somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আংকর ভাট (Angkor Wat) - পৃথিবীর বৃহত্তম উপাসনালয়

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১২ ভোর ৬:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পৃথিবীর সবচে বড় হিন্দু মন্দির কোনটি? সারা ভারত খুজে বেড়ালেও কিন্তু এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবেন না। আপনাকে চোখ ফেরাতে হবে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার ছোট দেশ ক্যাম্বোডিয়ার দিকে




সামনে থেকে আংকর ভাট মন্দির

ক্যাম্বোডিয়ার সিয়েম রিপ প্রদেশে, সিয়েম রিপ(Siem Reap) শহরের থেকে সামান্য উত্তরে অবস্থিত আংকর ভাট। আংকর শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ “নগর” থেকে আর ভাট হল খেমার শব্দ। আংকর ভাট শব্দের অর্থ হল মন্দির নগরী। খেমার রাজারা ৮০০ সাল থেকে ১৪৩১সাল অবধি এই ৬০০ বছরের বেশী সময় ধরে রাজত্ব করেন । এই সময়ে তারা নির্মান করেন এক হাজারের ও বেশী হিন্দু মন্দির। প্রত্যেক রাজাই নির্মান করেছেন ছোট বা বড় মন্দির। এই মন্দির গুলোর অধিকাংশ আজ ধ্বংশ প্রাপ্ত, অনেকগুলোই মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইটের ঢিবি। এখন ও ৭২টি মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। হাজার বছরের ও বেশী সময় ধরে আজও সর্বস্রেষ্ঠ যে মন্দির মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে তা হল “ আংকর ভাট” অনেকের মতে পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্মীয় স্থাপনা।

মুল মন্দির, সামনে পরিখা


দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার শ্রেষ্ঠ পুরাকীর্তি এই মন্দির গুলোকে জাতিসঙ্ঘের অংগ সঙ্গঠন ইউনেস্কো (UNESCO) ১৯৯২ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ( World Heritage site ) হিসেবে ঘোষনা করে। ইউনেস্কো(UNESCO) র নির্ধারিত ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত মন্দির গুলো।

মন্দিরের স্তম্ভ।

খেমার রাজ্যঃ- খেমার রাজ্যের গোড়া পত্তন করেন রাজা জয়বর্মন।জয়বর্মন জাভা সাম্রাজ্যের থেকে বেরিয়ে এসে ৮০০ শতাব্দীতে স্বাধীন রাজ্য “কম্বোজদেশ” প্রতিষ্ঠা করেন । এখনকার সময়ের ক্যাম্বোডিয়া দেশের দুটো প্রদেশ নিয়ে ছিল ক্যাম্বোজদেশ। রাজা জয়বর্মন নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা বা “ চক্রবর্তী” ঘোষনা করেন এবং দেবতা শিবের অধস্তন হিসেবে নিজেকে দাবী করেন “দেবরাজ” হিসেবে।তার রাজধানী হয় হরিহরালয়(এখনকার রলুস শহর) । হিন্দু দেবতা হরি বা বিষ্ণু এবং হর বা শিবের আলয় ছিল রাজধানী হরিহরালয়। ক্যাম্বোডিয়া দেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত হ্রদ “টনলে স্যাপ” বা বৃহৎ হ্রদ। হ্রদের উত্তরে অবস্থিত ছিল এই নগরী।খেমার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্ধ শতাব্দী পর রাজা জয়বর্মন পূত্র যশবর্মন হরিহরালয়ের পাশে তার রাজধানী নির্মান করে নাম রাখেন যশোধরপুর। এই যশোধরপুরই ৫শতাব্দীর ও অধিক কাল ব্যাপী ছিল খেমার রাজাদের রাজধানী যা পরবর্তীতে নামকরন হয় আংকর (নগর বা রাজধানী) খেমার রাজাদের নগরগুলোর বৈশিষ্ঠ হল শহরের চারপাশে থাকত প্রতিরক্ষার জন্য পরিখা এবং তার তীরে উচু করে বাঁধ। নগরীর কেন্দ্রে থাকত রাস্ট্রীয় মন্দির, বৃহৎ জলাধার যাদেরকে বলা হত “Baray” কাঠের তৈরী রাজপ্রাসাদ এবং অনান্য ভবন। ধারনা করা হয় কেবলমাত্র মন্দিরে ব্যবহৃত হত ইট বা পাথর এবং অনান্য স্থাপনা তৈরী হত কাঠ বা সহজে ধ্বংশযোগ্য উপকরন দিয়ে। এই রকম ধারনার কারন হল পাথরের মন্দির গুলোর আশে পাশে বাসভবন গুলোর ধ্বংশাবশেষ পাওয়া যায় নি। ৮৮০ খৃস্টাব্দে রলুসে নির্মিত হয় রাস্ট্রীয় মন্দির বাকং(Bakong) এবং পুর্বসুরী রাজাদের উদ্দেশ্য নিবেদিত মন্দির প্রিয়া কোহ(Preah Ko)। তার ও এক দশক পরে রলুসের উত্তর পশ্চিমে নম বাকেং পাহাড়ের পাদদেশে খনন করা হয় ৭ কিঃমিঃ×১.৮ কিমিঃ বৃহৎ জলাধার ইস্টার্ন বারে(Eastern Baray.)।

