অলৌকিক
যোগাযোগ
রচনা ও চিত্রনাট্য: প্লাবন ইমদাদ
কুশীলব
অঞ্জন, রনি, আদনান, মিতুল, শান্তা ভার্সিটির স্টুডেন্ট (২৬/২৭)
বড়কর্তা ওয়াব্দা অফিসের কর্মর্তা(৫০/৫৫)
তিতাস ইলেক্ট্রিশিয়ান(৪৮/৫০)
দৃশ্য-১
হাইওয়ে ধরে একটা মাইক্রোবাস চলছে। পাচজন যুবক যুবতী নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তাদের মধ্যে তিনজন ছেলে আর দু’জন মেয়ে। ছেলেদের মধ্যে রনি ড্রাইভ করছে। সামনের সিটে রনির পাশে মিতুল বসা। পেছনে অঞ্জন, আদনান আর শান্তা।
রনি: যে যাই বলুক, ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং ই মনে হচ্ছে।
শান্তা: আমি খুব, খুব এক্সাইটিং ফিল করছি।
আদনান: (তাচ্ছিল্ল ভরে) হ্যা, এক্সাইটিং, ইন্টারেস্টিং কত কিছু ফিল করবা। নদীর ধারে পরিত্যাক্ত কোয়ার্টার, একটু দূরেই শ্মশাণঘাট। ভোররাতে অচেনা মানুষদের কথপোকথন। দারুণ ইন্টারেস্টিং।
মিতুল: উফ, এমন গা কাটা দেয়া কথা বলিসনা তো্। কোথায় একটু মজা করব, তা না, উনি দিচ্ছেন ভয় ঢুকিয়ে।
আদনান: যা সত্যি তাই বলছি। ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট।
অঞ্জন: এ্যাই, এ্যাই, ফ্যাক্ট এর মানে বুঝিস? ফ্যাক্টকে তো তুই অতিপ্রাকৃত ব্যাপার বানিয়ে তুলছিস। নিজেও ভয় পাচ্ছিস আর অন্যদের মনোবলও নষ্ট করে দিচ্ছিস।
শান্তা: নে, আমার হাত থেকে কয়টা চুড়ি পরে নে। শালা ভীতুর ডিম কোথাকার।
আদনান: দেখব তো কে চুড়ি পরে আর কে বগল বাজায়। শেষ পর্যন্ত এ পুরুষালী ধরে রেখো হে তনয়া সাহসিকা, বীরাঙ্গনা আমার।
রনি: উফ, দয়া করে তোরা চুপ করবি একটু?
মিতুল: চল তো সবাই গান ধরি একটা।
(সবাই)আবার এল যে সন্ধ্যা শুধু দু’জনের,
চলনা ঘুরে আসি অজানাতে,
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে।
(গাড়ীটা হাইওয়ে ধরে চলতে থাকে)
দৃশ্য-২
একটা আবাসিক হোটেলের সামনে মাইক্রোবাসটা এসে থামে। সবাই নেমে লাগেজ নিয়ে ভেতরে ঢুকে।
দৃশ্য-৩
স্থান: হোটেল কক্ষ
সময়: দুপুর
(ওরা পাচজন গোল হয়ে বসে পরামর্শরত)
অঞ্জন: এখন আমাদের প্রথম কাজ হল পরিত্যাক্ত কোয়ার্টারটা দিন থাকতেই একপাক দেখে আসা এবং সম্ভব হলে আজই কর্তৃপক্ষের পারমিশান নেয়া।
আদনান: কিসের পারমিশান?
অঞ্জন: কেন, রাতে থাকার।
আদনান: কি বলছিস এসব? কিছু না জেনে, খবরাখবর যোগাড় না করে হুট করে একটা পরিত্যাক্ত বিল্ডিংয়ে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি?
রনি: হ্যা, ও ঠিকই বলেছে। আমাদের আগে ভালমত খোঁজখবর নেয়া উচিত।
অঞ্জন: উফ, আমি কি বলেছি নাকি যে খোজখবর নেবনা? যেহেতু এই মফস্সল এলাকায় আমরা আনলিমিটেড টাইম নিয়ে আসিনি, তাই অফিস টাইম থাকতেই ওখানকার কর্মকর্তার সাথে দেখা করে প্রশাসনিক ঝামেলাটা সেরে ফেলব। তারপর দেখা করব ঐ ফ্ল্যাটে যে ফ্যামিলি থাকত সেই ফ্যামিলি থাকত সেই ফ্যামিলির বড় ছেলের সাথে।
আদনান+রনি: বড় ছেলে!
অঞ্জন: আমাকে তোরা গবেট ভাবছিস? আমি আগেই খোজখবর যা নেয়ার নিয়ে এসেছি। এখন তাকে শুধু খুজে বের করা। একমাত্র তার কাছেই সব’চে অথেনটিক ইনফরমেশন পাওয়া যাবে।
শান্তা: উনাকে আমরা পাব কিভাবে?
অঞ্জন: যতদূর জানা গেছে সে এই শহরেই থাকে। পেশায় ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি। সবাই তিতাস মেকার নামে চিনে। আগে চল অফিসিয়াল ফরমালিটিটা সেরে নিই। তারপর তিতাস মেকার।
দৃশ্য- ৪
স্থান: জেলা ওয়াব্দা অফিস
সময়: দুপুর
(ওয়াব্দার বড়কর্তা চেয়ারে বসে পেপারওয়েট ঘুরাচ্ছেন আর কথা বলছেন)
বড়কর্তা: তা আপনারা ঢাকা ভার্সিটিতে কোন সাবজেক্টে পড়েন?
অঞ্জন: সাইকোলজিতে।
বড়কর্তা: ও । সাইকোলজি মানে তো জোতিষবিদ্যা, তাইনা? ভাল। খুব চিন্তাভাবনার সাবজেক্ট।
রনি: এক্সকিউজ মি। সাইকোলজি মানে মনোবিঞ্জান।
বড়কর্তা: ঐ হল। যেই লাউ সেই কদু। তারপর বলেন, আপনাদের জন্য কি করতে পারি?
অঞ্জন: আমরা আসলে প্যারাসাইকোলজি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করছি।
বড়কর্তা: কী সাইকোলজি বললেন?
