেট

লিখেছেন শাহাবুিদ্দন শুভ, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৪


দোয়া যদি আমরাই করি
তোমরা তাইলে করবা কি?
বোর্ডের চেয়ারম্যান, নির্বাচকের
দুইপায়েতে মাখাও ঘি।

খেলা হচ্ছে খেলার জায়গা
দোয়ায় যদি হইত কাম।
সৌদিআরব সব খেলাতে
জিতে দেখাইত তাদের নাম।

শাহাবুদ্দিন শুভ ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে “বাঘ” বলা বন্ধ করুন!!

লিখেছেন অন্তর্জাল পরিব্রাজক, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:২১



দয়া করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে “বাঘ” বলা বন্ধ করুন!! X( এরা ছাগলের দলই ছিল, তাই আছে, তাই থাকবে :-B !! এরা যেমন ধারার খেলা খেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তোমার বকুল ফুল

লিখেছেন নীল মনি, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৪

বকুল ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে থাকে আমার এই ঘর। আমি মাটির ঘরে থাকি। এই ঘরের পেছন দিকটায় মা'য়ের হাতে লাগানো বকুল ফুলের গাছ৷ কী অদ্ভুত স্নিগ্ধতা এই ফুলকে ঘিরে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×