somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমায়ুন আহমেদের সায়েন্স ফিকশন রিভিউ: পর্ব-১, "নিষাদ"

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১০:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(এই পোস্টটি উৎসর্গ করা হল সামহয়ারইনে আমার প্রিয় ব্লগার হুপফুলফরইভার কে। আমি নিশ্চিতভাবে জানি, যখন এই লেখাটি সামুতে পোস্ট হচ্ছে; অন্যকোন জগতে অন্যকোন ভূবনে হুপফুলফরইভার অত্যন্ত আনন্দের সাথে নিঝুম দ্বীপে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন!!)

একটা মানুষের কয়টা জীবন থাকতে পারে? একটা? দুইটা?? তিনটা/চারটা/পাঁচটা? নাকি আরও বেশি?? আমার নিজের জীবনের কথাই ধরা যাক। কলেজ-জীবনে পড়তে ছোট্ট যে স্কুলপড়ুয়া মেয়েটার সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতাম, আজ সে কোথায়? ভার্সিটি লাইফে থাকতে যে সহপাঠিনীকে সারা জীবন আলিঙ্গনে রাখতে চেয়েছিলাম, সে তো এক এয়ারফোর্স অফিসারের হাত ধরে চলে গেল। এরপর যে কথা দিয়েছিল সারা জীবনের জন্যে আমার হাত ধরে রাখবে, সে আজ অনেকদূরের প্রবাসজীবনে চলে গেছে। একটু একটু শুনতে পাই সে নাকি সেখানকার একজনের সাথে "একত্রে বসবাস" করছে। জানি না কেবলই নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় নাকি ভালোবাসার টানে সে এই কাজগুলো করছে…..

নিজের জীবনের কথা না হয় বাদই দিলাম, খুব কাছের একজন বন্ধু ছিলো নাহিদ শাহরিয়ার। ছেলেটার বাবা মারা গেল রোড এ্যাক্সিডেন্টে, মা ও কিছুদিন পরে চিরবিদায় নিল ব্রেইনস্ট্রোকে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ায় ছেলেটার আর পড়াশুনাই হল না। কি হত যদি ওর বাবা মারা না যেত, আর্থিক অনটনের কারণে ওর পড়াশুনা বন্ধ না হত? সেও কি আমাদের সবার মত কম্পিউটার কিংবা যন্ত্র প্রকৌশলী হয়ে বের হত না?

আবার ধরি আমিই, যেদিন ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউটে পরীক্ষা দিতে গেলাম, গায়ে ১০২ ডিগ্রি জ্বর। যদি সেদিন পরীক্ষায় চান্স পেতাম তাহলে হয়তো এই আমিই কম্পিউটার প্রকৌশলী না হয়ে হয়ত অন্যকিছু হতাম। চাকরি করতাম সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে, যার সাথে এখনকার কোনও মিলই নেই!

আজ কেমন হবে যদি ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি আসলে অন্য আমি! যে আমি হতে চেয়েছিলাম বিজনেস এক্সিকিউটিভ, আমার প্রেয়সী আমাকে ছেড়ে যায়নি! সে এখন আমার সহধর্মিনী। বর্তমানের আমি পুরো ব্যপারটাই একটা স্বপ্ন ছিলো! এখনকার আমিই সত্যিকারের আমি!

কিংবা কেমন হতো, যদি দেখি সেই মেয়েটি অন্যকারো হাত ধরে যায় যায়নি। সে সারাজীবন চেয়েছিল আমার কণ্যাসন্তানের মা হতে। সে আজ সত্যিই আমার কণ্যাসন্তানের মা। আমার সেই বন্ধুটির বাবা মারা যায়নি বরং সে এখন সত্যি সত্যিই একজন যন্ত্র-প্রকৌশলী। ও যখন বিকালে আমার বাসায় এসে বারান্দায় বসে চা খায়, ওখন আমার ছোট্ট মেয়েটি দুষ্টুমি করে ওর চারপাশে ঘুরতে থাকে!