অঞ্জন: প্যারাসাইকোলজি। এটা হল জগতের অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে গবেষণা। যেসব বিষয়কে সাধারণ দৃষ্টিতে রহস্যময় মনে হয় সেগুলোকে বিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করে মুল রহস্য উৎঘাটন করাই হল এ সাবজেক্টের উদ্দ্যেশ্য।
বড়কর্তা: কিচু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। জিন ভুতের ব্যাপারে আপনাদের আগ্রহ কেমন?
আদনান: আসলে আমার মনে হয় কি জানেন, ভৌতিক ব্যাপারগুলোতে………..
অঞ্জন: (আদনানের কাছ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে) অন্য একদিন সময় করে বসে এ ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলা যাবে। এবার আমাদেরকে একটু হেল্প করেন।
বড়কর্তা: বলুন কি করতে পারি।
অঞ্জন: আমরা শুনেছি এই ওয়াব্দার কোয়ার্টারে নাকি একটা ফ্ল্যাট প্রায় তিরিম বছর ধরে একটা রহস্যময় কারনে খালি পড়ে আছে? যেটাতে ফজল মিয়া নামের এক কর্মচারী থাকতেন।
বড়কর্তা: (একটু ঘাবড়ে যান) ইয়ে মানে। এতবছর পর কি দরকার এসব নিয়ে মাথা ঘামানেরা? জগতে জিন ভূত প্রেতের কি অভাব আছে? ফজল মিয়ার পর আর কোন পরিবারই এক/ দুই রাতের বেশী ঐ ফ্ল্যাটে টিকতে পারেনি। আমরাও আর মাথা ঘামাইনি ব্যাপারটা নিয়ে।
অঞ্জন: তাহলে এবার আমরা দেখি দু’য়েকটা রাত টিকতে পারি কিনা।
বড়কর্তা: বিপদ তো আর বলে কয়ে আসেনা। অন্ধকার রাইত, তার উপর সাথে দুই দুইটা মেয়ে মানুষ।বাদ দ্যান তো ভাই।
শান্তা: আমরা যথেষ্ট প্রোটেকশন নিয়েই এসেছি। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
রনি: আমাদের রিস্ক আমরা নিচ্ছি।
বড়কর্তা: তারপরও…. যদি একটা বিপদ ঘটেই যায়।
(সবাই বুঝাতে থাকে। কেবল ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজে। একসময় ম্যানেজ হয়।)
বড়কর্তা: আচ্ছা এত করে যখন বলছেন…. ঠিক আছে। দেখি আপনারা কি রহস্য উৎঘাটন করেন।
সবাই: থ্যাংক ইউ….. থ্যাংক ইউ…..
দৃশ্য-৫
স্থান: রাস্তার মোড়
সময়: দুপুর
(ওরা পাঁচজন মাইক্রোবাসের সামনে দাড়িয়ে আছে)
অঞ্জন: এখন আমাদের কাজ হল তিতাস মেকারকে খুজে বের করা।
রনি: ওকে।
(সবাই মাইক্রোবাসে ওঠে)
দৃশ্য-৬
খন্ড খন্ড দৃশ্যাবলিতে তিতাস মেকারকে খুজতে থাকা দেখানো হবে।
খন্ড দৃশ্য-১: মহল্লার একটা দোকানে অঞ্জন জিজ্ঞাসা করছে। দোকানদার মাথা নেড়ে না সূচক মাথা নাড়ে।
খন্ড দৃশ্য-২: একজন পথচারি মিতুলকে হাতের ইশারায় তিতাসের বাড়ীর দিক নির্দেশ করে।
খন্ড দৃশ্য-৩: একটা সরু গলির মুখে এসে গাড়ী থামিয়ে সবাই নামে। লোকজনের নির্দেশনা অনুযায়ী গলির ধরে হাটা ধরে।
খন্ড দৃশ্য-৪: একটা গেইট এ এসে সবাই সবার দিকে তাকায়। তারপর একজন নক করে।
ভেতর থেকে তিতাস মেকার বের হয়ে আসে।
তিতাস: (সবার দিকে তাকিয়ে) আসসালামুআলাইকুম। আফনেরা?
অঞ্জন: আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। সবাই ভার্সিটির স্টুডেন্ট। আপনি কি তিতাস সাহেব?
তিতাস: (ঈষৎ লজ্জিত হয়ে) আমিই তিতসা, তবে সাহেব টাহের না।
মিতুল: আপনাকে আমরা অনেক্ষন ধরে খুজছি।
রনি: আমরা কি একটু ভেতরে বসে কথা বলতে পারি?
তিতাস: কি যে বলেন। আসেন আসেন।ভিতরে আসেন।(সবাই তিতাসের পেছন পেছন
তিতাসের বাড়ীর ভেতরে ঢুকে)
তিতাস: জলিল, খলিল, বহনের চিয়ার নিয়া আস।(সাথে সাথে দুই পিচ্চির কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে আসে। চেয়ার রেখে সবাইকে পিচ্চি দুইটা সালাম দেয়।
তিতাস: বড়টা মোহম্মদ জলিল আর ছোটটা মোহম্মদ খলিল। আমার দুই রাজপুত্র। যাও তোমরা ঘরে যাও। এইবার বলেন।
রনি: আমরা এখানে একটা জরুরি কাজে এসেছি। এতে আপনার একটু সাহায্য দরকার।
তিতসি: কী যে বলেন। গরিবরে আদেশ দ্যান। সাইধ্যমত চেষ্টা করমু।
অঞ্জন: হুম। গুডবয়।
তিতাস: কী?
অঞ্জন: না কিছু না। এবার মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আপনার বাবা ফজল মিয়ার মৃত্যু এবং পরবর্তীতে আপনাদের ছেড়ে দেয়া ফ্ল্যাটে রহস্যজনক ঘটনা ঘটার ব্যাপারটার উপর আমরা একটা এসাইনমেন্ট করতে এসেছি।
তিতাস: (চট করে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভারি গলায় বলে।) আপনারা যে গোয়েন্দা পুলিশের লোক হেইড আগে কইলেই পারতেন। তা এতবছর পর আবার কি জন্যে এইসব ঘাটতে আইছেন?