৯৬০ খৃস্টাব্দে রাজা রাজেন্দ্রবর্মন প্রি রুপে(Pre Rup) নির্মান করেন রাস্ট্রীয় মন্দির । তিনি জলাধার ইস্টার্ন বারে(Eastern Baray.) এর কেন্দ্রে কৃত্রিম দ্বীপের উপর নির্মান করেন অপর এক মন্দির নাম ইস্টার্ন মেবন(Eastern Mebon,) তার তৈরী অপর মন্দির হল আংকর থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরের বান্তেই শ্রেই( Banteay Srei) মন্দির।
রাজেন্দ্রবর্মনপূত্র জয়বর্মন-৫, ১০০০ খৃস্টাব্দের দিকে অপর এক রাস্ট্রীয় মন্দির নির্মান করেন তা কেভ(Ta Kev) এ।

পরবর্তী রাজা সূর্যবর্মন-১ নির্মান করেন রাস্ট্রীয় মন্দির ফিমিয়ানাকাস(Phimeanakas) তার অপর কীর্তি হল ৮কিঃ মিঃ ×২ .৫ কিঃ মিঃ মাপের জলাধার ওয়েস্টার্ন বারে(Western Baray)।
১০৫০ সালে উত্তরসূরী রাজারা নির্মান করেন রাস্ট্রীয় মন্দির “বাফুয়ন”
১১১৩ সালে রাজা সুর্যবর্মন-২ তৈরী করেন সর্বস্রেষ্ঠ খেমার মন্দির “আংকর ভাট” এই সময়ের অপর দুই মন্দির হল থোম্মানন( Thommanon) এবং চাউ ছে তেভোদা ( Chau Say Tevoda)।
১১৭৭ সালে “চাম” রা খেমার রাজ্য দখল করে নেয় এবং রাজধানী যশোধরপুর ধ্বংশ করে দেয়।
খেমার রাজা .জয়বর্মন -৭ চামদের পরাজিত করে আবার খেমার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি যশোধরপুরের উপর স্থাপন করেন নতুন রাজধানী আংকর থম (Angkor Thom)। তার সময় নির্মিত হয় রাস্ট্রীয় মন্দির “বায়ন” ( Bayon) । তার অপর দুই নির্মান হল বাবা মা’এর উদ্দেশ্য নির্মিত মন্দির তা প্রম ( Ta Prohm ) এবং প্রিয়া খান( Preah Khan )।
এরপর খেমার রাজাদের আর কোন উল্লেখযোগ্য স্থাপনা গড়ে ওঠেনি। ১২৯৬ সালে চাইনিজ পরিব্রাজক ঝাউ দুউগান খেমার রাজাদের বর্ননা লিপিবদ্ধ করেন। ১৪৩১ সালে থাইল্যান্ডের “আয়ুত্থায়া” বৌদ্ধরা খেমার রাজ্য দখল করে নেয়। আংকর পরিত্যাক্ত হয়। গাছপালা গজিয়ে ক্রমে ক্রমে বনভূমি গ্রাস করে নেয় আংকরকে। খেমার রাজ্য এবং আংকর হয়ে দাঁড়ায় রুপকথার মত। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মুখে হয়ত শোনা যেত জঙ্গলের মাঝে হারিয়ে যাওয়া মন্দিরের কথা। ক্রমে ক্রমে আংকর হয়ে দাঁড়ায় কিংবদন্তি। ইশ্বরের নিজের হাতের তৈরী জঙ্গলের ভেতরে মন্দিরের গল্প শোনা যেত বৌদ্ধ সন্যাসীদের কাছে। তিন শতাব্দী্র ও অধিক কাল লোক চক্ষুর অন্তরালে থাকে আংকর । অবশেষে ১৮৬০ সালে ফরাসী প্রত্নতত্ববিদ হেনরী মুহত (Henri Mouhot ) আবিস্কার করেন আংকরকে।