আবার কেমন হতো, যদি আমি একটু পরেই ঘুম ভেঙে দেখি আমি ঠিকই আছি। সেই প্রকৌশলীর জীবনেই আছি। কেবল আমার নিঃসঙ্গতার অবসান হয়েছে। একাকী জীবনে ক্লান্ত আমি আর নেই বরং আমি কোলে শুয়ে আছি সেই মেয়েটির যে কিনা আমাকে কথা দিয়েছিল সারাজীবন ধরে রাখার, এবং সেই কথা সে রেখেছে?

স্বপ্ন তো আমরা সবাই দেখি কিন্তু ঘুম ভাঙার আগে কি বুঝতে পারি যে সেটা স্বপ্ন ছিল? স্বপ্ন ছাড়া আরও একটা ব্যাপার আমাদের প্রায়ই ঘটে যার নাম "ডেজাভ্যু"। ডেজাভ্যু দেখতে হলে ঘুমানো লাগে না, শুধু চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা খুব পরিচিত লাগে। কেমন হবে যদি এই ডেজাভ্যুর মাধ্যমেই চলে যাই অন্য কোন জীবনে, অন্যকোন ভূবনে যেখানকার অতীত অন্যরকম ছিল বিধায় বর্তমানও অন্যরকম? আবার ডেজাভ্যু কেটে গেলে ফিরে আসি সেই আগের জীবনে? একটা জীবন অত্যন্ত মধুর, আরেকটা জীবন তিক্ততার, ব্যর্থতার।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ সেই অবস্থাটিই কল্পনা করেছেন তাঁর সায়েন্স ফিকশন গল্প "নিষাদ" এ। "নিষাদ"কে কি সায়েন্স ফিকশন বলা যায়? নাকি এটা একধরণের ফ্যান্টাসি? অবাস্তব হলেও সত্য এই যে "কোয়ান্টাম মেকানিক্স" কিন্তু আমাদের এই দ্বৈত জীবনের অবস্থাকে মেনে নেয়! যেখানে একাধিক জীবন প্যারালাল অবস্থানে চলতে থাকে কিন্তু কখনোই কারো সাথে কারো দেখা হয়না। কিন্তু সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ কল্পনা করেছেন এমন একটি চরিত্রের যেখানে পাশাপাশি জীবনগুলোর দেখা হয়ে যায়।

লেখক হুমায়ূন আহমেদ যে জায়গাটিতে এসে পাঠকের চেতনায় আঘাত করেছেন সেই অবস্থাটা হলো "কারেন্ট টাইমলাইন" থেকে "প্রিভিয়াস টাইমলাইনে" চলে যাওয়া অর্থাৎ বর্তমানের এই সময় থেকে অতীতে চলে যাওয়া। আরেকটু গুছিয়ে বলি, উপন্যাসের নায়ক টুনুর জীবনে প্রথম যে ঘটনাটি ঘটেছিল সেটা হল এখনকার ২৫ বছর বয়স থেকে অতীতের ১৫ বছর বয়সে ফিরে যাওয়া। মজার ব্যাপার হচ্ছে অতীতে ফিরে গিয়েও টুনুর বর্তমান ঘটনার কথা মনে ছিল বিধায় সে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিতে পেরেছিল। উদাহরণ স্বরূপ: আমি আজকে যদি একটা টাইমমেশিন পাই তাহলে অতীতে ফেরত গিয়ে এমন একটা ভুল আমি করবোনা যে ভুলটির কারণে এখন আমাকে পস্তাতে হচ্ছে। এমনকি অতীতে ঘটা কোন দূর্ঘটনাও আমি প্রতিরোধ করে ফেলতে পারবো। টুনুর ক্ষেত্রে ঠিক এমনটাই হয়েছিল।

