somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কে এই হযরত - ০১

৩০ শে মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৪:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ।
বৃটিশশাসিত ভারতের প্রখ্যাত এক সাধক ও বুযুর্গ আলেমকে তিনি মনে প্রাণে ভালোবাসেন। তাকে ঢাকায় আসার জন্য বারবার নিমন্ত্রণ পাঠাতেন। নবাবের বিশেষ নিমন্ত্রণ পেলে যে কেউ সাদরে তা শুধু কবুল নয়, লাব্বায়েক বলে হাজির হয়ে যান।
কিন্তু বিপত্তি ঘটেছে এ বুযুর্গের বেলায়। যা দেখে নবাব শুধু অবাক নয়, বিস্মিত ও শ্রদ্ধাবনত হতবাক হয়েছিলেন। কারণ তিনি বিনাশর্তে নবাবের আমন্ত্রনে সাড়া দিচ্ছেন না।

এর অনেকগুলো কারণ ছিল। এ হযরতের কাছে প্রতিদিন যে হারে আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ এসে পৌঁছত, এর শতকরা দশটি গ্রহণ করলেও বছরের ৩৬৫ দিন তাকে ঘরের বাইরেই কাটাতে হবে। তাই তিনি অনেক বেছে বেছে প্রয়োজন বুঝে এবং বেশকিছূ কঠিন শর্ত দিয়ে তা কবুল করতেন এবং সফরে বের হতেন।

ঢাকার নবাবের বিশেষ দাওয়াত পেয়েও তিনি আকুল হলেন না। তার মধ্যে আহ্লাদের কোন ভাব দেখা গেল না। দিনের যে সময়টুকু তার চিঠিপত্রের উত্তর লেখার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন,
দালানের বারান্দায় বসে আছেন নবাব সাহেব। খাদেম এসে চিঠি দিয়ে গেছে এই মাত্র। ফুরফুরে বাতাস চারিদিকে। চিঠিপ্রেরকের নাম দেখে নড়ে চড়ে বসলেন তিনি। খুব ধীরে খাম থেকে পত্রটি বের করলেন।

চিঠিতে লেখা, বিশেষ বিবেচনায় নবাব সাহেবের এ আমন্ত্রণ তিনি গ্রহন করবেন। তবে তাতে কিছু শর্ত যোগ হবে। হযরত লিখেছেন, ‘আমাকে কোন হাদিয়া (টাকা-পয়সা বা অন্য কোন বস্তু) দেয়া যাবে না। ঢাকায় আমার অবস্থানের জন্য এমন জায়গায় ব্যবস্থা থাকতে হবে- যা নবাবী খাস মহল থেকে দূরে এবং যেখানে সাধারণ মুসলমানরা অনায়াসে আসতে পারেন। কোন বিশেষ নির্ধারিত বিষয়ে ওয়াজ করার জন্য আমাকে অনুরোধ করা যাবে না।’ এতে আপত্তি না থাকলে তিনি সফরের দিন তারিখ নির্ধারণ করে পত্র মারফত জানিয়ে দিবেন।

নবাব সলিমুল্লাহ চিঠিতে এমন অদ্ভুত শর্ত দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। হযরতকে কাছ থেকে দেখার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠছে। তিনি সাদরে বিনা বাক্যে সবগুলো শর্ত মাথাপেতে মেনে নিলেন।
এর কিছুদিন পর। নতুন চিঠিতে হযরত তাকে সফরের দিন তারিখ জানিয়ে দিলেন।
ঢাকার নবাব তার পরম শ্রদ্ধেয় এ মানুষটির সম্মতি পেয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কিভাবে তাকে স্বাগত জানাবেন- এ নিয়ে উপদেষ্টাদের সাথে তার রোজ পরামর্শ হচ্ছে। তিনি কোথায় থাকবেন, কি কি খাবেন- তার সফরসূচী ঠিক করার জন্য বারবার কাগজ কলমে কাটাকাটি করছেন তিনি।
সাধ্যের সবটুকু শ্রম দিয়ে হযরতকে স্বাগত জানাতে চান তিনি। তাই তার জন্য নবাবী আয়োজন করতে বলে দিলেন মহলের সবাইকে। রাস্তায় রাস্তায় পতাকা, তাকে সম্মান জানাবে নিরাপত্তা বাহিনী, তার জন্য রাজপথে বিছানো হবে লাল ফরাস।

