somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডাক হরকরা ডাকে

২০ শে জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বহুকাল আগের কথা । রানার কবিতাটা এতবার পড়েছি আর এতটা আবেগে আপ্লুত হয়েছি যে এখনও মনে বাজে । বাবার কিনে দেওয়া প্রথম কবিতার বই - সুকান্ত ভট্টাচার্যর ছাড়পত্র

কত গ্রাম, কত পথ যায় স'রে স'রে
শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;
হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন্ জোনাকিরা দেয় আলো
মাভৈঃ রানার ! এখনো রাতের কালো।

এরপর একদিন নতুন বাংলা বই হাতে পেয়ে কোন এক বছরের প্রথম দিনে একটা গল্প পড়েছিলাম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর ডাক হরকরা। সেখান থেকে আমার একটা আবেগ গড়ে ওঠে ডাক ব্যবস্থার সাথে জড়িত এই রানার/ডাক হরকরা বা পিয়ন চরিত্রটির উপর ।
বাবা বেসরকারি অফিসে চাকরি করতেন ।সেই সুবাদে তার বাড়ি আসা হত না প্রায়ই । মাসের পর মাস কেটে যেত । মাকে দেখতাম চিঠি লিখতে । আমিও আমার ছোট প্যাড আর কলম নিয়ে বসে ভাঙ্গা অক্ষরে বাবাকে লিখেচি অনেক কথা । কয়েকটা লাইন এখনও মনে পড়ে ।
“আব্বা, মা মারছে । আমি খেলতে যাবো ।” “তুমি কবে আসবা ? আসার সময় ব্যাট আনো” “ এবার স্কুলে আমি একসাথে ৫ টা প্রাইজ পাইছি।”
আমি জানি শুধু আমি না । আরো অনেক শিশুর কাছেই এই আবেগটা ছিল। হয়তো কেউ কেউ এই লেখাটা পড়ে স্মৃতিচারণ করবেন। তবে আমার সবথেকে বেশি ভাল লেগেছিল স্কুলে যাবার সময় ঝালমুড়ির দুই টাকা দিয়ে হলুদ একটা খাম কিনে সেখানে আমার সেই নালিশ চিঠি পুরে - জিভের আঠায় লাগিযে, ডাকবাক্সটায় ফেলে দেয়ার মুহুর্তগুলো । একদিন বাবার ব্যাগ থেকে কি জানি খুজতে গিয়ে এক কোণায় যত্ন করে রাখা আমা সেই চিঠিগুলো দেখে চোখে পানি এসেছিল আনন্দে।

বৃষ্টির দিনেও যখন সাইকেলের রিং শুনতাম জানালার পাশে আমি নিশ্চিৎ ছিলাম ডাকপিয়ন এসেছে আমার বার্তা নিয়ে । বুকটা ভরে উঠত এইসা আনন্দে । সেসব দিন আজ শুধুই স্মৃতি হয়ে দাড়িয়েছে। যে কারণে আজকে কীবোর্ডটা কোলে তুলে নেয়া ।

আমার যে স্মৃতিগুলোর কথা বর্ণণা করেছি তার সাথে অনেকেরই স্মৃতি মিলে যেতে বাধ্য। তাকিয়ে দেখুন পিছনের দিকে । ডাকপিয়ন আর ডাকবাক্স নিয়ে কত স্মৃতি যে উঠে আসবে বলে শেষ করতে পারবেন না । একসময় মনের কোণায় একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস উঠে আসবে । কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের খুব খুব সুখের কিছু মুহুর্ত এনে দেয়া দীনুরা ? ডাকবাক্সের লাল রঙ আজ ধূসর হয়েছে। সময় করে ওটা খোলার দরকার পড়ে না রোজ বেলা ১২-৩০ মিনিটে ।

আমাদের অনেক কিছুই হারিয়েছে বা হারিয়ে যেতে দিতে হয়েছে। সময়ের কাছে আমাদের আবেগ দাড়াতে পারেনি। কিন্তু , আধুনিকতার নাম করে আমরা কি কোনকিছু বলি দিয়ে ফেলেছি? আধুনিকতার অর্থ তো কোনকিছু লোপাট করা নয় । বরং সামঞ্জস্যতা আনা । বরং আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে আমাদের সবকিছূকেই একীভূত করা ( কুসংস্কার আপন ইচ্ছায় ঝরে যায় ) ।

চীনের প্রতিটি পোস্ট অফিস আধুনিকায়ন করা হয়েছে। রাষ্টায়ত্ত এই সংস্থাটি সবথেকে বেশি নির্ভরতার প্রতীক হযে দাড়িয়েছে। বাংলাদেশের চেয়ে ৬০ গুন বড় গণচীনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের মানুষ পোস্ট অফিসের মাধ্যমেই যোগাযোগ করে থাকে । প্রতিটি পোস্ট অফিস কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত হলেও সেগুলো মানুষই নিয়ন্ত্রন করে । পোস্টম্যানের চাকরি এখনও রয়েছে এবং সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কার চিঠি এখন কোথায় আছে সেটি ইন্টারনেটে দেখা যায় । কোন পোস্ট অফিসের কোন ব্যক্তির কাছে গেলে সেটি পাওয়া যাবে সেটাও জানা যায় । প্রিয়জনের জন্মদিন । আপনি দূরে আছেন । পৌছে যাবে সঠিক সময়ে আপনার পাঠানো গিফট। যেটা আপনি নিজে গিযে কেনেন নি । যা ইমেইলে পাঠানো সম্ভব না । আপনার প্রিয়জন যখন দেখবে তার দরজায় দাড়ানো ডাকপিয়নের হাতে আপনার পাঠানো জিনিস। একবার ভাবুন সেই অনুভূতিটার কথা । মোটকথা ডাকপিয়নের অস্তিত্বকে ভ্যানিশ করে নয় বরং আরো উপযুক্ত করে দাড় করানো হয়েছে। ভারতেও চলছে সেই চেষ্টা । বড় বড় দেশগুলোতোও সেটা হয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই হয় নি। প্রমাণ চান ?
বুকে হাত দিয়ে বলুন তো ,, আপনার বর্তমান এলাকার পোস্ট অফিসটা কোথায় ? আপনার সখের ডাকটিকিট জমানো অ্যালবামে মোট কতটা দেশীয় ডাকটিকিট ?? অ্যালবামের নাম কি ? বিদেশী ডাকটিকিট সমগ্র না ?
বলুন তো আপনার দেখা শেষ পোস্টম্যানটির সাথে কবে দেখা হয়েছে?
আশা করি বুঝে গেছেন আমার লেখার উদ্দেশ্যটা ।

