somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাইমন বলিভার(Simon Bolivar)

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১২ ভোর ৬:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যদি প্রশ্ন করা হয় পৃথিবীর কোন রাস্ট্রনায়ক ছয় ছয় টি দেশের রাস্ট্রপ্রধান ছিলেন অনেকে ঘাবড়ে যাবেন। মাথা চুলকে প্রশ্ন করবেন তাও কি সম্ভব? হ্যাঁ, এমনটি ঘটেছিল যে রাস্ট্রনায়কের ক্ষেত্রে তিনি হলেন সাইমন বলিভার। স্প্যানিশ ভাষাভাষী ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তি সংগ্রামী সাইমন বলিভার উপনিবেশবাদী স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ভেনিজুয়েলা,পেরু,পানামা, কলম্বিয়া, বলিভিয়া এবং ইকুয়েডর এই ছয় ছয়টি দেশে স্বাধীনতা এবং গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ল্যাটিন আমেরিকার এই অবিসংগবাদিত নেতা, স্বপ্ন দেখতেন আমেরিকার এই দেশগুলো হবে পৃথিবীর সম্মুখের কাতারের। তার জীবন কাহিনী রুপকথাকেও হারা মানায়। আমাদের দেশে স্বল্প পরিচিত হলেও ল্যাটিন আমেরিকাতে তিনি দেবতার মতই পূজনীয়।
১৭৮৩ সালের ২৪শে জুলাই ভেনিজুয়েলায় জন্ম নেন। বাবা ছিলেন তৎকালীন স্পেনের উপনিবেশ ভেনিজুয়েলার সেনবাহিনীর একজন কর্নেল। উচ্চবিত্ত বলিভার পরিবারের ছিল নিজস্ব জমিদারী এবং খনি। মাত্র ৩ বছর বয়সে বাবাকে হারান আর ৯ বছর বয়সে মাকে। বড় হন চাচার কাছে। গৃহশিক্ষক সাইমন রড্রিগুয়েজের কাছে বালক বয়সেই শোনেন ফরাসী বিপ্লব, রুশো ভল্টেয়ারের কথা। হাতে খড়ি হয় বিপ্লবের।

১৪ বছর বয়সে মিলিশিয়াতে যোগ দেন এবং ১ বছরের মধ্যে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন।১৬ বছর বয়সে স্পেন যান উচ্চশিক্ষার জন্য। পথে তার জাহাজ থামে ভেরা ক্রুজে। সেখানে স্পেনের ভাইস রয়ের সভায় অনেকটা ঔধ্যত্বপূর্নভাবে প্রশংসা করেন ফরাসী বিপ্লব এবং আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের।স্পেন কর্তৃপক্ষ সন্দেহ পোষন করা শুরু করে বলিভার সম্পর্কে । ১৮০২ সালে বিয়ে করেন মারিয়া তেরেসাকে, ফিরে আসেন কারাকাসে। কিন্তু ১বছরের মাথায় ইয়েলো ফিভারে স্ত্রী মারিয়া মারা যান। আবার ইউরোপে ফিরে নিজেকে ডুবিয়ে রাখেন ইউরোপের জ্ঞান আহরনে। প্যারিসে দেখা হয় ফরাসী প্রকৃতি বিজ্ঞানী হুমবোল্ডটের সাথে। হুমবোল্ডট বলিভারকে ল্যাটিন আমেরিকার অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের উল্লেখ করে বলেন “ তোমার দেশ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত কিন্তু আমি এমন কাউকে দেখতে পাচ্ছি না যে নেতৃত্ব দেবে এই সংগ্রামের।প্রত্যুত্তরে বলিভার বলেন “ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। এই দেশ যদি উপনিবেশিকতার কবল থেকে মুক্ত হতে পারতো”