আদনান: না, না, আমরা পুলিশের লোক না। ভার্সিটির স্টুডেন্ট।
শান্তা: এই যে আমাদের আইডেন্টিটি কার্ড।
তিতাস: (আইডি কার্ডটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে) তা ঠিক আছে। কিন্তু ভার্সিটির ছাত্র হইয়া এইসব ব্যাপার নিয়া টানাটানি করতাছেন কি জন্যে।
অঞ্জন: আমরা আসলে আপনাদের ফ্যামিলির কোর ইস্যু বা আপনার বাবার মৃত্যু নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছি না।
মিতুল: আমাদের আগ্রহের জায়গাটা হল পরবর্তীতে ঐ ফ্ল্যাটে ঘটে যাওয়া রহস্যজনক ব্যাপারটা নিয়ে।
(এবার তিতাসের ভীত-রাগান্বিত মুখটায় একটা কৌতুহল তৈরী হয়। সে কৌতুহল ভরা চোখে তাকায়। এবার সবাই ভালমতো বুঝাতে থাকে।পুরো সময়টায় আবহসংগীত বাজে। একটা সময় সে বশে আসে।)
তিতাস: তাইলে খুইলাই বলি কাহিনি। তখন আমার বয়স চব্বিশ কি পচিশ। তিন তিনডা বিবাহযোগ্য কন্যা আর এক বেকার ছেলের সংসারের বোঝা আমার বাপের ঘাড়ে। ওয়াব্দার ইলেক্ট্রিশিয়ানের আর কামাই বা কয় পয়সা।এমন দুর্দিনে যুক্ত হয় আরেক ঝামেলা। বাবার সাথের কয়েকজন লাইনম্যান ট্রান্সমিটার চুরি করতে গিয়া ধরা খায়। ধরা পড়ার পর আমার বাবারে সহ ফাসাইয়া দেয়।থানা-পুলিশ হয়। একদিকে অভাব অন্যদিকে মিথ্যা অপবাদ। হেইদিন চৈত্র মাসের খা খা জোসনা।বাবা আবার ভাল বাশি বাজাইত।মাঝ রাইতে বাবা ছাদে গিয়া মন ভইরা বাঁশি বাজাইতে থাকে। আমি হুনতাছি আর লোকটার জন্যে আফসোস করতাছি। হঠাৎ বাশি বন্ধ অইয়া যায়। তার পরে পরেই বিল্ডিংয়ের পিছন দিকে ধুপ কইরা একটা শব্দ।দৌড়াইয়া গিয়া দেহি বাপজানের লাশ নিচে পইড়া আছে।
রনি: এরপর আপনারা কী করলেন?
তিতাস: কী আর করার। সংসারের দায়িত্ত্ব পড়ল আমার উপর। বিরাট দায়িত্ত্ব মাথায় নিয়া রাস্তায় নামলাম।
অঞ্জন: এরপর ঐ ফ্ল্যাটে রহস্যজনক ঘটনাটা কী ঘটে?
তিতাস: আমরা কোয়ার্টার ছাইড়া দেওনের পর হেইখানে উঠে আরেক ফ্যামিলি।পরের ঘটনা সব তাগোর কাছেই শুনা।
শান্তা: ঘটনাটা একটু খুলে বলেন প্লিজ।
তিতাস: নতুন যে পরিবারটা উঠে তারা একটু ভয়েই ছিল। কারন একটা মানুষের অপমৃত্যু যে ফ্ল্যাটে হইছে, হেই ফ্ল্যাটে নানান কিছুই ঘটতে পারে। রাইত গেল। ভোরবেলা ঘটলো সেইরকম এক কাহিনি। পরিবারের কর্তা রইসুদ্দীনের ঘুম ভাঙে ভোর রাইতে ফজরের ওয়াক্তের আগে। অজু করতে আইসা সে শুনতে থাকে এক আজব শব্দ। সে নাকি হুবুহু আমাদের পরিবারের লোকজনের কথাবার্তা শুনতে থাকে।
ফ্ল্যাশব্যাক শুরু: আবছা আলোয় রইসুদ্দীন বসে অজু করতে করতে হঠাৎ তিতসিদের পরিবারের কথপোকথন শুনতে থাকে।
শব্দ: ফজল মিয়া--- কই, তাড়াতাড়ি চা দেও।
তিতাস--- ফরিদা, অই ফরিদা, কানের মধ্যে কি তুলা দিয়া থাহস? কইলাম না
আমার লুঙ্গিটা দিয়া যাইতে।
ফরিদা---আইতাছি তো।
তিতাসের মা---- এই সংসারের করোরই হাত পাউ নাই। কেউ কিছু কইরা খাব
না। যত ঠ্যাকা আমার।
বাসনের ঝনঝন শব্দ আসতে থাকে। রইসুদ্দীন ভয়ে শিউরে ওঠে।
ফ্ল্যাশব্যাক শেষ
তিতাসের ভয়ার্ত মুখমন্ডল ফিরে আসে।
দৃশ্য-৬
স্থান: পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাটের সিড়ি
সময়: রাত
প্রযোজনীয় জিনিসপত্র হাতে নিয়ে ওরা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। তিতাস মেকারও ওদের সাথে আছে। তিতাস সবার আগে।তিতাসের পরেই আদনান আর শান্তা। তার পেছনে মিতুল। সব শেষে রনি আর অঞ্জন।তিতাস আর অঞ্জনের হাতে বড় বড় দুটো টর্চ। আদনান, মিতুল আর শান্তার মুখে চরম ভয়ের ছাপ।হটাৎ একটা কি যেন এসে মিতুলের মুখের কাছ দিয়ে ছো মেরে চলে যায়। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে মিতুল এবং শান্তাকে জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথে আদনান আর শান্তাও চিৎকার করে। রনি আর অঞ্জন তিতাস মিয়ার দিকে তাকায়।
তিতাস: শ্মশানঘাট কাছে তো। লাশ খাওয়া শকুন উড়াল মারে মাঝে মধ্যে।
মিতুল: ও মাগো। লাশ খাওয়া শকুন।
অঞ্জন: প্লিজ আপনি ওদেরকে এভাবে ভয় দেখাবেন না।
আদনান: উনি কি ইচ্ছে করে ভয় দেখাচ্ছেন? মরা খাওয়া শকুনের বাড়ীতে আগেই আসতে মানা করেছিলাম।
অঞ্জন: পুরোনো বাড়ীতে সাধারনত বাদুড় থাকে। ওরা রাতের বেলা চলাফেরা করে। ওটা বাদুড় ছিল।
মিতুল: তুই শিউর হলি কিভাবে?
