somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমুদ্রে জীবন - ১৫

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৯:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


[এই সিরিজের একটা লেখা অনেকদিন পরে পোস্ট করা হলো। কেউ চাইলে এর ঠিক আগের লেখাটা এখানে দেখতে পাবেন: Click This Link উপরে যে জাহাজের ছবিটা দেয়া আছে, ঐ জাহাজে করে যাত্রার বর্ণানাই নীচে আপনাদের সাথে শেয়ার করা হলো !]

৯/১১-র পর পর আমি যে জাহাজে জয়েন করি, সেই জাহাজটা চলতো Singapore - Jebel Ali (Dubai) - Fujairah - Navashiva (Bombay) - Singapore এই loop-এ। হঠাৎই খবর আসলো আমাদের রুট বদলে যাচ্ছে এবং আমরা US route-এ যাচ্ছি। মালোয়েশিয়া ততদিনে কি একটা বেয়াদবী যেন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে - আমার একদম বিশদ মনে নেই, তবে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান আক্রমণ নিয়ে, কি যেন বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন সে দেশের শীর্ষ-স্থানীয় নেতারা। তাতেই যুক্তরাষ্ট্র, মালোয়েশিয়ার উপর খুব ক্ষ্যাপা। শোনা যাচ্ছিল: কোন জাহাজে মালোয়েশিয়ান বা পাকিস্তানী শীর্ষ-স্থানীয় অফিসার থাকলে, সেই জাহাজকে কখনো বন্দরে (বিশেষত নিউ ইয়র্কের মত বন্দরে) ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না - আবার কখনো বন্দরে ঢুকতে দেয়া হলেও জাহাজের কাউকেই "shore leave" দেয়া হচ্ছে না অর্থাৎ মাটিতে পা রাখতে দেয়া হচ্ছে না - জাহাজের 'port-hole' দিয়ে মাটি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। যারা কখনো জাহাজে চাকুরী করেছেন, অথবা যাদের পরিবারে জাহাজী কেউ আছেন, তারা জানেন যে, বন্দরে গিয়ে মাটিতে পা রাখতে না পারাটা কতটা কষ্টের। কন্টেইনার জাহাজে কখনো কেবল কাজের জন্যই এমনটা হতে পারে - তবে নামতে না পারাটা যখন বাইরে থেকে জোর করিয়ে চাপিয়ে দেয়া হয় - তখন বোধহয় কষ্টটা আরো বেশী হয় - কেমন দম-বন্ধ একটা বন্দী অবস্থার অনুভূতি হয়! যাহোক, শীর্ষ পদ দু'টোর একটাতে কর্মরত একজন মালোয়েশিয়ানকে সরিয়ে আমাদের জাহাজ নতুন route-এ place করা হলো - যদিও মাঝারি rank-এ দু'জন মালোয়েশিয়ান থেকেই গেলো! অবশ্য ওরা দু'জনই ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দু হওয়াতে মনে হলো ওদের নিয়ে আমাদের কোম্পানীর অস্বস্তিটা বেশ কম! ৯/১১-র পরে থেকেই ক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হিন্দু তথা ভারতীয়দের "আদর-কদর" বেশ বেড়ে যেতে থাকে এবং একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলে যে কেউ বুঝবেন যে, তাই হবার কথা!

নতুন route-এ আমাদের যাত্রা শুরু হলো গণচীনের Chiwan থেকে। Chiwan (China) - HongKong - Kaohsiung (Taiwan) - Kobe (Japan) - Tokyo(Japan) - Panama Canal - Colon Manzanilo (Panama) - Miami(US) - Savannah(US) - Charleston(US) - Norfolk(US) - New York(US) - Rotterdam (Holland) - Bremerheaven (Germany) - Felixstowe (UK) - Le Havre (France) - New York - Norfolk - Charleston - Miami - Colon Manzanilo - Panama Canal - San Pedro (US) - Oakland (US) - Tokyo - Kobe - Chiwan - ৮৪ দিনের এই বিরাট loop-এ। ৯/১১ পর ২০০১-এর ডিসেম্বরে প্রথমবার আমরা যখন যুক্তরাষ্ট্রর New York-এ পৌঁছাই, তখন পরিবর্তিত পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে আমাদের অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল - কিন্তু আজ সে সব গল্প বলবো না। আজ বরং আপনাদের সাথে দ্বিতীয় voyage-এ এশিয়ার দিক থেকে গিয়ে যখন New York পৌঁছালাম, তখনকার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো, ইনশা'আল্লাহ্!