১৮০৪ সালে ডিসেম্বরে প্যারিসে সম্রাট নেপোলিয়ানের অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ফরাসী বিপ্লবের করুন পরিনতিতে ব্যাথিত হন। নেপোলিয়ানকে দেখে উজ্জীবিত হন কিভাবে একজন মানুষ ইতিহাসের গতিধারাকে পাল্টাতে পারে। ইউরোপে দেখা হল প্রাক্তন গৃহ শিক্ষক রড্রিগুয়েজের সাথে। রড্রিগুইয়েজের সাথে তার সম্পর্ক টিকে ছিল আজীবন। প্রিয় শিক্ষককে পেয়ে তারা গেলেন রোম। রোমের এভেন্টিন পাহাড় বিবেচিত হত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির প্রতীক হিসেবে । এই পাহাড়ের পাদ দেশে নতজানু হয়ে বসে ২২ বছরের যুবক বলিভাসার শিক্ষকের হাতে হাত রেখে শপথ নিলেন স্বদেশকে স্পেনের শাসন থেকে মুক্ত করবেন তিনি। ১৮০৭ সালে ফিরে এলেন দেশে। তখন ভেনিজুয়েলাতে মিরিন্ডা প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্বাধীনতার।।বলিভারকে বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে পাঠান হল লন্ডনে সম্ভাব্য ফরাসী আক্রমনের মুখে বৃটিশ সহায়তার আশায়। বৃটিশদের কাছ থেকে নিরপেক্ষতার আশ্বাস ছাড়া অন্য কোন সহযোগিতা না পেয়ে ভেনিজুয়েলা ফিরে যান। এর পর আর ইউরোপে আসেন নি বলিভার। এই সময় তার প্রতিকৃতি আঁকা হয় । তার মেডালে তখন লেখা ছিল “স্বাধীনতা ছাড়া কারো পিতৃভূমি বলে কিছু থাকতে পারে না”
ঐ সময় স্প্যানিশ ভাষাভাষি দক্ষিন আমেরিকায় শুরু হল গৃহযুদ্ধ। একদল স্পেনের পক্ষে যারা রয়ালিস্ট, আরেক দল বিপ্লবী স্বাধীনতার পক্ষে। ১৪ বছর ধরে চলে এই যুদ্ধ তাতে বিজয় কখনো রয়ালিস্ট আবার কখনো বিপ্লবীদের পক্ষে।
১৯শে এপ্রিল ১৮১০ সালে ভেনিজুয়েলার বিপ্লবীরা স্বাধীনতা ঘোষনা করে। ১৮১১ সালের ন্যাশানাল কংগ্রেসে উন্মুক্ত সভায় বলিভার তার প্রথম বক্তৃতা করেন।তিনি ঘোষনা করেন “ আসুন আমরা সবাই মিলে আমেরিকার স্বাধীনতার ভিত্তি গড়ে তুলি, ইতস্তত করলে তা ধ্বংশই ডেকে আনবে। ভেনিজুয়েলা হল প্রথম দেশ যারা স্প্যানিশ উপনিবেশবাদীদের শৃংখল ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। ১৮১১ তে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে কর্নেল পদমর্য্যাদায় উন্নীত হন বলিভার। এই সময় তিনি তার অধীনস্ত দাস দের মুক্ত করে দেন এবং সমগ্র পশ্চিম গোলার্ধে দা্সপ্রথা বিলুপ্তির আহবান জানান। ১৯শে জুলাই রয়ালিস্টদের শক্ত দুর্গ ভ্যালেন্সিয়া আক্রমন করেন বলিভার কিন্তু বিপুল ক্ষয় ক্ষতির পর সন্ধি করতে বাধ্য হন। অপর বিপ্লবী নেতা মিরিন্ডা’র সাথে তার পার্থক্য গড়ে উঠতে থাকে। ২৬শে মার্চ ১৮১২ সালের ভূমিকম্পে ১০,০০০ লোক প্রান হারালো বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রনাধীন এলাকায়। স্প্যানিশদের অনূগতদের নিয়ন্ত্রনাধীন এলাকা থাকল অপেক্ষাকৃত কম খতিগ্রস্থ। এই সুযোগে স্প্যানিশ কমান্ডার ডোমিংগো আক্রমন করল বিপ্লবীদের। বলিভার মিরিন্ডার কাছ থেকে কোন সহায়তা পেলেন না।