অঞ্জন: লজিক তাই বলে।
আদনান: তোর কাছে তো লজিক ছাড়া কিছুই ঢুকে না।
অঞ্জন: (আদনানের হাত ধরে টান দেয়) আয় তোকে প্রমান করে দিই।
আদনান: (চিৎকার করে ওঠে) মাগো, আমি মরা খাওয়া শকুনের ধারে দাছে যাবনা।
অঞ্জন: (হাত ছেড়ে দেয়) ভীতু কোথাকার।
রনি: আমারও বাদুড়ই মনে হল। আচ্ছা বাদ দে।
অঞ্জন: মনে হওয়ার কি আছে? শ্মশানে কি আস্ত লাশ থাকে নাকি? শকুন কি মড়াপোড়ার ছাই খায়? শকুন হল কার্নিভরাস। যতসব ফালতু চিন্তাভাবনা।
(তিতাস কথাটা শুনে রহস্যময় চোখে অঞ্জনের দিকে তাকায়। ওরা আবারও সিড়ি বাইতে শুরু করে।)
দৃশ্য-৬
সিড়ি বেয়ে ঐ ফ্ল্যাটটার সামনে এসে দাড়ায়।
তিতাস: লাইটটা একটু ধরেন। (রনি টর্চ ধরে। তিতাস এগিয়ে যায় দরজার দিকে।)
অঞ্জন: কী করছেন?
তিতাস: বহুৎ বছর খুলা অয় না। ঝং ধইরা গ্যাছে।
(তিতাস মিয়া দরজা ধাক্কা দেয়। খুলেনা। আরও জোরে ধাক্কা দেয়। তাও খুলেনা। এবার তিতাস মিয়া বিড়বিড় করে কি যেন বলতে থাকে চোখ বন্ধ করে)
আদনান: কী বলছেন বিড়বিড় করে?
তিতাস: (চারদিকে ফু দিয়ে) জায়গাটা বন্ধ কইরা দিলাম।ইনশাল্লাহ কোন বিপদ অইবনা।(এবার আরও টোরে ধাক্কা দেয়। দরজাটা কুলে যায়। ভেতরে অঞ্জন টর্চ ধরে।মাকড়শার জালে ছেয়ে আছে।প্রথমে অঞ্জন ভেতরে পা রাখে।
অঞ্জন: (গলায় ঝুলানো ক্যামেরা দিয়ে একটা ছবি তুলে নেয় রহস্যময় ঘরের ভেতরটার) স্বাগতম প্রেতাত্নাগন। (শব্দটা বন্ধ ঘরে প্রতিধ্বনিত হয়ে এক অদ্ভুত আওয়াজ সৃষ্টি করে।সবাই বয়ে কুচকে যায়।
অঞ্জন: আয়, ভেতরে আয়।
তিতাস: আসেন। ভয়ের কিছু নাই। আল্লার নামে ঢুইকা পড়েন।
(প্রথমে তিতাস মিয়া, তারপর শান্তা, তারপর আদনান মিতুল এবং সবশেষে রনি ঢুকে। রনি ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ একটা কি যেন দৌড়ে যেতে দেখে আতকে ওঠে অঞ্জনের দিকে তাকায়।)
অঞ্জন: (রনিকে ধরে পেছনে আগের জায়গাটায় নিয়ে যায়) এবার ধীরে সামনে এগিয়ে আয়। (রনি এগিয়ে আসে) দেখেছিস? তোর ছায়াটাও তোর চলার সাথে পাল্লা দিয়ে সরে গেছে। আর তুই ভাবলি প্রেতাত্না? হা: হা: হা:। (সাথে রনিও হেসে ওঠে। আদনান আর মিতুল শান্তা হা করে তাকিয়ে থাকে।তিতাস মিয়া আবারও সেই রহস্যময় দৃষ্টিতে অঞ্জনের দিকে তাকায়।)
অঞ্জন: ভয় বাদ দিয়ে এবার চল আমাদের রাতের সংসার সাজাই। রমণীরা, কুঞ্জ সাজাও।
দৃশ্য-৭
মেঝেতে পামাপাশি দুটো বিছানা পাতা হয়েছে। একটাতে মিতুল শান্তা আর অন্যটিতে ছেলে তিনজন। রনি গিটারে প্লাগিং করছে। আদনান শুয়ে শুয়ে ভয়ে ভয়ে ঘরের পুরোনো ছাদ দেখছে। মেয়ে দুইজন জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। অঞ্জন রনির পাশে বসে আছে।চারপাশে পাচ ছয়টা মোম লাগানো।
তিতাস মিয়া: আমি তাইলে এইবার যাই।
অঞ্জন: আচ্ছা থ্যাকস। আপনার অনেক সময় আজ নষ্ট করলাম।
তিতাস: না, না। এ আর এমন কি।আমি যাই।
অঞ্জন: আচ্ছা। কাল দেখা হবে।
(তিতাস সবার দিকে তাকিয়ে বিদায় নেয়। কি ভেবে আবার দরজা থেকে ফিরে আসে।
রনি: কিছু বলবেন?
তিতাস: জ্বি। রাইতে কেউ দরজা ধাক্কাইলে খুইলে না কইলাম।
অঞ্জন: কেন, কী সমস্যা?
তিতাস: (মেয়েদের দিকে তাকিয়ে) শান্তা আফার মতন একটা মাইয়া শ্মশান থাইকা মাঝে মইধ্যে উইঠা আহে।
শান্তা+মিতুল: ভয়ে চিৎকার দেয়।
রনি: কি বলছেন এসব?
তিতাস: ঐ মাইয়ার নাম প্রমিলা। গলায় ফাস দিয়া মরছিল। শ্মশানে পুড়ানোর পর থাইকায় রাইত বিরাতে থাকতে চায় না। মাঝে মইধ্যে উইঠা আহে বিরক্ত করনের লাইগা। দরজা না খুললেই অইল।
অঞ্জন: অনেক হয়েছে। আপনি এখন যান তো।
আদনান: তিতাস মিয়া, আপনি যাবেন না। আজকের রাতটা আমাদের সাথে থাকুন।
শান্তা+ মিতুল: প্লিজ, প্লিজ।
তিতাস: আমি থাকলে হেই আওয়াজ শুনবেন ক্যামনে?
শান্তা+মিতুল: ও মাগো।
অঞ্জন: আপনি কি দয়া করে যাবেন?