একটি জীবনে সে তার বাবার জীবন রক্ষা করেছিল। আবার বাস্তব জীবনে সে একজন অসহায় নিঃসঙ্গ যুবক। কোন এক জীবনে সে এক ছেলের পিতা আবার কোন এক জীবনে সে সন্তানহারা।

সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ মানবজীবনের চমৎকার কিছু দিক তুলে ধরেছেন তার উপন্যাস "নিষাদ" এ। টুনু এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কিন্তু মিসির আলীর ভূমিকাও কম নয়। টুনু এই উপন্যাসে ভিকটিম আর মিসির আলী টুনুর কাউন্সেলর। মানুষের ব্রেইনের বৈশিষ্ট হল সে অপ্রযোজনীয় তথ্য খুব যত্ন করে মনে রাখে আবার প্রয়োজনীয় তথ্য সে ভুলে যায়- এই কথাটি তিনি মিসির আলীর চিন্তাধারা থেকে বের করেছেন। জীবন পরিভ্রমনে ক্লান্ত টুনু একপর্যায়ে এসে তার ভ্রমন লগবইতে লেখে "মানুষের জীবন হয়তো অসংখ্য"। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কাহিনীর এক পর্যায়ে মিসির আলী নিজেও এই অসংখ্য জীবনের সহাবস্তান স্বীকার করে নেন। তার ছাত্রী নীলুকে উদ্দেশ্য করে বলেন: "অন্য এক জীবনে আমি হয়তো গিয়েছি তোমার কাছে। সেই জীবনে হয়তো আমি তোমার পিছনে-পিছনে ঘুরছি, আর তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছ।"

আমার রিভিউ আমি শেষ করব টুনুর উক্তি দিয়ে। জীবন পরিভ্রমণের প্রস্তুতিকালে সে তার লগবইতে লিখেছিল: "প্রাচীনকালে মুনি-ঋষিরা বলতেন- জীবনটাই একটা মায়া। আসলেই বোধহয় তাই। সবটাই বোধহয় মায়া। এখন আমার এ-সব জানতে ইচ্ছে করে না। যে-কোন একটি জীবনে আমি স্থায়ী হতে চাই।" প্রিয় পাঠক, সুযোগ পেলে অবশ্যই নিষাদ বইটি পড়বেন। আশাকরি আপনাদের সময়টা অপচয় হবে না।

*পরবর্তিতে নিষাদের ডাউনলোড লিংক দিয়ে দেওয়া হবে।
**নিষাদ গল্পের কাহিনী নিয়ে একটি নাটকও প্রচারিত হয়েছিল এনটিভিতে। নাটকের নামও নিষাদ।
***নিষাদ শব্দের অর্থ সম্ভবত শিকারী বা ব্যাধ, যিনি তীর-ধনুক সহযোগে শিকার করেন.....

(এই পুরো পোস্টটুকু পড়তে হয়ত পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু রিভিউটি লিখতে সময় লেগেছে এবং যথেষ্ট কষ্ট হয়েছে। নিষাদ উপন্যাসটা আবার গোড়া থেকে পড়তে হয়েছে। নিষাদের যায়গায় নিজেকে কল্পনা করে লেখার প্যাটার্ণ সাজিয়ে তুলতে হয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের চাওনা-পাওয়া-না পাওয়া সব একাকার হয়ে চোখ ফেঁটে জল এসেছে একাধিকবার। তারপরও বলি, পোস্টটি পড়ে ভালো লাগলে আমার কষ্ট সার্থক হবে বলে মনে করব)
১৪টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কথাটা খুব দরকারী

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ৩১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৩৪

কথাটা খুব দরকারী
কিনতে গিয়ে তরকারি
লোকটা ছিল সরকারি
বলল থাক দর ভারী।

টাকায় কিনে ডলার
ধরলে চেপে কলার
থাকে কিছু বলার?
স্বর থাকেনা গলার।

ধলা কালা দু'ভাই
ছিল তারা দুবাই
বলল চল ঘানা যাই
চাইলে মন, মানা নাই।

যে কথাটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×