হযরত ঢাকা থেকে তার ভক্ত মুরিদের চিঠিতে নবাবের এসব আগ্রহ এবং আযোজনের খবর পেলেন। জীবনভর নিরবতায় তন্ময় হয়ে থাকা তার অভ্যাস। এসব রঙিন সাজসজ্জা ভালো লাগে না তার। পরদিনই তিনি চিঠি পাঠিয়ে নবাবকে আবারও জানালেন, তাকে স্বাগত জানাতে কোন আয়োজন তার প্রয়োজন নেই। নবাবী আয়োজন আর পথে পথে জনসমাগম তিনি এড়িয়ে চলতে চান।
চিঠি পেয়ে নবাব সলিমুল্লাহ থমকে গেলেন। সবাইকে ডেকে তিনি সাধারণ ব্যবস্থা করার জন্য বললেন, একজন বুযুর্গকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে যা যা প্রয়োজন- শুধু সেটুকু করার জন্য বলে দিলেন। এসব করতে গিয়ে কোথাও যেন কোন বাহুল্য কিংবা বেআদবী না হয়, সবাইকে সতর্ক করে দিলেন।
নির্ধারিত দিনে তিনি ঢাকায় পৌঁছলেন। কোন আয়োজন কিংবা নেটিশ-বিজ্ঞাপন ছাড়া অসংখ্য মানুষের ভীড়ে গমগম করছিল পুরো স্টেশন। যথাযথ আদব ও বিনয়ের সাথে নবাব তার অতিথি পরম শ্রদ্ধেয় হযরতকে নিজের গাড়ীতে বসালেন। আর তিনি নিজে চড়লেন অন্য গাড়ীতে। তার এক খাদেম বললো, হুজুর! আপনিও তো হযরতের সাথে গাড়ীতে বসতে পারেন। নবাব জানালেন, তোমরা তাকে চিনো না বলেই এ প্রশ্ন করছো। এমন মানুষের সাথে এক আসনে বসা আমার কাছে আদবের খেলাফ মনে হয়।’

যে কয়দিন হযরত ঢাকায় ছিলেন, নবাব তার পুরো আন্তরিকতা, বিনয় ও ভালোবাসা উজাড় করে তাঁকে সমাদর করেছেন। ব্যস্ততা কমিয়ে তিনি তার আশেপাশে বসে থাকতেন। অন্দরমহলের বেগমদের দিয়ে নতুন নতুন খাদ্য রান্না করিয়ে খাওয়ার সময় তিনি নিজের হাতে তা পরিবেশন করতেন হযরতের দস্তরখানে।
্এ কয়েকদিনে তিনি হযরতের সান্নিধ্যে অন্যমানুষ হয়ে গেলেন। এত বড় একজন বুযুর্গ এবং অগণিত মানুষের পরম শ্রদ্ধেয় হয়েও তার বিনয় ও ব্যবহার দেখে নবাব বিগলিত হলেন। তার নীতি ও আদর্শ দেখে প্রভাবিত হলেন তিনিও। একদিন সুযোগ বুঝে তিনি বাইআত হতে চাইলেন হযরতের হাতে। বাকী জীবন তিনি তার পরামর্শ ও আদেশমতো কাটিয়ে দিতে চান। কিন্তু সাফ জানিয়ে দিলেন হযরত, মুহতারাম নবাব, আপনাকে আমি সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি। সেজন্যই আপনাকে মুরিদ করতে পারছি না। দেখুন, যাদেরকে খাতির করতে হয়, তাদেরকে মুরীদ করা যায় না। কারণ ইসলাহ করার জন্য যাদেরকে ‘নালায়েক’ বলা না গেলেও অন্তত ‘তোমার কাজটা বড় নালায়েকের মতো’ বলা যাবে- তাদেরকে বাইআত করা যায়। আপনাকে তো এটুকুও বলতে পারব না। আপনি আমার সম্মানের মানুষ।’
বাইয়াত না হয়েও নবাব হযরতকে নিজের শায়খ এবং গুরু বলে মানতেন। বাকী জীবন অন্যের কাছে তার জীবন ও আদর্শ নিয়ে কথা বলতেন। নিজের যে কোন পরামর্শ কিংবা দুআর প্রয়োজনে তিনি চিঠি লিখতেন হযরতের কাছে। একজন নবাব হয়েও চিঠির নীচে নিজের নামের জায়গায় তিনি ‘আপনার মুরীদ সলিমুল্লাহ’ লিখতেন। বেশ কয়েকবার হযরত তাকে নিষেধ করে নিজের নাম সাধারণ ভাবে লিখতে বলেছেন। তবুও তিনি তা ছড়তে পারেননি। হযরতও ঢাকা থেকে গিয়ে নিজের মজলিসে প্রায়ই নবাবের ভদ্রতা ও ভালোবাসা এবং বিনয়ের কথা আলোচনা করতেন।