তিতাস: যাইতাছি।
(তিতাস বেরিয়ে যায়। অঞ্জন দরজাটা ভাল করে চাপিয়ে দুইটা ইট এনে দরজার পাল্লার কাছে রেখে দরজাটা আটকে দেয়।)
অঞ্জন: তোরা না আসলেই বিরক্তিকর প্রাণী। সায়েন্সে পড়ে ভাবিস অজোপাড়াগায়ের বুড়ো দাদা দাদিদের মত।
আদনান: ভয় তো আসলে তুই ও পেয়েছিস। বীরত্ত্ব দেখাতে গিয়ে প্রকাশ করছিস না।
অঞ্জন: কিভাবে?
আদনান: ভয়ই যদি না পেতি তাহলে দরজায় ইট দিলি কেন?
অঞ্জন: প্রেতাত্নার ভয়ে না, ওগুলো দিয়েছি জাস্ট সেফটির জন্য। নেচারাল সেফটি।
রনি: তর্ক বাদ দে তো।
অঞ্জন: একটু প্লাকিং শুনা তো। এইসব গাধাদের ফাউ পেচালে মাথাটা গেছে।
(অঞ্জন এসে রনির কাছে বসে। রনি গিটারে প্লাগিং করে শুনাতে থাকে।)
(এভাবে কিছুক্ষন। হঠাৎ দরজায় জোরে কে যেন ধাক্কা দেয়।সবাই চুপ হয়ে যায়। অঞ্জন সবাইকে ঈশারা দিয়ে চুপ থাকতে বলে। তারপর একটা চাকু বের করে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। তারপর সাবধানে দরজা টান দিয়ে চাকুটা সাই করে বের করে ধরতেই দ্যাখে তিতাস মিয়া।)
তিতাস: (হাসিমুখে) কি, ভয় পাইছেন?
অঞ্জন: এভাবে ভয় দেমানে কী?
তিতাস: যাওনের সময় ভাবলাম রাইতে আফনেগরে খিদ্যা লাগতে পারে। তাই কিছু টোস্ট বিস্কুট দিতে আইলাম।
(অঞ্জন প্যাকেটটা নেয়। তিতাস মিয়া চলে যায়।)
অঞ্জন: বিরক্তিকর। (বলে খট করে দরজা বন্ধ করে দেয়)
দৃশ্য-৯
আদনান, মিতুল আর শান্তা ঘুমিয়ে গেছে। অঞ্জন আস্তে করে একটা মোম রেখে বাকিগুলো নিভিয়ে দেয়।রনি তখনও গিটার নিয়ে টুংটাং করছিল।
রনি: মোম নিভিয়ে দিলি যে?
অঞ্জন: একটা স্বপ্নিল আভা তৈরী করলাম। এতে করে প্রেতাত্নাদের আসতে সুবিধা হবে।
রনি: তুই কি ব্যাপারটাকে সত্যিই পুরোপুরি উড়িয়ে দিচ্ছিস?
অঞ্জন: না তা না। আমি চাচ্ছি ব্যাপারটা ঘটুক।যাতে এটা নিয়ে একটা ভাবনার পরিবেশ তৈরী হয়। গণ-হ্যালুসিনেশন নিয়ে অনেক বেশী অগ্রহ। দেখি এবার আগ্রহের জায়গাটা নিয়ে কতদূর কি করতে পারি।
রনি: তুই কি আমার ভেতরে ব্যাপারটা পুষ করার চেষ্টা করছিস?
অঞ্জন: জানিনা। তবে আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার মত কোন ব্যাপার এখনও ঘটেনি। অপেক্ষা করছি।
(হঠাৎ বিকট শব্দে আওয়াজ হয় এবং মোমবাতিটা নিভে যায়)
রনি: ও আল্লা…. (বলে অঞ্জনকে জড়িয়ে ধরে)
অঞ্জন: আরে কিছুই হয়নি। জানালা খুলে গেছে বাতাসে। বাতাসটা ভালই লাগছে। থাকুক, জানালাটা খোলাই থাকুক।
রনি: না, না। বন্ধ কর। ঐদিকে শ্মশানঘাট।
অঞ্জন: সো হোয়াট?
রনি: প্লিজ বন্ধ কর। মোমটা জ্বালা।
অঞ্জন: প্রমিলা আসবে নাকি তোকে ধরতে?
রনি: প্লিজ জানালা বন্ধ কর।
অঞ্জন: শেষ পর্যন্ত তুই ও???? (বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।)
দৃশ্য-১০
১০(ক)
মোম জ্বলতে জ্বলতে গোড়ায় চলে এসেছে।নিভু নিভু করছে। এমন আবছা অন্ধকারে আদনানের চোখের পাতা নড়ে ওঠে। আদনান ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চোখ খুলে আর আওয়াজ শুনতে পায়------
শব্দ: ফজল মিয়া--- কই, তাড়াতাড়ি চা দেও।
তিতাস--- ফরিদা, অই ফরিদা, কানের মধ্যে কি তুলা দিয়া থাহস? কইলাম না আমার লুঙ্গিটা দিয়া যাইতে।
ফরিদা---আইতাছি তো।
তিতাসের মা---- এই সংসারের করোরই হাত পাউ নাই। কেউ কিছু কইরা খাব না। যত ঠ্যাকা আমার।
বাসনের ঝনঝন শব্দ আসতে থাকে। আদনান ভয়ে শিউরে ওঠে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
১০(খ)
একটু পর মিতুল একইভাবে শব্দ শুনতে পায়। মিতুল শান্তাকে চেপে ধরে এবং কানের কাছে এসে বলে:
মিতুল: (ফিসফিস গলায়)শান্তা, এই শান্তা।
শান্তা: (ভয়ে ভয়ে তাকায়)কী?
মিতুল: আমি তো স্পষ্ট শুনলাম।
শান্তা: আমিও।
দু’জন ভয়ে কাপতে থাকে।
দৃশ্য-১১
সময়: সকাল
স্থান: পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাটের দরজার সামনে।
অঞ্জন বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করছে। বাকিরা দাড়িয়ে আছে।
আদনান: আমি আগেই বলেছিলাম। দেখলি তো এবার।
মিতুল: আমি তো একেবারে স্পষ্ট শুনেছি।
অঞ্জন: এখানে একটা শব্দও করবিনা। যা বলার হোটেলে গিয়ে বলবি। এখন একদম চুপ।
দৃশ্য-১২
সময়: সকাল
স্থান: হোটেল কক্ষ
অঞ্জন: এটা একটা মাস হেলুসিনেশন ছাড়া কিছুই না।
আদনান: আমি বলছি আমি খুব স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি। এমনকি মিতুলের বর্ণনার সাখে আমার অবজারভেশন একদম মিলে যাচ্ছে। এমনকি সব’চে ভয়ানক ব্যাপার হল যে, মিতুল আর শান্তা একই সময়ে শুনেছে।
অঞ্জন: শান্তা, তুই কি সত্যিই মিতুলের সাথে একই রকম শব্দ শুনেছিস?