গ্রেট ব্রিটেনের বিগবেন এর দেয়া সময় নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই । কারণ প্রত্যেকের হাতে মোবাইল ফোনে সময় দেকা যায় । তবুও বিগবেন এখনও আছে রঙিন। প্রতিটি ইংরেজ এখনও তার পূজা করে কবিতা বা নাটকে । অথচ আমরা সেটা ছেড়ে দিয়েছি । আমাদের নাটকের বা গানের বড় অংশ হয় প্রেমে ছ্যাক দেয়া না হয় ছ্যাক খাওয়া । অথচ কত আর্তনাদ যে চাপা পড়ে গেছে তার হিসাব নাই ।
পোস্ট অফিসের বারান্দায় পোস্টম্যানের অলস সময় এর ফাকে তার সাইকেলের স্পোকে ধরেছে জং । বড়বাবু বলে দিয়েছেন খরচ কমাতে অপ্রয়োজনীয় লোক ছাটাই হবে। সংসারের হাল হকিকত কি হবে আল্লাহ মালুম ।

ভাই , বন্ধু, আমাদের সমাজটা অতটা আধুনিক হয় নি যতটা আমরা ভাবে দেখাই । মেইল বা মোবাইল এর অবদান আমি অস্বীকার করি না । কিন্তু তারপর ও এটাই কি সব অনুভূতিকে ট্রানসফার করতে পারে ? ভেবে দেখুন যে কথা আপনি ফোনে বলেন - আপনার আত্মার মানুষগুলোর সাথে সেই কথা গুলো চিঠিতে বললে আরো কি রঙিন হত না আপনার অনুভূতিগুলো ? মেইলে যা যা কপি পেস্ট করছেন তার থেকে চিঠিতে লেখা আপনার নিজ হাতে লেখা দুই লাইনের অনুকাব্য কি আপনার প্রিয়জনকে আরো সাসপেন্স , আরো রোমান্টিকজম দিতে পারতো না ?

এখনও রাত জেগে ভাবতে ইচ্ছা করে কাল সকালে যদি একটা চিঠি পাই !!!

আমরা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমকে আমাদের রানার বা ডাক হরকরার সাথে যুক্ত করতে পারি কিন্তু তাই বলে বিনাশ করলে নিজের অস্তিত্বে কি একটু ঘা লাগে না ?
ভেবে দেখুন আপনার সবথেকে প্রিয় বন্ধুটির কথা । হয়তো অন্য শহরে থাকে । আপনার সাথে কথা হয় না অনেকদিন । একদিন সময় করে এক পাতা লিখুন তাকে ? শালা ভূলে গেলি আমাকে >? কত স্মৃতি আমাদের । মনে পড়ে সেই কাজলা নদীর ধারের প্রাইমারি স্কুলে সারের করা চুরি করে খেয়েছি। হাহাহ,,, কেমন আছিস ? সময় করে একদিন চিঠি দিস । তোকে নিয়ে দুই লাইনের একটা কবিতা লিখেছি ---
স্মৃতির চর হয় --বালুচর হয় না ।
বন্ধু কখনও দূরে দূরে রয় না ।

এই কথাগুলোই দেখবেন কতটা আবেদন সৃষ্টি করে আপনার বন্ধুর মনে । আমি জানি অনেক অনেক বন্ধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারপাশে। মাসে না হয় একটা করে চিঠি লিখুন তাদের । আর ডাক বিভাগের এখনও সেই দুই টাকার খামে করে ফেলে দিন ডাক বাক্সে । আবার রানারের পায়ে দৌড় আসুক । ডাক হরকরার পায়ের শব্দে কাঁপিয়ে তুলুক গ্রাম। পোস্টম্যানের সাইকেলের বেলে রমনীর তন্দ্রা ছুটুক প্রিয়জনের চিঠির প্রতীক্ষায় ।

এটা নিতান্তই একটা মানবিক আবেদন । হবে নাকি ? প্রতি মাসে অন্তত একটা ? এত সব আধুনিকতার ভীড় ঠেলে আপনাকে কি কোনদিনও দেখব ? পোস্ট অফিসের দরজায় আপনি খাম নিয়ে ফিরছেন ???

জাতিসত্তার সাথে মিশে থাকা একটা অনুভূতির কথা বললাম । ভাল লাগলে একটাবার কাজটা করে দেখবেন -- কতটা আনন্দ পান । অন্তত কোন ব্লগ সাইট বা ফেসবুকের স্ট্যাটাসে কতগুলো লাইক পড়ল এটা নিয়ে যতটা সাসপেন্স বা মজায় থঅকেন তার চেয়ে বেশি মজা পাবেন এ আমার বিশ্বাস না , চ্যালেঞ্জ ।
ভাল থাকবেন সবাই ।


রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার !
রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:২৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×