বলিভার তখন বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রনাধীণ বন্দর নগরী “পুয়ের্টো কাবেলোর দায়িত্বে ছিলেন। সেখানের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কোনমতে প্রান নিয়ে পালালেন বলিভার। স্প্যানিশরা দখল করে নিল পুরো দেশ। পালিয়ে গেলেন নিউ গ্রানাডার কার্টাগানাতে।নিউ গ্রানাডা হল এখনকার দিনের কলম্বিয়া, পানামা,এবং ভেনিজুয়েলার কিছু অংশ নিয়ে। কার্টাগানাতে স্বাধিনতার ম্যানিফেস্টো লেখেন বলিভার। বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রনাধীন এলাকা থেকে ২০০জনের ক্ষুদ্র সেনাদল নিয়ে ভেনিজুয়েলার দিকে অগ্রসর হলেন। এক এর পর এক সাফল্যে বাড়তে থাকল তার সেনা দলের সংখ্যা। ১৮১৩ সালে ৬৫০জনের সেনাদল নিয়ে ৪০০০ স্প্যানিশ সেনাদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ন হয়ে জয়লাভ করেন বলিভার।ক্ষিপ্রগতি এবং আকস্মিক আক্রমনের মধ্য দিয়ে বড় বিজয় পান টাগুয়ানার যুদ্ধে। ভেনিজুয়েলার অর্ধেকের বেশী এলাকা তখনও স্প্যানিশদের দখলে। তিনি খেতাব পেলেন El Libertador. (The liberator) বা মুক্তি দাতা।
এবার ও তার জয় দীর্ঘস্থায়ী হল না । বাধ্য হয়ে পালালেন জ্যামাইকা এবং পরে হাইতিতে। জ্যামাইকা থেকে তিনি লেখেন তার বিখ্যাত চিঠি যার নাম “লেটার ফ্রম জ্যামাইকা” ১৮১৬ সালে মিরিন্ডার মৃত্যুর পর হাইতি থেকে অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে ১৮১৭ সালে ফিরে এলেন ভেনিজুয়েলা তে। ৭ই আগস্ট ১৮১৯ সালে বয়াসা’র যুদ্ধে বড় সাফল্য পেলেন সাইমন বলিভার।আঙ্গস্তুরা কংগ্রেসে আজকার দিনের কলম্বিয়া, পানামা এবং ভেনিজুয়েলা নিয়ে গঠিত হল “গ্রান-কলম্বিয়া” তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিলেন বলিভার। ক্ষমতা সুসঙ্ঘত করে বাকী স্প্যানিশ উপনিবেশ গুলোর স্বাধীনতার দিকে নজর দিলেন বলিভার। ১৮২৩ সালের মে মাসে বলিভারের সেনাপতি আন্তোনিও হোসে দি সুক স্প্যানিশদের পরাজিত করার ফলে দক্ষিন আমেরিকা মহাদেশের উত্তরাংশ মুক্ত হল। বলিভার নজর দিলেন দক্ষিন দিকে। ১৮২৪ সালের স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুক্ত করলেন পেরুর উত্তরাংশ যা ১৮২৫ সালে বলিভারের নাম অনুসারে নাম পেল বলিভিয়া।
বলিভারের স্বপ্ন ছিল একীভূত দক্ষিন আমেরিকা গড়ার, কিন্তু তা হয় নি। বলিভার ছিলেন একনায়ক। তার জীবদ্দশাতেই বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ শুরু হয়। যক্ষাতে আক্রান্ত ভগ্নহৃদয় বলিভার রাজনীতি থেকে অবসর নেন ১৮২৮ সালে। তিনি যে অভিন্ন দক্ষিন আমেরিকার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা সফল হয় নি। গ্রান কলম্বিয়ার ৪ টে দেশ আলাদ হয়ে যায়, সর্বপ্রথম ভেনিজুয়েলা এবং সর্বশেষ পানামা স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯০৩ সালে। ১৮৩৯ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মারা যান বলিভার। তার সম্মানে ভেনিজুয়েলার সরকারী নাম এখন বলিভারিয়ান রিপাবলিক অফ ভেনিজুয়েলা, দেশের মুদ্রার নাম বলিভার।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১২ ভোর ৬:০৫
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×