শান্তা: (বেশ কনফিউজড হয়ে মাথা নাড়ায়) তাই তো মনে হল।
অঞ্জন: মনে হওয়া হওয়ির কোন ব্যাপার সায়েন্সে নেই।রনি, তুই কি বলিস?
রনি: আমি কারোর কথাই ফেলতে পারছিনা।
অঞ্জন: তুই তো শুনলি না।
রনি: আমি আসলে এত বেশি টায়ার্ড ছিলাম যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের ই পাইনি।
অঞ্জন: আমি বুঝলাম না, কেন তোরা একটা সায়েন্টিফিক ব্যাপারকে এমন ভুতুড়ে বানিয়ে তুলছিস।
আদনান: সবসময় এত লজিক লজিক করিসনা তো। আমি শিওর আমি শুনেছি এবং আমার কোন হ্যালসিনেশন হয়নি।
মিতুল: আমিও ড্যাম শিওর।
অঞ্জন: (খানিক্ষণ চুপ করে থেকে) আমিও ড্যাম শিওর যে তোদের সবার হ্যালুসিনেশন হয়েছে।
আদনান: আমরা নিজ কানে শুনেছি। এবার তুই মুকে না বলে প্রমাণ দে যে ব্যাপারটা হ্যালুসিনেশন।
অঞ্জন: আমি আজই প্রমাণ করে দেব।
রনি: কিভাবে?
অঞ্জন: হ্যালুসিনেশন তো কেবল বদ্ধিমত্ত্বা সম্পন্ন প্রাণীরই হয়, যন্ত্রের তো হয়না, তাইনা?
রনি: হ্যা, যন্ত্রের আবার হ্যালুসিনেশন হয় কি করে?
অঞ্জন: দিস ইজ দ্যা ফ্যাক্ট। আজ রাতে আমরা একটা টেপ রেকর্ডার সেট করে ঘুমাব। যদি ব্যাপারটা আসলেই ঘটে তাহলে তো সব সাউন্ড রেকর্ডারে রেকর্ড হবে, তাইনা? আর
তা না হলেই তো প্রমাণ হল যে ব্যাপারটা উত্তেজিত মস্তিস্কের একটা নিছক হেয়ালি, যাকে আমরা বলি হ্যালুসিনেশন।
শান্তা: দারুন।
রনি: জটিল কনসেপ্ট।
আদনান: তাহলে আজ রাতেই হয়ে যাক।
অঞ্জন: হুম, হয়ে যাক।
দৃশ্য-১৩
সময়: রাত
স্থান: পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাট
(অঞ্জন ব্যাগ থেকে একটা রেকর্ডার বের করে)
অঞ্জন: এই হল তোদের প্রেতাত্নার কন্ঠস্বর ধরার যন্ত্র। রেকর্ডটা ইউটিউবে বিক্রি করলে ভাল এমাউন্ট পাবি। “ভয়েস অব ঘোস্ট”।কোন দিক থেকে শব্দটা আসছিল?
আদনান: মনে হয় দক্ষিনের জঙ্গল থেকে।
মিতুল: হ্যা, তাই হবে।
অঞ্জন: আচ্ছা, তবে তাই হোক। দক্ষিনের জঙ্গলের দিকেই থাকুক রেকর্ডারটা।
(দরজায় নক)
কে?
ওপাশ থেকে: আমি তিতাস মিয়া।
(আদনান গিয়ে দরজা খুলে দেয়।)
আদনান: কী ব্যাপার? সারাদিন আপনার খোজ নেই যে?
তিতাস: বিরাট ব্যাস্ত ছিলাম। একটা বড়সড় কাম পাইছি। আইতে আইতে দেরি অইয়া গেল। আপনাদের জন্য আফনেগরে ভাবিসাব কয়টা ডাইল ভাত দিয়া দিছে।
রনি: এসবের কী দরকার ছিল?
তিতাস: ছিল, অবশ্যই দরকার ছিল। মেহমানগরে একবেলাও বাসায় নিয়া মেহমানদারি করবার পাইলাম না। এইটুকোও যদি না করি তাইলে তো মনে দু:খ থাইকা যাব।
(তিতাস মিয়া বসে)
তা কাইল রাইতের বিত্তান্ত কী?
মিতুল: আপনার কথা একদম অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে।
অঞ্জন: একেবারে অক্ষরে অক্ষরে না, প্রমিলা দেবী বাদে বাকীটা।
তিতাস: (রেকর্ডারের দিকে তাকায়) তা এইটা কী সেট করলেন?
অঞ্জন: আপনাদের প্রেতাত্নার কন্ঠস্বর ধারন করার যন্ত্র।
(তিতাস রেকর্ডারের দিকে তাকিয়ে সেই রহস্যময় হাসিটা আবারও হাসে।
দৃশ্য-১৪
সময়: রাত
স্থান: পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাট
রেকর্ডারটা অন করা। সবাই ঘুমিয়ে আছে।হঠাৎ রনির ঘুম ভাঙে সেই শব্দটা শুনে। একবার চোখ মেলে তাকিয়ে শব্দের উৎসটা খোজার চেষ্টা করে আবার ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তারপর রেকর্ডারটা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায়। ওটা হাতে নিয়ে উচু করে ধরে শব্দগুলো আরও স্পষ্টভাবে রেকর্ড করার চেষ্টা করে।
দৃশ্য-১৪
সময়: রাত
স্থান: পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাট
মোমের আলো নিভে গেছে। আদনান সেই শব্দ শুনে জেগে ওঠে। চারদিকে তাকায়।
মিতুল: (ফিসফিস করে) আদনান, এ্যায় আদনান।
আদনানআদনান ভয়ানভাবে চমকে মিতুলের দিকে তাকায়)শুনতে পাচ্ছিস কিছু?
(মিতুল হ্যা সূচক মাথা নাড়ে)
শান্তা: একদম জানে মেরে ফেলবে। ঘাড় মটকে দেবে। ঘুমা তো। চুপ করে শুয়ে থাক।
দৃশ্য-১৫
সময়: ভোরবেলা
স্থান: পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাট
(সবাই ঘুমিয়ে। ভোরের আলো চোখে লেগে অঞ্জনের ঘুম ভাঙে। একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে টেপ রেকর্ডারটা যেখানে ছিল সেদিকে তাকায়। সেখানে টেপ রেকর্ডারটা নেই। ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর—)
অঞ্জন: (রনিকে ধাক্কা দেয়। রনি জাগে) দ্যাখ্।
রনি: কী?
