somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ট্রানজিট ও ‘খুন’ হয়ে যাওয়া নদ

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১১ দুপুর ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সকালের বাসি সংবাদ। তারপরও শেয়ার করলাম। কেউ মিস করে থাকতে পারেন।

একটি টেলিভিশনের প্রতিবেদনের বরাতে আমরা অনেকেই জেনেছি যে তিতাস এখন ‘খুন’ হয়ে যাওয়া একটি নদের নাম! সংবাদের সেই ক্লিপটি যে কত হাজারবার সামাজিক যোগাযোগের প্লাটফর্ম ও ব্লগগুলোতে শেয়ার হচ্ছে, তার হিসাব নেই। খবরের কাগজে বা মুদ্রণ মাধ্যমে অবশ্য এই তৎপরতার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। কিন্তু কয়েক দিন ধরে ভার্চুয়াল জগতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনা এই তিতাস নদের ‘খুন’। শোক পাখা মেলেছে অদ্বৈত মল্ল বর্মণের উপন্যাস এবং ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র তিতাস একটি নদীর নামকে ঘিরে, কখনো বা আল মাহমুদের কবিতার ছন্দে। মেঘনার পেট থেকে জন্ম নেওয়া এই অসম্ভব সুন্দর নদ তিতাস বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন জনপদের মাঝ দিয়ে বয়ে শেষে বিলীন হয়েছে আবারও মেঘনাতেই। তার পায়ের মল যেখানেই বেজেছে, সেখানেই আমরা পেয়েছি লোকসংগীতের বিশাল ভান্ডার। কিন্তু তিতাস খুন হলো কীভাবে?
একুশে টেলিভিশন যে প্রতিবেদন প্রচার করেছে তা রীতিমতো রোমহর্ষক। আমার মতো দুর্বলচিত্তের জন্য তো বলাই বাহুল্য। বস্ফািরিত চোখে দেখলাম, একপাশে রেলসেতু আর অন্য পাশে সড়কসেতু রেখে একটা নদীকে আড়াআড়ি ভরাট করা হয়েছে পাথর আর সিমেন্টের বস্তা দিয়ে! ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আখাউড়ার মাঝখানে কোনো এক জায়গায়। অবশ্য ভরাট রাস্তার নিচে তিন ফুট ব্যাসের কংক্রিটের পাইপ আছে কয়েকটা। নদীর চলাচলের জন্য! কংক্রিটের পাইপ দিয়ে নদী পার করে দেওয়ার চেয়ে সুঁইয়ের ছিদ্র দিয়ে আস্ত কম্বল পার করে দেওয়া বরং সহজ! এই মন্তব্য করেছেন ব্লগার দিনমজুর, তিতাস নদ নিয়ে সামহোয়ারইনব্লগে তাঁর লেখায়। এই খুন শুধু যে এক জায়গায় হয়েছে, তা নয়। ব্লগার আলী মাহমেদ তাঁর ব্যক্তিগত ব্লগে জানাচ্ছেন, আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত তিতাস নদ ও এর ডালপালার ওপর ব্রিজ ও কালভার্ট আছে কমপক্ষে ২৭টা। বাঁধ দেওয়া হয়েছে সব জায়গায়, বানানো হয়েছে রাস্তা, নদের বুক চিরে।
কিন্তু কেন এই নদ খুন? ভারতকে দেওয়া ট্রানজিটের শর্ত অনুযায়ী, আশুগঞ্জ থেকে সাড়ে তিন শ টন ওজনের ১২০ ফুট লম্বা ওডিসি বা ওভার ডাইমেনশনাল কার্গো আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ত্রিপুরায় যাবে। কিন্তু আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কে যেসব ব্রিজ বা কালভার্ট আছে তা এ ধরনের ভারী পরিবহনের জন্য উপযুক্ত নয়। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে স্বাভাবিক যে রাস্তাটি ছিল, সেটি হলো ব্রিজগুলোকে চলাচলের উপযোগী করে তোলা। কিন্তু সেটি সময়সাপেক্ষ, আবার তাতে খরচও অনেক। গরম গরম ট্রানজিট-ভালোবাসায় তত ধৈর্য রাখার জায়গা কোথায়? সে কারণেই ক্ষীণতোয়া তিতাসের গলা টিপে রাস্তা বের করাটাকে সহজ সমাধান ভেবে নিয়েছে ট্রানজিটের রূপকারেরা!
মুদ্রণ মাধ্যম যেখানে নীরব, সেখানে টেলিভিশনের দুই মিনিটের একটি প্রতিবেদনে কতটুকুই আর প্রকাশ পাবে? ফলে সক্রিয় হয়ে ওঠে বিকল্প মাধ্যমগুলো। ব্লগারদের অনেকেই সরেজমিনে পরিদর্শন ও তথ্য যাচাই করেছেন। দিনমজুরের ব্লগে দেওয়া ছবি থেকে জানা যাচ্ছে কীভাবে এসব ভরাট সড়কের নিচের নদী-বাইপাসগুলো নানা বর্জ্যে আটকে গেছে, ব্রিজগুলো কীভাবে বিপজ্জনকভাবে বেহাল হয়ে আছে। সিটিজেন জার্নালিজম কীভাবে কাজ করে এটা যাঁরা জানতে চান, তাঁরা এঁদের ব্লগগুলো ঘুরে আসতে পারেন। আমার এই লেখাটিও তৈরি হয়েছে ব্লগের বিভিন্ন লেখা থেকে তথ্য-উপাত্ত সহায়তা নিয়ে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের প্রকাশভঙ্গিও ধার করেছি।
