somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযুদ্ধে শত্রুমুক্ত প্রথম জেলা যশোর নয় পাবনা : যশোর মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর আর পাবনা মুক্ত হয় ৩০ মার্চ

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এম. মিজানুর রহমান সোহেল

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। সকাল ও দুপুরে পাকিস্তানের নবম ডিভিশনের সঙ্গে ভারতীয় নবম পদাতিক ও চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রচন্ড লড়াই হয়। বিকেলেই পাক সেনা অফিসাররা বুঝে যান, যশোর দুর্গ আর কোনভাবেই রক্ষা করা সম্ভব নয়। বেনাপোল অঞ্চলে দায়িত্বরত লে. কর্নেল শামসকে নওয়াপাড়ার দিকে দ্রুত সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন ব্রিগেডিয়ার হায়াত। আর নিজের ব্রিগেড নিয়ে রাতের আঁধারে খুব গোপনে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে তিনি পালিয়ে যান খুলনার দিকে। ৬ ডিসেম্বর এভাবেই একাত্তরে প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা হওয়ার গৌরব অর্জন করে যশোর। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা হিসেবে আমরা এভাবেই ইতিহাস জানি। কিন্তু তারও আগে যে আরেকটি জেলা শত্রুমুক্ত হয়েছিল তা আজ আমরা ভুলতে বসেছি। শুধু তাই নয় বরং সেই জেলাটিকে আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা হিসেবে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়নি।

অথচ ধ্রুব সত্য হচ্ছে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশে সর্ব প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা হওয়ার গৌরব অর্জন করে পাবনা। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষনে স্বাধীনতার ডাক দিলে পাবনার আপামর জনতা দেশকে স্বাধীন করতে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ২৫ মার্চ পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ নুরুল কাদের খান পাবনার সর্বস্তরের জনগণকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ ও পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য আহ্ববান জানান। তার আহ্ববানে সাড়া দিয়ে পাবনা পুলিশ লাইনে সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক জনতা উপস্থিত হলে জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার উন্মুক্ত করে দেন দেশ মাতৃকার টানে উদ্ধুদ্ধ হয়ে।

এদিকে একইদিন বিকেলে শহরের কৃষপুর মহল্লার শহীদ শুকুরের জানাজার নামাজে পাকিস্তানী সেনারা গুলি চালালে আব্দুস সামাদ নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। আহত হন আরো অনেকে। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র, জনতা, বাঙ্গালী পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা সমবেতভাবে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাদের উপরে হামলা চালায়। ২৭ ও ২৮ মার্চ দুইদিনব্যাপী তুমুল যুদ্ধে ২৮ জন পাকিস্তানী বর্বর সেনা নিহত হয়। অন্য পাকবাহিনীর সদস্যরা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ থেকে পালিয়ে পাবনা শহরের অদুরে বিসিক শিল্প নগরীতে আশ্রয় নেয়। মুক্তিকামী জনতা বিসিক শিল্পনগরী আক্রমন করার পরিকল্পনা নেয়। পাকিস্তানী সেনারা বিসিক শিল্প নগরীতে অবস্থান করা নিরাপদ নয় ভেবে ঢাকায় ওয়ারলেস যোগে সংবাদ পাঠালে ২৮ মার্চ পাকিস্তানী বিমান বাহিনী এসে পাবনা শহরে বিমান থেকে গুলি বর্ষণ করে এবং পাকিস্তানী সেনাদের পাবনা ত্যাগের নির্দেশ দেয়। ৩০ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী'র ১শ' ৮০ জন সদস্য সড়ক পথে পাবনা-পাকশী সড়কের দাশুড়িয়া নামক স্থান দিয়ে পালানোর সময় মুক্তিকামী জনতা তাদের উপর গেরিলা হামলা চালালে সকল পাক সৈন্য নিহত হয়। এ হিসাবে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাবনা ৩০ মার্চ পাকিস্তানী শত্রু মুক্ত হয়।
পাবনা জেলার আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রন ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য শহরের টেকনিক্যাল ইনষ্টিটিউটে গঠন করা হয় বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল। জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার দাশুড়িয়ায় এক সন্মুখযুদ্ধে প্রচুর সংখ্যক পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। এতে তীব্র পরাজয়ের গ্লানী সহ্য করতে না পেরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ওঠে। ৪ এপ্রিল থেকে পাকিস্তানী সেনাদের একটি ব্যাটেলিয়ান ঢাকা থেকে আরিচা ঘাট হয়ে পাবনা নগরবাড়ীতে প্রবেশের চেষ্টা চালায়। সংবাদ পেয়ে পুলিশ ও ইপিআর সদস্যের সাথে ছাত্র জনতা সম্মিলিতভাবে নগরবাড়ী ঘাটে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৪ এপ্রিল থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানী সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ৩০ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পাবনা ছিল শত্রু মুক্ত থাকে। এরপর শক্তি বৃদ্ধি করে নৌ ও বিমান বাহিনীর সহায়তায় হানাদার বাহিনী নগরবাড়ী ঘাটে প্রবেশ করে ত্রিমূখী হামলা চালায়। ১০ এপ্রিল সকালে নগরবাড়ী থেকে পাবনায় প্রবেশের সময় পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা রাস্তার দু'পাশের অসংখ্য ঘরবাড়ী ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে এবং ব্যাপক লুটপাট চালিয়ে অগণিত মানুষকে হত্যা করে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পাবনায় প্রবেশ করে পাবনা শহরের সার্কিট হাউস, নুরপুর ডাকবাংলো ও সরকারী এডওয়ার্ড কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে।