অঞ্জন: রেকর্ডারটা নেই।
রনি: (চমকে বিছানা থেকে উঠে বসে।) মানে!
শান্তা: (জেগে উঠে) আমি আর নেই তোদের সাথে। ভাগ্যিস শুধু রেকর্ডার গেছে।
আদনান: (চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে) কী হইছে রে?
শান্তা: প্রেতাত্নারা রেকর্ডারটা নিয়ে গেছে।
আদনান: (রেকর্ডার যেকানে ছিল সেদিকে তাকায়) হায় হায়।
রনি: আমারই ভুল হয়েছে। কাল রাতে শব্দ শুনে আমি রেকর্ডারটা এগিয়ে ধরেছিলাম ওদের কথপোকথন রেকর্ড করার জন্য।সেই জন্যই রেগে এই কাজ করেছে। ভাগ্যিস ঘাড় মটকে দেয়নি।
অঞ্জন: তুই কি স্পষ্ট শুনেছিস?
আদনান: স্পষ্ট মানে। একদম ক্লিয়ার। আমি শান্তা আর মিতুলও শুনেছি।
অঞ্জন: গুড। আসল খেলা এবার জমবে।
আদনান: অনেক হয়েছে। আর কোন খেলার দরকার নাই।
অঞ্জন: আমি তো এর শেষ দেখেই ছাড়ব।
মিতুল: এখনও তোর মনে হচ্ছে যে ব্যাপারটা অতিপ্রাকৃতিক না?
অঞ্জন: অবশ্যই মনে হচ্ছে।
(অঞ্জন পায়চারি করতে করতে চারদিক দেখতে থাকে। হঠাৎ দরজার দিকে জোখ পড়ে।)
অঞ্জন: দরজা খোলা কেন?
(সবাই ঘুরে তাকায় দরজার দিকে)
রনি: তাই তো!
(আদনান, শান্তা, মিতুল নিজেদের মধ্যে বিড়বিড় করে কি সব বলাবলি করতে থাকে)
অঞ্জন: আমি দেখতে চাই কোন প্রেতের আত্না ভর করে আছে এখানে। (পায়চারি করতে থাকে। একসময় জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে নজরে পড়ে রেকর্ডারটা নিচে মাটিতে ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে।) পেয়েছি!
(সবাই এগিয়ে আসে)
দৃশ্য-১৬
স্থান: হোটেল কক্ষ
সময়: দুপুর
(অঞ্জনের হাতে রেকর্ডারটা।)
অঞ্জন: আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।নাথিং হেপেন্স বেয়ন্ড লজিক।
রনি: দোস্ত একটু বুঝার চেষ্টা কর।আর আমাদের রিস্ক নেয়ার কোন দরকার নেই।
শান্তা: চল আজই ঢাকা চলে যাই।
আদনান: ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে চল।
অঞ্জন: আমি এর শেষ দেখবই। আজ রাতে তোদের কারোরই থাকার দরকার নেই। আমি একাই থাকব।
রনি: আমরা তোকে একা ছাড়তে পারিনা।
অঞ্জন: (দাড়িয়ে) না না না। এর শেষ না দেখে তো আমি যাব না। তোরা কোন চিন্তা করিস না। আর মাত্র একটা রাত। জাস্ট ওয়ান নাইট।
দৃশ্য-১৭
সময়: রাত
স্থান: পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাট
অঞ্জন একা। দরজাটা সাবধানে লাগিয়ে নেয়।তারপর এসে জানালাটা লাগায়। কয়েকটা মোম ধরিয়ে নেয়।বিছানায় এসে বসে।বালিশের উপর কুনুই ঠেকিয়ে মোমের আলোয় একটা বই ধরে পড়তে থাকে।
দৃশ্য-১৮
সময়: রাত
স্থান: পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাট
পড়তে পড়তে কখন যেন বই হাতে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ বিকট শব্দে জানালা খুলে যায়। দমকা হাওয়া এসে মোমের আলো নিভিয়ে দেয়।অঞ্জন চমকে ওঠে ঘুম থেকে।বেশ ভয়ে ভয়ে দেয়াশলাই খোঁজতে থাকে।না পেয়ে টর্চ জ্বালায়।
অঞ্জন: (চারদিকে টর্চ ধরে) অঞ্জনের হ্যালুসিনেশন কখনই সৃষ্টি করতে পারবেনা হে বোকা প্রেতাত্নাগণ।
(জানালাটা লাগাতে যায়। পাল্লা ধরে টান দিতেই হাতে একটা শাড়ীর আচল আটকে যায়।হাত দিয়ে ধরে সাবধানে টান দেয়। দ্যাখে আচলের আগাটায় ফাসির মত একটা ফাস বাধা।)
অঞ্জনের মনে পড়ে যায় তিতাসের সেই কথাগুলো: “ঐ মাইয়ার নাম প্রমিলা। গলায় ফাস দিয়া মরছিল। শ্মশানে পুড়ানোর পর থাইকায় রাইত বিরাতে থাকতে চায় না। মাঝে মইধ্যে উইঠা আহে বিরক্ত করনের লাইগা। দরজা না খুললেই অইল।"
ভয়ে শিউরে ওঠে অঞ্জন। আচলটা ছেড়ে দিতেই নিচে পড়ে যায় ওটা।
অঞ্জন: উত্তেজিত মস্তিস্ক, তুমি শান্ত হও।দেয়ার ইজ নাথিং বেয়ন্ড লজিক।(বলতে বলতে জানারাটা লাগিয়ে দেয়। তারপর টেপরেকর্ডারটা চালু করে নিজের হাতে ধরে রাখে।)
দৃশ্য-১৯
সময়: রাত
স্থান: পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাট
অঞ্জন রেকর্ডারটা বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ বাশির শব্দ শুনে জেগে উঠে। চারদিকে সাবধানে তাকায়। তারপর দাড়িয়ে সুরের উৎসটা কোথায় ধরার চেষ্টা করে। টেপ রেকর্ডারটা চারদিকে ধরে ধরে শব্দটা রেকর্ড করার চেষ্টা করে।তারপর রেকর্ডারটা রেখে জানালার দিকে এগিয়ে যায়। জানালা খুলে কান পেতে বুঝতে পারে যে ছাদ থেকে আসছে শব্দটা। টর্চটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বের হয়। সাবধানে সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে থাকে। ছাদে পা দিতেই দ্যাখে ছাদের এক কিনারায় একটা বৃদ্ধ লোক উল্টা দিকে মুক ফিরিয়ে একধ্যানে বাঁশি বাজাচ্ছে। চুপ করে কিছুক্ষণ ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করে।