আংকর ভাট মন্দিরঃ- আংকর ভাট মন্দির পরিখা এবং বহির্দেওয়াল দিয়ে ঘেরা।বহির্দেওয়ালের মাপ হল ১৩০০×১৫০০ মিটার, মন্দিরের পরিসীমা ৫,৫০০ মিটার এবং শুধুমাত্র মন্দিরটি এক বর্গ কিলোমিটার যায়গার উপর স্থাপিত। পরিখার দৈর্ঘ্য ৩কিলোমিটার। মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে পাচটি স্থম্ভ বা টাওয়ার। চার দিকে চার স্তম্ভ এবং কেন্দ্রে একটি। হিন্দু দেবতা বিষ্ণু র উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় মন্দিরটি। হিন্দু ধর্মের সৃস্টিতত্বে্র “মেরু” পর্বত বোঝানো হয়ে থাকে এই স্তম্ভগুলো দিয়ে(মেরু পর্বতের ও পাঁচটী চুড়া আছে) কেন্দ্রস্থলের স্তম্ভের উচ্চতা ৬৫ মিটার। মন্দিরটি পাথরের তৈরী । এর দেওয়ালের চার পাশ ঘিরে বাইরে এবং ভিতরে রয়েছে পাথরে খোদাই করা দেব দেবতা এবং সমকালীন রাজা, যুদ্ধ এবং সমাজ জীবনের চিত্র। ২০০০ অপ্সরা খোদাই করা আছে এখানে।আছে রামায়ন, মহাভারতের কাহীনির চিত্র, অনান্য হিন্দু পোউরানিক উপাখ্যান যেমন দেবতা এবং রাক্ষসদের সমুদ্র মন্থনের চিত্র। খেমারদের মন্দিরগুলো পূবদিকমুখী হলেও মন্দিরটি পশ্চিমদিকে মুখ করা যা অনান্য মন্দির থেকে পৃথক। ধারনা করা হয় নির্মাতা রাজা সুর্যবর্মন-২ মন্দিরকে তার চিতাস্থল হিসেবে গড়ে তুলতে চাওয়ার কারনেই এর মুখ পশ্চিমদিকে ফেরানো।১১৫০খৃস্টাব্দে রাজা সুর্য্যবর্মনের মৃত্যুর সময়ও মন্দিরটি অসম্পূর্ন ছি্ল। মোট তিন স্তরে মন্দিরের কক্ষগুলো। মন্দিরের কেন্দ্রীয় কক্ষে আছে চারপাশে চারটি বৌদ্ধ মূর্তি। চতুর্দশ শতাব্দীতে ক্যাম্বোডিয়া্তে যখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে তখন থেকে এই মন্দিরটি বৌদ্ধদের উপাসনা স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।



মন্দিরে পাথরে খোদাই করা অপ্সরার মূর্তি


আঙ্কর ভাট ক্যাম্বোডিয়ার প্রতীক। ক্যাম্বোডিয়া দেশের পতাকায় অঙ্কিত থাকে আংকর ভাট। ২০১০ সালে প্রায় ২০ লক্ষ পর্যটক ভ্রমন করেছেন আংকর।

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৮:২১
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×