জানা যায়, ট্রানজিটের আওতায় তিতাস নদ ভরাট করা রাস্তার ওপর দিয়ে যেসব মালামাল পরিবহন হয়েছে, তার অধিকাংশই ত্রিপুরায় নির্মীয়মাণ পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য। আগামী ১৫ মে চালু হতে যাওয়া এই বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন করবে ৭২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবং এর থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশের। এ নিয়ে নীতিনির্ধারণী মহলে সমঝোতা হয়েছিল বলেও শোনা যায়। কিন্তু টিপাইমুখের মতো এখানেও লাভের খাতায় শূন্য যোগ হতে চলেছে। আগরতলা থেকে প্রকাশিত ডেইলি দেশের কথা পত্রিকার ১২ ডিসেম্বর সংখ্যার বরাত দিয়ে ব্লগার আলী মাহমেদ বিদ্যুৎ বণ্টনের হিসাবটি তুলে ধরেছেন তাঁর ব্লগে। সেখানে দেখা যায়, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ভাগ-বণ্টনেই ৭২৬ মেগাওয়াট শেষ, বাংলাদেশের জন্য কিছু নেই।
বাকি থাকে ট্রানজিট শুল্ক মারফত নগদ লাভের সুযোগ। গত ৪ অক্টোবর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এক আলোচনায় জানান, প্রযোজ্য সব চার্জ দিয়েই নাকি এই পরিবহন হচ্ছে। কিন্তু একুশে টেলিভিশনের পরবর্তী এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ট্রানজিটের ব্যাপারে প্রযোজ্য কোনো শুল্কই আদায় হচ্ছে না। বরং ভর্তুকি দিয়ে ট্রানজিট চালানো হচ্ছে বলে সেই প্রতিবেদনে মতামত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
সব মিলিয়ে যেটা দাঁড়ায় তা হলো, নগদ ও বাকি লাভালাভের যেসব মুলা ঝুলিয়ে ট্রানজিট চালু করা হয়েছে, সেগুলো ইতিমধ্যেই সোনার পাথরবাটি। চালু হয়েছে ট্রানজিট, সরকার নীরবে গুনছে ভর্তুকি আর খুন হয়ে গেছে তিতাস নদ। অতীতে ফারাক্কার মতো বাঁধ দিয়ে গোটা উত্তরবঙ্গের নদীগুলোকে কোমায় পাঠিয়েছে ভারত, অচিরেই টিপাইমুখ চালু করে এই খামাখা মুমূর্ষু হয়ে বেঁচে থাকার ঝামেলা থেকে বাংলাদেশের নদীগুলোকে চিরতরে মুক্তি দেবে সে, আশা করা যায়। বড়র পিরিতি বালির বাঁধ কে বলে, রীতিমতো জন্ম-জন্মান্তরের বাঁধ-বন্ধন! এ যেন জয় গোস্বামীর কবিতার মতো প্রেম: ‘নিঃশ্বাস নিতে দেব না তোমাকে নিঃশ্বাস নিতে দেব না!’ উত্তরবঙ্গের জন্য যেখানে বাঁধ, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের জন্য সেখানে ট্রানজিট-সড়ক।
এক নবীর আঙুলের ইশারায় নীল নদ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল আর তিতাস ভাগ হলো ভারতেশ্বরের ইশারায়। নীল নদ ভাগ হয়ে গিয়েছিল স্রোতধারার স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী দুটি আলাদা আলাদা স্রোতধারায়। অলৌকিক উপকথায়ও যে বিভক্তি কল্পনা করা হয়নি, তিতাস সেই দুঃস্বপ্নকেই বাস্তবে পরিণত করেছে আড়াআড়ি দুই খণ্ড হয়ে গিয়ে। কিন্তু প্রতিদানে কী পাবে বাংলাদেশ? বিধাতা যেসব লাভের টোপ ঝুলিয়েছিলেন, সেগুলো এই কদিনেই আকাশের তারা হয়ে গেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে সান্ত্বনা দিতে বাকি থাকল শুধু সুকুমার রায়ের ‘পেনসিল’ আর রবীন্দ্রনাথের গান: ‘আমার যেসব দিতে হবে সে তো আমি জানি!’

ক্লিক দিস লিংক
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পুরোনো ধর্মের সমালোচনা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেই নতুন ধর্মের জন্ম

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:১৫

ইসলামের নবী মুহাম্মদকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে এক বছরের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে প্রবেশনে পাঠানোর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×