অঞ্জন: (মনে মনে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলতে থাকে) দেয়ার ইজ নাথিং বেয়ন্ড লজিক। দিস ইজ নাথিং বাট দ্যা ক্রিয়েশন অফ মাই এক্সাইটেড ব্রেইন।
অঞ্জন এগিয়ে যায়। লোকটা এবার বাঁশি বন্ধ করে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করে। অঞ্জন যতই আগায় লোকটাও উল্টোদিকে মুখ ফিরে ছাদের কিনারার দিকে এগুতে থাকে। একসময় ধপাস করে ছাদ থেকে পড়ে যায় লোকটা। অঞ্জন দৌড়ে ঘরের দিকে ফিরে যায়।
দৃশ্য-২০
সময়: রাত
স্থান: পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাট
অঞ্জন ধপাস করে দরজাটা লাগিয়ে হাঁপাতে থাকে।
অঞ্জন: (ভয়মিশ্রিত হাসি হেসে) অঞ্জন, শান্ত হও। শান্ত হও। ও……. ও….. ও……. ও…. ও……. ও……… ও………।(ভয় কাটানোর জন্য জোরে শব্দ করে। কিন্তু শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে আরও বেশী ভয়ানক পরিবেশ তৈরী করে।)
দৃশ্য-২১
সময়: রাত
স্থান: পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাট
অঞ্জন রেকর্ডারটা বুকে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।হঠাৎ সেই কন্ঠস্বরগুলোকানে ভেসে আসে:
শব্দ: ফজল মিয়া--- কই, তাড়াতাড়ি চা দেও।
তিতাস--- ফরিদা, অই ফরিদা, কানের মধ্যে কি তুলা দিয়া থাহস? কইলাম না
আমার লুঙ্গিটা দিয়া যাইতে।
ফরিদা---আইতাছি তো।
তিতাসের মা---- এই সংসারের করোরই হাত পাউ নাই। কেউ কিছু কইরা খাব
না। যত ঠ্যাকা আমার।
বাসনের ঝনঝন শব্দ আসতে থাকে।
(অঞ্জন ভয়ে আরও কুঁচকে উঠে।রেকর্ডারটা আরও জোরে চেপে ধরে।)
অঞ্জন: শান্ত হও, মস্তিস্ক শান্ত হও। (ভয়ে কাঁপতে থাকে)
দৃশ্য-২২
সময়: ভোরবেলা
স্থান: পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাট
(লোকালয় জেগে উঠছে। রিক্সার বেলের শব্দ, দোকানের সাঁটার খুলার শব্দ, পথচারিদের শব্দ আসছে। অঞ্জন বিছানার চাদর সারা গায়ে পেচিয়ে, রেকর্ডারটা বুকে চেপে ধরে জ্বরে থরথর করে কাঁপছে আর প্রলাপ বকছে।)
অঞ্জন: দেয়ার ইজ নাথিং বেয়ন্ড লজিক…….. দেয়ার ইজ নাথিং বেয়ন্ড লজিক……..
(অঞ্জন লাল টকটকে চোখে তাকায়। অনেক কষ্টে উঠে বসে।তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে রেকর্ডারটা ধরে চালু করে।অঞ্জনকে অবাক করে দিয়ে রেকর্ডারে রাতের শব্দগুলো বাজতে থাকে। অঞ্জন খুব অবাক হয়ে শুনতে থাকে। তারপর উদ্ভ্রান্তের মত চিৎকার করে উঠে
অঞ্জন: নো, নো।ইটস ইমপসিবল। ইটস সিম্পলি ইম্পসিবল।
(মোবাইলটাতে রানার নাম্বার ডায়াল করে।)
রানা: হ্যালো।
অঞ্জন: নো ফ্রেন্ড।ইটস ইমপসিবল। ইটস সিম্পলি ইম্পসিবল।
দৃশ্য-২৩
সময়: ভোরবেলা
স্থান: পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাট
(দরজা ঠেলে চার বন্ধু ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে।অঞ্জনের এই অবস্থা দেখে সবাই আঁতকে উঠে। সবাই অঞ্জনকে গিয়ে ধরে।)
রনি: কী হয়েছে তোর?
অঞ্জন: (বিড়বিড় করে) ফ্রেন্ড।ইটস ইমপসিবল। ইটস সিম্পলি ইম্পসিবল।
আদনান: কী ইম্পোসিবল?
অঞ্জন: রেকর্ডারে রাতের সব শব্দ রেকর্ড হয়েছে।সব শুনা যাচ্ছে।দেয়ার ইজ নাথিং বেয়ন্ড
লজিক।
(রনি তাড়াতাড়ি রেকর্ডার নিয়ে প্লে করে।)
রনি: কই, কিছুই তো শোনা যাচ্ছেনা।
অঞ্জন: (ছো মেরে রেকর্ডারটা নিয়ে নেয় আর কান পাতে) এই যে, এইতো, স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। একদম স্পষ্ট।
(রনি, আদনান, শান্তা, মিতুল পরস্পরের দিকে তাকায় আর আফসোসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।)
অঞ্জন: আমি এর শেষ দেখব। দেয়ার ইজ নাথিং বেয়ন্ড লজিক। এর শেষ আমি দেখবই।
দৃশ্য-২৪
সময়: সকাল
স্থান: কোয়ার্টারের সামনে
(তিতাস মিয়াসহ বন্ধুরা অঞ্জনকে টেনে গাড়ীতে তুলছে। অঞ্জন ক্রমাগত প্রলাপ বকেই যাচ্ছে। অফিসের বড়কর্তা পাশে দাড়িয়ে আছে। অঞ্জনকে টেনে গাড়ীতে তোলা হয়। গাড়ী স্টার্ট হয় এবং চলতে শুরু করে। অঞ্জনের প্রলাপ ক্রমাগত অস্পস্ট হতে থাকে।
তিতাস মিয়া গাড়ীর দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যের হাঁসি হাসে)