হযরত মোজহেদ (রহঃ) বলেন, ছাহাবাদের মধ্যে যাহারা ফকীহ ছিলেন তাহারা নামাযে দাড়াইলে আল্লাহর ভয়ে ভীত হইয়া পড়িতেন ।
হযরত হাসান (রহঃ) যখন অযু করিতেন, তখন তাহার চেহারা বিবর্ণ হইয়া যাইত । জনৈক ব্যাক্তি ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলেন, এক জবরদস্ত বাদশাহর দরবারে হাজির হইবার সময় হইয়াছে ।
হযরত জয়নুল আবেদীন (রহঃ) দৈনিক এক হাজার রাকাত নামাজ পড়িতেন । অজুর সময় তাহার চেহারা হলুদ বর্ণ হইয়া যাইত এবং নামাযে দাড়াইলে সবার্ঙ্গে কম্পন আসিয়া যাইত । জনৈক ব্যাক্তি ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে বলিলেন, তুমি কি জান না কার সম্মুখে দন্ডায়মান হইয়াছি ?
হযরত আলী (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, যখন নামাজের সময় হইত, তাহার চেহারা বিবর্ণ হইয়া যাইত । শরীরে কম্পন আসিয়া যাইত । কেহ জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলেন, যে আমানত বহনে আসমান-জমিন পাহাড় পর্বত সকলেই অস্বীকার করিয়াছিলো , তাহা আদায় করার সময় উপস্হিত । জানিনা কতটুকু হক আদায় করিতে পারি ।
হযরত ওয়ায়েছ করণী (রহঃ) বিখ্যাত বুযুর্গ ও তাবেয়ী ছিলেন। কোন কোন সময় সারা রাত্রি রুকুর হালতে আবার কোন কোন সময় সেজদার অবস্হায় কাটাইয়া দিতেন ।
হযরত ছায়ীদ বিন মোছাই্যব (রহঃ) বলেন, বিশ বৎসর যাবত আমি আজানের পূর্বে মসজিদে হাজির হই । একদিনও ইহার ব্যাতিক্রম হয় নাই ।
আম্মাজান হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমরা হুজুর (সাঃ) এর সাথে পরস্পর কথা বলিতাম । কিন্তু যখন নামাজের সময় হত তখন মনে হইত তিনি আমাদের চিনেন না এবং আপাদমস্তক আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হইয়া যাইতেন ।
এবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, প্রথম প্রথম হুজুর (সাঃ) যখন রাত্রে নামাজ পড়িতে উঠিতেন তখন নিদ্রায় পড়িয়া যাইবেন এই ভয়ে নিজেকে রশি দিয়া বাধিয়া লইতেন । ইহার পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয় কোরআনের আয়াতঃ
' হে প্রিয় নবী ! আপনি অতি মাত্রায় কষ্ট করিবেন এই জন্য আমি আপনার উপর কুরআন নাজেল করি নাই ।'
অনেক হাদিসে দেখা যায় হুজুর (সাঃ) এত লম্বা কেরাত পড়িতেন যে, দাড়াইয়া থাকিতে থাকিতে হুজুরের পা মোবারক ফুলিয়া যাইত । কিন্তু আমাদের জন্য দয়া পরবশ হইয়া বলিয়াছেন, সহ্যের বাহিরে তোমরা কষ্ট করিও না ।
বাহজাতুনুফুছ গ্রন্হে উল্লেখ আছে, জনৈক সাহাবী রাত্রিবেলায় নামায পড়িতেছিলেন । ইত্যবসরে একটি চোর আসিয়া তাহার ঘোড়া লইয়া গেল । যাওয়ার বেলায় চোরের উপর তাহার দৃষ্টি পড়িল । কিন্তু তিনি নামায ছাড়িলেন না । কেহ জিজ্ঞাসা করিল, চোরকে আপনি কেন ধরিলেন না ? উত্তর করিলেন, আমি যে কাজে মশগুল ছিলাম উহা ঘোড়া হইতে অনেক উত্তম ।
