somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ ক্ষুধা

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৮:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের পাশের ছোট একটি গ্রাম চান্দের চর । একেবারে অজপাড়া গাঁ । বিদ্যুত্‍ এর লাইন এখনো এসে পৌছয় নি । বেশীরভাগ বাসিন্দা ক্ষেত মজুর । গ্রামে একটি মাত্র প্রাইমারী স্কুল । শিক্ষার আলো তাই এখানে বিকশিত হতে পারেনি । অধিকাংশই অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ । ছোট একটা রেল ষ্টেশন আছে বটে । সকাল বিকাল লোকাল ট্রেন থামে দুইটা । যাত্রী সংখ্যা খুবই নগণ্য । একজন ষ্টেশন মাষ্টার । তিনিই সব কিছু সামাল দেন । বাবুল আর কাশেম নামের কুলি আছে দুইজন । ষ্টেশনে কুলি গিরি করে আর ষ্টেশন মাষ্টারের ফুট ফরমায়েশ খাটে । ট্রেন আসলেই কিছুটা ব্যস্ততা । হাতেগোনা যে দুয়েকজন যাত্রী আসে তারা চলে গেলে সব কিছু থমকে যায় ।

কোন এক সকালে ষ্টেশন মাষ্টার রফিকুল ইসলাম দেখলেন প্লাটফর্মের কোনায় পড়ে রয়েছে একটা লোক । উটকো ঝামেলা ভেবে কাছে গিয়ে ডাক দেন । হাড় জিরজিরে শরীরটা নিয়ে কোনমতে উঠে দাড়ায় সে । দুর্বল শরীর আর কোটরাগত চোখের কারনে বয়স অনুমান করা যায় না । পড়নে একটা পুরোনো আধ ময়লা ছেঁড়া লুঙ্গি মাত্র । স্বভাবজাত কৌতুহল মিটানোর জন্য বললেন,
- অই মিয়া, বাড়ি কই ?
- অনেক দূরে ।
- এইখানে আইলা কেমনে ?
- কাইলকা বিহালের টেরেনে আইছি ।
- বাড়িত যাইবা ? ভাড়া নাই ?
- না যামু না ।
- কেন যাইবা না ? বাড়িত কেউ নাই ?
- খাইতে পাই না, বাড়িত যাইয়া করমু কি ।
- নাম কি তোমার ?
- রমিজ উদ্দীন ।
- কাম করবা আমার এইহানে ?
- পেট ভইরা খাইতে দিবেন ?
- হ, দিমু ।
- তাইলে করমু কাম ।
তারপর থেকে রমিজকে দেখা যেত ষ্টেশনে রফিক সাহেবের ছোট খাট কাজগুলো করে দিতে । মাঝে মাঝে কুলিগিরিও করে সে । রফিক সাহেব দয়া পরবশ হয়ে হয়ত মাঝে মাঝে কিছু খেতে দেয় কিন্তু রমিজের পেট ভরে খাওয়া আর হয়ে ওঠে না ।

চান্দের চরের চেয়ারম্যান মিন্টু খন্দকারের একমাত্র মেয়ের বিয়ে দুই দিন পরে । গ্রামে যে দুয়েকটি অবস্থা সম্পন্ন পরিবার আছে মিন্টু খন্দকার তাদের মধ্যে একজন । অনেক সম্মানী লোক । তার এক কথায় গ্রামের লোক ওঠে বসে । একমাত্র মেয়ের বিয়ে তাই অনেক বড় আয়োজন । বাড়িতে ইতোমধ্যেই আত্মীয় স্বজনে ভর্তি । আশেপাশের তিন গ্রামের মানুষ দাওয়াত পেয়েছে । রবিবার সকালের ট্রেনে শহর থেকে বিয়ের সামগ্রী নিয়ে আসলেন তিনি । কিন্তু কুলি দুইটাকে খুঁজে পেলেন না । এদিকে এত মাল পত্তর তিনি নিজে বয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না । বসে বসে যখন কুলির জন্য অপেক্ষা করছিলেন এই সময় রমিজ এসে তার সামনে দাড়ায় ।
- চেয়ারম্যান ছাব কি বাবুলের লাগি বইয়া রইছেন ?
- হ, এত মাল পত্তর আমি তো একলা নিতে পারুম না ।
- বাবুল তো গ্যাছে ইছাপুরার গঞ্জে । আইতে দেরী অইব । আফনে কইলে আমি লইয়া যাই ।
- তুই পারবি ? এত্ত ভারী বোঝা । পথ তো কম না ।
- হ, পারুম । তয় আমার টেকা লাগব না খালি একবেলা পেট ভইরা খাইতে দিয়েন ।
এহেন প্রস্তাবে মিন্টু সাহেব কিছুটা অবাক হন । শেষে আর কোন উপায় না পেয়ে বলেন,"ঠিকাছে, ল যাই । বাড়িত সবাই আমার লাইগা বইয়া রইছে ।"

