টেলিফোনটা বিপ বিপ করে অনেক্ষন ধরে বাজছে। চোখ মেলতে ইচ্ছে করছে না। খুব ক্লান্ত। টেলিফোন ধরতে ওপ্রান্ত থেকে হোটেলের কোনসিয়রেযের গলা ভেসে এল,
- শুভ সকাল স্যার। তোমার ঘুম ভাংগানোর জন্য দুঃখিত। তোমার গাড়ি এসে গেছে। ড্রাইভার জানাতে বলেছে ও কিছুটা আগেই এসেছে। লবিতে অপেক্ষা করছে। তুমি তোমার সময় নিয়ে এস।
-তোমার লাগেজ আনবার জন্য রুমে কি বেল বয় পাঠাব?- কোনসিয়রেয অতি আন্তরিকতার সাথে জানতে চায়।
-বেল বয় লাগবে না।ধন্যবাদ। ড্রাইভারকে বল আমি আধাঘন্টার মধ্যে নামছি।- আমি ঘুম জড়ানো গলায় উত্তর দিয়ে ফোন নামিয়ে রাখলাম।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৪টা ২৫ বাজে। তারমানে এল পাসোয় এখন ৩-২৫। নিউ অরলিন্স আর এল পাসোর সময়ের ব্যবধান ১ ঘন্টা। এত সকালে ঘুম ভাংগার কারনে চোখ জ্বালা করছে। গত আড়াই দিন ধরে আমি নিউ অরলিন্সে। নাসা হায়ার এডুকেশন অফিসের একটা মিটিং এসেছি। আজ সকাল ৬-৪৫ এর ফ্লাইটে এল পাসো ফেরত যাব।
মিটিং আর কনফারেন্সে সারাটা বছর আমেরিকার এপ্রান্ত ওপ্রান্ত ছুটতে হয়। মাঝে মাঝে গাড়ি রেন্ট করার পরিবর্তে এক্সিকিউটিভ লিমো সার্ভিস ব্যবহার করি। এরা এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে হোটেলে পৌছে দেয়, আবার সময়মত হোটেল থেকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যায়। রেন্টাল কার নেবার এবং ফেরত দেবার ঝামেলা থাকেনা, ঝামেলা থাকেনা ট্রাফিক আর পার্কিং এর। গাড়ি আসতে বলেছিলাম ৫টায়। ব্যাটা এসে বসে আছে সাড়ে ৪টায়, আর আসবিই যদি আমার ঘুম ভাঙ্গালি কেন, খুব মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
শেষ বার নিউ অরলিন্সে এসেছিলাম ১৯৯৯ সালে। তখন ছাত্র ছিলাম; এসেছিলাম একটা কনফারেন্সে পেপার পড়তে। প্রথম দেখায় এই অসম্ভব জীবন্ত শহরটাকে খুব ভাল লেগেছিল। নিউ অরলিন্স আমেরিকার যে কোন শহর থেকে একদম অন্যরকম। মিসিসিপি নদীর দুপাড় জুড়ে বেড়ে ওঠা লুসিয়ানা অঙ্গরাজ্যের এই শহরটির গোড়াপত্তন হয়েছিল সেই ১৮শ শতাব্দির একদম শুরুতে, ১৭১৮ সালে, ফ্রেঞ্চদের হাতে। সারা শহর জুড়ে রয়েছে ফ্রেঞ্চ স্থাপত্যের মোহনীয় ছোয়া। নিউ অরলিন্স নামটা এসেছে ফ্রেঞ্চ শহর অরলিন্স থেকে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে শহরটা চলে যায় স্প্যানিশদের হাতে। তারও গড়ে তোলে অনেক বাড়িঘর অট্টালিকা।স্প্যানিশদের তৈরি এইসব ঐতিহাসিক নিদর্শন টিকে আছে এখনও। ১৮০৩ সালে নেপলিয়ান লুসিয়ানা যুক্ত্ররাস্ট্রের কাছে বিক্রি করে দিলে, নিউ অরলিন্স আমেরিকার একটা শহর হয়ে যায়, আর বেড়ে উঠতে থাকে দ্রুত। ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, আর বিংশ শতাব্দির আমেরিকান সংস্কৃতির এক অপুর্ব মিলন মেলা এই নিউ অরলিন্স।
আমার কাছে নিউ অরলিন্সের সবচেয়ে প্রিয় জিনিশ হচ্ছে স্ট্রিট মিউজিশিয়ানরা। ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার বলে একটা জায়গা আছে নিউ অরলিন্সে, শহরের সবচেয়ে পুরানো জায়গা, শহরটা এখান থেকেই শুরু হয়েছিল। ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের রাস্তায় রাস্তায় অনেক মিউজিশিয়ান। কেউ ব্লুজ গিটার বাজচ্ছে, কেউ বা স্যক্সোফোণ, অদ্ভুত মাদকীয় এক পরিবেশ। আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিয়েছি ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের রাস্তায়। নিউ অরলিন্সকে বলা হয় জ্যাজ মিউজিকের জন্মস্থান। গতবার এক ব্লুজ গিটারিস্টের সামনে আমি টানা ২ ঘন্টা বসেছিলাম। একসময় বাজনো থামিয়ে কালো মানুষটা আবাক হয়ে আমার কাছে জানতে চায়, আমি কোথা থেকে এসেছি, আমি কি করে ভালবাসতে শিখেছি এই মিউজিককে। আমি বললাম,
-দশহাজার মাইল দুরের দেশের মানুষ আমি, তবু সুরের ভালবাসায় বিশ্বময়, আমার গিটারে তোমার প্রতিভা নেই, তবে জমে আছে একি কান্না।
লোকটা বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ করে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-আমি কেনান। তোমার নাম কি? তুমি যদি পাশের দোকান থেকে আমাকে একটা স্যান্ডউইচ কিনে দেও তবে আমি তোমাকে তোমার পছন্দের একটা সুর বাজিয়ে শোনাব।
আমি একটা স্যান্ডউইচ, ফ্রাইস, আর একটা সোডা কিনে নিয়ে ওর হাতে দিতে বলল “কোন সুর শুনতে চাও?”
আমি বললাম,
-আমাকে জর্জ হ্যারিসনের “While My Guitar Gently Weeps” বাজিয়ে শোনাও।
-আমি এ জাতীয় সুর বাজাই না, তবে তোমার জন্য বাজাব। তবে আমার মত করে- কেনানের গলায় তাচ্ছিল্যের সুর।
এর পরের ২০টা মিনিট আমার কাটল এক অতিপ্রাকৃতিক সুরের ঘোরে। কেনানের গিটারে জর্জ হ্যারিসনের এই গান পেল এক অন্য উচ্চতা। জ্যাজ এবং রিদম আর ব্লুজ মিশিয়ে ও যা বাজাল, সে সুরের সাথে আমার কোনদিনই দেখা হয়নি।
ওর বাজান যখন শেষ হল, তখন আমি রাস্তার উপরে বসে আছি। আমার দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। দেখি আমাদের চারিদিকে অনেক লোক জমে গেছে। একটা কালো মানুষ গিটার বাজাচ্ছে, আর তার সামনে একটা এশীয় ছেলে বসে কাঁদছে, এটা একটা অবাক করার মতই দৃশ্য। ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারে তখন সন্ধ্যা নামছে। কিন্ত আমার কাছে সবকিছু আলোমোয়। ভাবছি পৃথিবীটা এত আনন্দময় কেন।
চলবে