জুলাই মাসে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা এসময় পাবনায় প্রবেশ করে। পাবনায় এসেই মুক্তিযোদ্ধারা জেলার সুজানগর, আটঘরিয়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, সাতবাড়িয়া, দ্বিপচীর, ঢালারচর, টিকরী, বাঁশেরবাঁদা, নাজিরপুর, দাপুনিয়া, আওতাপাড়া, চরশানিকদিয়ার, চরসদিরাজপুর ও মাধপুরসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। এখানে উল্#৮ে;৭২২;খ্য পাবনা জেলা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৭ নং সেক্টর। মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার ছিলেন মেজর কাজী নুরুজ্জামান। অপরদিকে এ সেক্টরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ১২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর নেওয়াজ খান। পাবনায় মুক্তিযোদ্ধারা রফিকুল ইসলাম বকুল, বেবী ইসলাম, মকবুল হোসেন সন্টু, ইকবাল হোসেন প্রমূখের নেতৃত্বে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের পাবনায় আগমনের পর থেকেই পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যায়। পাকিস্তানী সেনাদের যাতায়াতের বিঘ্নসহ মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের কৌশলে'র জন্য বেশকিছু কালভার্ট ও ব্রীজ উড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানী সেনারা জেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিকামী জনতার উপর বর্বরোচিত হামলা চালায়। চরশানিকদিয়ারে পাকসেনাদের হাতে শহীদ হয় সেলিম, হামিদ, দিলু, আফতাবসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। ৮ আগষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ পাবনা পাওয়ার হাউজ ধ্বংস করতে এসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন।
পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলেও পাবনা চূড়ান্ত শত্রুমুক্ত হয় এর দু'দিন পর অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বরে। ১২ ডিসেম্বর পাবনার মুজিব বাহিনী প্রধান রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে জেলার সুজানগর থানা আক্রমন করে মুক্তিযোদ্ধারা। দুইদিন তুমুল যুদ্ধের পর ১৩ ডিসেম্বর সুজানগর থানা শত্রু মুক্ত হয়। ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পাবনায় ব্যাপক ভাবে বিমান হামলা চালায়। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ত্রিমুখী পজিশন নিয়ে ব্যাপক হামলা চালায়। দুইদিন একটানা তুমুল যুদ্ধের পর ১৮ ডিসেম্বর পাবনার দামাল মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের পরাজিত করে কালেক্টরেট ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে পাবনাকে চূড়ান্ত শত্রুমুক্ত করে।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাবনা যেহেতু প্রথম এবং ১০ দিনের জন্য হলেও (৩০ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল) শত্রুমুক্ত ছিল তাই আমাদের দাবি সরকারিভাবে পাবনাকে প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হোক। পাবনার মুক্তিযোদ্ধাদের অর্জিত এই সত্য গৌরবের অধিকারী একমাত্র পাবনাবাসীরই কাম্য এবং নৈতিক অধিকার।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০, কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×