ষ্টেশন থেকে চেয়ারম্যানের বাড়ি প্রায় দেড় মাইল । হাটতে হাটতে তিনি ভাবেন এত ভারী বোঝা নিয়ে রমিজ না আবার পরে যায় । আড়চোখে কয়েকবার রমিজের শীর্ণ শরীরটার দিকেও তাকান তিনি । এক বেলা পেট পুরে খাওয়ার আশায় রমিজও দুলতে দুলতে চলতে থাকে । সূর্য যখন মাথার উপর তখন তারা দুইজন পথক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়িতে ঢোকে । বাড়ির কাজের লোক কে মাল সামান ভিতরে নিয়ে যেতে বলে বাড়িতে ঢোকেন তিনি । বউকে বলেন রমিজকে খাইয়ে বিদায় করতে । বাড়িতে এত মেহমান, তাদের খাওয়াইতো হয়নি এই অজুহাতে বউ তাকে বলেন গঞ্জের কোন হোটেল থেকে খাইয়ে দিতে । অগ্যতা তাতেই রাজি হয়ে কাজের লোকটার সাথে রমিজকে গঞ্জে পাঠিয়ে দেন । বলে দেন হোটেল থেকে রমিজকে যেন পেট ভরে খাওয়ানো হয় । টাকা তিনি পরে দিয়ে দিবেন ।

দুপুরে খাওয়ার পর ভাতঘুম দেওয়াটা মিন্টু চেয়ারম্যানের বহু দিনের অভ্যাস । কিন্তু আজকে সেটা হল না । দুপুরে মাত্র পিঠটা বিছানায় লেগেছে অমন সময় গঞ্জ থেকে খবর এল রমিজ নাকি কি একটা গন্ডগোল পাকিয়ে বসে আছে । লোকজন তাই ভয়ে তার কাছে খবর নিয়ে এসেছে । পাঞ্জাবীটা গায়ে চড়িয়ে তাড়াতাড়ি রওনা হয়ে যান তিনি । শুভংকর ময়রার খাবার ঘরের সামনে ততক্ষণে ভীড় লেগে গেছে । তাকে দেখে সবাই পথ করে দেয় । ভিতরে ঢুকলে ম্যানেজার এগিয়ে আসে
- আসেন চেয়ারম্যান সাব, দেইখা যান । আপনে পাডাইছেন বইলা তারে বসাইছি । এহন পর্যন্ত ছয় ডেকচি ভাত খাইছে । আরও আনতে কইতাছে ।

ম্যানেজারের কথায় হতবিহ্বল চেয়ারম্যান এগিয়ে যায় রমিজের দিকে । রমিজ তখনো গোগ্রাসে ভাত গেলায় ব্যস্ত । কি মনে করে মিন্টু চেয়ারম্যান রমিজের লুঙ্গিটা টান দিয়ে দুই ইঞ্চি নিচে নামিয়ে ফেলেন । নাহ, নেই । সন্তানের সাথে মায়ের যোগসূত্রের চিহ্ন নাভিটা নেই । বিস্ময়ে হতবাক তিনি রমিজের হাতটা ধরে টান দিয়ে উঠিয়ে ফেলেন ।
- কি করতাছেন চেয়ারম্যান সাব । আমার পেট তো অহনও ভরে নাই ।
- ওঠ, তোর আর খাওন লাগব না ।
বিকালের ট্রেনটা এর মধ্যে এসে পরেছে । ধাক্কা দিয়ে রমিজকে তাতে উঠিয়ে দেন তিনি । তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দূরে সরে যেতে চান । কোন এক অজানা আশঙ্কায় পিছন ফিরে তাকাতেও ভয় পান । কিন্তু ঠিকই তিনি শুনতে পেলেন রমিজের অষ্পষ্ট কন্ঠস্বর, " কেউ আমারে পেট ভইরা খাইতে দিল না ।"
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×