শুধু ঢাকা সফরে নয়। শুধু নবাবের বেলায় নয়। তার নিজের সারাজীবনের অভ্যাস ছিল সফরের অতিরিক্ত কোন টাকা পয়সা তিনি কখনোই নিতেন না। কিছু বেঁচে গেল তা মেজবানকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দিতেন। গ্রহণ করতেন না কোন আলাদা হাদিয়া কিংবা কোন উপটৌকন-উপহার।
নবাব সাহেব তার সফরের জন্য যে পরিমাণ খরচ পাঠিয়েছিলেন- ঢাকা থেকে ফিরে যাওয়ার পর তিনি জানলেন, কিছু টাকা এখনও রয়ে গেছে। তিনি ভাবলেন, এ টাকা ফেরত পাঠালে নবাব সাহেবের মনে কষ্ট লাগবে, তাই তার মর্যাদার দিকে লক্ষ রেখে তিনি তা ফেরত পাঠাননি। বরং এ টাকা দিয়ে মসজিদের অযুখানার জন্য টিন কিনে ছাউনী বানিয়ে দিলেন। তারপর নবাব সাহেবকে বিষয়টি জানিয়ে খুশি হওয়ার জন্য চিঠি পাঠালেন।

এতে টাকাগুলো নিজের কাছেও থাকলো না বরং ভালো কাজে ব্যবহৃত হলো এবং নবাব সাহেবও তার টাকার খরচ ও খাত সম্পর্কে জানতে পারলেন।

এতক্ষণ যে সাধক ও বুযুর্গ মানুষটির এমন সচেতনতা ও নীতিপরায়ণতা দেখছিলেন, পাঠক হয়তো কপাল কুঁচকে দিয়ে ভাবছেন, কে এই হযরত? কী তার পরিচয়? কেনইবা নবাব সাহেব তার জন্য এত উদগ্রীব হলেন? তার সব শর্ত মেনে তাকে সম্মান দেখালেন?

তার জীবনের গল্প বলার মধ্যেই চলে আসবে তার নাম। চলবে আগামী পর্বগুলোতেও........
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৫:০৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠিক কোন বিষয়টা মৌলবাদী পুরুষরা শান্তি মত মানতে পারে???"

লিখেছেন লেখার খাতা, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৭


ছবি - গুগল।


ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম এখন আর শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নয়, রোজগার এর একটি চমৎকার প্ল্যাটফর্মও। একটু স্মার্ট এবং ব্রেন থাকলে ফেসবুক/ইনস্টাগ্রাম থেকে রোজগার করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধখানা ভ্রমন গল্প!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৩৯


২০০২ সাল বান্দারবানের রিগ্রিখ্যাং-এর এই রিসোর্ট আজ সকালেই আমরা আবিস্কার করলাম! পাহাড়ের এত উপরে এই মোড়টাতে একেবারে প্রকৃতির মাঝে এমন একটা রিসোর্ট থাকতে পারে তা আমরা সপ্নেও কল্পনা করিনি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×