প্রথম voyage-এ আমরা জাহাজ বেঁধেছিলাম New York অঙ্গরাজ্যের Staten Island-এ। কিন্তু দ্বিতীয় voyage-এ আমরা বার্থ করি পাশের রাজ্য New Jersey-র Newark-এর PNCT জেটিতে - New York-এর মালামাল ঐ জেটিতে ওঠানো/নামানো বড় বড় (লাইনার) কন্টেইনার জাহাজগুলো জন্য নিয়মিত ব্যাপার। সেবার, ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ঐ অঞ্চলে প্রচন্ড ঠান্ডা ও বরফ পড়েছিল! জাহাজ বাঁধার পর পরই নাস্তা করে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম - New York-এর Bronx-এ আমার ছোটমামা থাকেন - তার বাসার উদ্দেশ্য। PNCT-র আশপাশের এলাকাটা আমার চনো-জানা নয়। তাই, গেট দিয়ে বের হয়ে ওখানকার Calcutta ও Export স্ট্রীটের সন্ধিস্থলে অবস্থিত একটা Seamen Club মত জায়গায় গেলাম। বরফ পরিষ্কার করে রাস্তাটুকু কোনমতে বের করা হয়েছে - বেশ বাতাস বইছিল এবং সকাল ৮টার দিকে যে তাপমাত্রা ছিল, তা বাঙ্গালী হাড়ে বেশ লাগছিল! ওখানকার একটা ফোন বুথ থেকে একটা ট্যাক্সি কোম্পানীতে ফোন করলাম। বুঝলাম জায়গাটা শহর থেকে বাইরে বলে, আশে পাশে কোন খালি ট্যাক্সি অবস্থান করছে না। "আশে পাশে কাউকে পেলে পাঠানো হবে" - এমন একটা vague আশ্বাস দেয় হলো আমাকে। সেই আশ্বাসের উপর ভরসা করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই জেনে, ঐ Seamen Club সামনের রাস্তার একটা Bus Stop-এর shed-এর নীচে দাঁড়িয়ে অনিশ্চিত ট্যাক্সির অপেক্ষা করতে থাকলাম। Bus Stop-এ New Jersey Transit-এর 40 নম্বর একখানা বাস আসে তা বুঝতে পারলাম। কিছুক্ষণ পর সত্যিই একদম খালি 40 নম্বর একখানা বাস এসে ওখানে দাঁড়ালো। বাসে কোন যাত্রী নেই - বাসের ড্রাইভার আনুমানিক ৩৫ বয়স্কা এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা - ধীরে সুস্থে বাস থেকে নেমে এসে তার বাসের বিনটা, রাস্তার পাশে রাখা বিনে খালি করতে করতে আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম বাসখানা Newark Penn Station যাবে কিনা। তিনি আমাকে বললেন যে যাবে - তারপর আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন যে, আমি কোথায় যাবো? আমি বললাম যে আমি Newark Penn Station থেকে Path ট্রেন (অগণিত কর্মজীবী মানুষ প্রতিদিন এই ট্রেনে করেই New Jersey আর New York-এর মাঝে যাতায়াত করে থাকেন) ধরে New York-এর 33rd/34th street এ যাবো; কিন্তু আমি ইতোমধ্যেই একখানা ট্যাক্সি ডেকেছি এবং তার অপেক্ষা করছি । বহু দিনের পরিচিত কারো মত তিনি বেশ দাবী নিয়ে উপদেশের সুরে আমাকে বললেন যে,পয়সা আছে বলেই তা অযথা খরচ করতে হয় না - আমি যেন আরেকটি ফোন করে ট্যাক্সিটা বাতিল করে আসি এবং তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন - আমি ফিরে আসলে আমাকে নিয়েই যাবেন। আমি তার কথামত কাজ শেষে ফিরে আসলে তিনি যাত্রা শুরু করলেন। মহিলা এক তরফাভাবেই কথা বলতে শুরু করলেন - বুঝলাম তিনি গল্প করতে খুব ভালোবাসেন। তার নাম জানলাম Eleanor : স্বামী পরিত্যক্তা। আমার সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানালাম তাকে। অল্পক্ষণের মাঝেই তিনি সদ্য ঘটে যাওয়া পৃথিবী বদলে দেয়া ৯/১১-র ঘটনার কথা বলতে শুরু করলেন। ঐ দিন তার কেমন লেগেছিল - ঘন কালো ধোয়া, ধূলো আর মাংসপোড়া গন্ধে যেন আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল - তার কাছে মনে হয়েছিল যে, ক্বিয়ামত সংঘটিত হচ্ছে বুঝিবা। ভীত-সন্ত্রস্ত পলায়নপর মানুষগুলোকে কিভাবে তিনি বাস ভর্তি করে করে New York থেকে New Jersey এনে এনে নামিয়ে দিচ্ছিলেন ইত্যাদি। বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, এমন কারো মুখ থেকে ৯/১১ সম্বন্ধে সেটাই আমার প্রথম সরাসরি গল্প শোনা। এক পর্যায় আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম ঘটনাটা কেন ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি একটু চুপ করে বললেন যে, এসব আমাদের সাধারণ মানুষদের কোন ব্যাপার নয় - পৃথিবীটা কারা নিয়ন্ত্রণ করবে তাই নিয়ে এত গন্ডগোল আর ধ্বংসলীলা - প্রভাব বলয় বিস্তারের যুদ্ধের শিকার আমরা নির্বোধ সাধারণ মানুষেরা। স্বল্প শিক্ষিত ঐ মানুষটি পরিষ্কার না জানলেও এটুকু বুঝেছেন যে কাজটা যারা করেছে বা করতে দিয়েছে -তারা আমাদের মত সাধারণ মানুষ নয় - তারা অসুর! তার কথাগুলো আমার বহুদিন মনে থাকবে। আজ সেই সূত্র ধরেই আপনাদের জন্য নীচে ৩টি ভিডিও ক্লিপ্স লাগিয়ে দিচ্ছি। দয়া করে মন দিয়ে দেখবেন আর গভীরভাবে চিন্তা করবেন - পৃথিবীটা কারা, কিভাবে চালাচ্ছে!!







সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৯:৪৯
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পুরনো ধর্মের সমালোচনা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেই নতুন ধর্মের জন্ম

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:১৫

ইসলামের নবী মুহাম্মদকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে এক বছরের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে প্রবেশনে পাঠানোর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×