হযরত আলী (রাঃ) এর ঘটনা সর্বজন বিদিত যে, যুদ্ধের ময়দানে তাহার শরীরে কোন তীর বিদ্ধ হইলে , নামাজের হালতেই উহা বাহির করা যাইত । একবার উনার উরুতে একটি তীর বিদ্ধ হইয়াছিলো । অনেক চেষ্টার পরও যখন উহা বাহির হইল না , তখন সকলেই পরামর্শ দিলেন নামাযের হালতেই বাহির করা যাইবে । পরে যখন তিনি যখন নামাজে দাড়াইলেন তখন সকলেই উহা বাহির করিয়া ফেলিল । নামাজের পর আশেপাশে তিনি লোকজন দেখিয়া বলিলেন, তোমরা কি তীর বাহির করিতে আসিয়াছ ? তদুত্তরে সকলেই বলিল, আমরা তো উহা বাহির করিয়া ফেলিয়াছি । তিনি বলিলেন, আমি তো টেরই পাইলাম না ।
জনৈক বুযুর্গকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিলো , নামাযের মধ্যে কি কখনও আপনার দুনিয়ার চিন্তা আসে ? তিনি উত্তর করিলেন, নামাজ তো দূরের কথা নামাজের বাহিরেও আসে না । এইরূপ প্রশ্নের উত্তরে অন্য বুযুর্গ বলিয়াছেন, নামাজের চেয়ে প্রিয় কোন জিনিষ-ই নাই , যাহা নামাজের মধ্যে স্বরণ আসিতে পারে । মহান আল্লাহপাক বলেন,
'যাহারা অধার্মিক তাহাদের সহিত কি ঐসব লোকের তুলনা হইতে পারে , যাহারা রাত্রি বেলায় কখনো সিজদায় পড়িয়া আবার কখনো দাড়ানো অবস্হায় আল্লাহর ইবাদত করে ? আখেরাতকে ভয় করে এবং আপন প্রভূর রহমতের আশা রাখে । আপনি তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করুন যে, কখনও আলেম এবং জাহেল (মূর্খ) বরাবর (সমান) হইতে পারে ?একমাত্র বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাই উপদেশ গ্রহণ করে ।'
মহানবী (সাঃ) বলিয়াছেন,
'কেয়ামতের দিবসে সর্বাগ্রে নামাযের হিসাব লওয়া হইবে । যদি উহা ঠিক সাব্যস্ত হয় তবে বাকী আমলও ঠিক বলিয়া প্রমাণিত হইবে ।আর নামায ক্রটিপূর্ণ হইলে অবশিষ্ট আমলও ক্রটিপূর্ণ হইবে ।' (তিবরানী)
মহানবী (সাঃ) বলিয়াছেন, যাহাকে নামায নির্লজ্জ্ব অন্যায় কাজ হইতে বিরত রাখে না, তাহার নামাজ নামাজ-ই না ।
নিশ্চয়ই নামাজ এমন এক দৈালত, যদি ঠিক ভাবে উহা আদায় করা হয় তবে তাহা মন্দ কাজ হইতে বিরত রাখবেই । যদি কোথাও উহার ব্যাতিক্রম দেখা যায় তবে বুঝিতে হইবে নামায অসম্পূর্ণ রহিয়াছে ।
এখন আমাদের অবস্হা এমন যে, আমরা বুযুর্গদের এইরূপ মনোযোগ সহকারে নামাজ পড়ার বিষয়কে সত্য কিনা সন্দেহ পোষণ করি । অথচ এই আমারাই সিনেমা দেখিতে বসিলে এতই মজিয়া যাই যে আর কোন কিছুর-ই খেয়াল থাকেনা । বিন্দুমাত্র ক্লান্তিও আসে না । অথচ নামাজ কোনমতে তাড়াহুড়া সহকারে আদায় করি । এর কারণ হলো আমরা নামাযের কি গুরুত্ব তা অনুধাবন করি না ।
সর্বশেষে বলা যায়, আল্লাহর সাথে কোথোপকথনের করার নামই নামায । কাজেই উহা অন্যমনস্ক অবস্হায় হইতেই পারেনা । আপন সাধ্যানুযায়ী পূর্ণ মনোযোগের সহিত নামাজ পড়া নিতান্ত প্রয়োজন ।
সূত্রঃ ফাজায়েলে নামাজ ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৫:৩৯