বাংলার বুদ্ধিজীবীদের লাশ ডোবায় পড়ে আছে/ ঢাকা থেকে নিকোলাস টোমালিনের প্রতিবেদন, নিউজ উইক, ২০শে ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
(১৯৭১-এ বাংলাদেশে সংঘটিত ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার 'পরে ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থটির নাম "Bangladesh Genocide & World Press"। জনাব ফজলুল কাদের কাদেরীর সম্পাদনায় এ বইটিতে বিশ্বের ৫৪টি দেশের ১৩৭টি খ্যাতিমান পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশে গণহত্যা বিষয়ক রিপোর্ট, কভার স্টোরি, ফিচার ইত্যাদি ১৫ই মার্চ'৭১ থেকে '৭২-এর ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৩-এ সংঘ প্রকাশনের পক্ষ থেকে প্রায় ৪৫০ পৃষ্ঠার এ বইটির বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা বিষয়ক নিবিড় গবেষণা এবং গ্রন্থাদি প্রকাশের কোনোই বিকল্প নেই। "বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস" বইটি থেকে ২৫শে মার্চ ও পরবর্তী গণহত্যার বিষয়ে টাইম ম্যাগাজিনের কভার স্টোরির হুবহু বঙ্গানুবাদ তুলে দিচ্ছি।)- প্রকাশকঃ সংঘ প্রকাশন।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় আত্মসমর্পণ করার আগে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রাজধানীতে তখনো বেঁচে থাকা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ৫০ জনেরও বেশিকে গ্রেপ্তার করে গুলি করে হত্যা করে। বিশিষ্ট বাঙ্গালী নাগরিকদের নিশ্চিহ্ন করার এক সুচিন্তিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঝটিকা সামরিক অপারেশন চালিয়ে এ কাজটি করা হয়। কাজেই কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজীসহ পাকিস্তানী হাইকমান্ড এ ব্যাপারে পূর্ণমাত্রায় অবগত ছিল।
বুদ্ধিজীবীদের এই লাশ পাওয়ার ঘটনা ঢাকাতে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলবে। এতে প্রতিশোধমূলক হত্যা ও দাঙ্গার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। এমনকি মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে সংঘাতও সৃষ্টি হতে পারে।
হত্যাকাণ্ডের শিকার বুদ্ধিজীবীদের লাশগুলো পাওয়া যায় নগরীর উপকন্ঠের রায়ের বাজারে এক ডোবায়। আমি নিজে সেখানে ৩৫টি লাশ দেখেছি। পচনশীল লাশগুলো দেখে মনে হয়, ৪ থেকে ৫ দিন আগে তাদের হত্যা করা হয়েছে। তবে আরো অনেককেই হয়তো এভাবে হত্যা করা হয়েছে। অপহরণের খবরানুযায়ী অনেকে ধারণা করছেন, নিহতের সংখ্যা ১৫০ পর্যন্ত হতে পারে।
ইউপিআই’র খবরে বলা হয়, নিহতের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ ফজলে রাব্বী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ডঃ মুনীর চৌধুরী।
হত্যাকাণ্ডের স্থানটির অবস্থান ঢাকার মধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি ছাড়িয়ে একটি ইটের ভাঁটায়। ডোবার মধ্যে ফুটে থাকা কচুরিপানার ফুলের শোভা সত্ত্বেও জায়গাটা অদ্ভূত রকমের বিরান। ঢাকার শত শত লোক জায়গাটা দেখতে আসেন। তাদের অনেকেই নিজেদের আপনজনকে খুঁজছিলেন।
সম্ভবত গত মঙ্গলবার ভোরে এদেরকে অপহরণ করা হয়। পাঞ্জাবী সৈন্যদের স্কোয়াড ঠিকানা ধরে ধরে হানা দেয় এবং সশস্ত্র পাহারায় আটককৃত নারী ও পুরুষদের নিয়ে যায়। তাদেরকে সম্ভবত রায়েরবাজারের ইট-ভাটাতেই নিয়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ গুলি করা হয়। লাশগুলো যাতে ডোবায় পড়ে, সেজন্য তাদেরকে মাটির তৈরি গর্তের ধারে লাইন করিয়ে গুলি করা হয়।
বুদ্ধিজীবীদের লাশগুলো এখনো সেখানে পড়ে আছে। পচতে শুরু করা তাদের শরীরে জমেছে ধূলোর স্তর। বাঁধের ওপর এক জায়গায় বেওয়ারিশ কুকুরের টেনে তোলা এক কঙ্কালের নগ্নতা চোখকে ধাক্কা মারছিল।
অদ্ভূত আর শান্ত এক ভঙ্গিতে জনতা ডোবাগুলো ঘুরে দেখছিল। এখানে তাদেরকে বিক্ষুব্ধ মনে হচ্ছে না। অন্যত্র তারা ছিল উদ্দাম। কিন্তু এখানে তারা ধীরপদে হাঁটছে, কথা বলছে অস্ফুটস্বরে যেন কোনো ক্যাথিড্রালে আসা টুরিস্টের মত।
একটা ডোবায় দেখা গেলো বেশ বড়সড় ভিড়। সেখানে লাশের সতূপটাও সবচেয়ে বড়। ডোবার পাশে একজন লোক আহাজারি করছিল। মাফলার দিয়ে মুখ চেপে আছে সে। তার কন্ঠনিঃসৃত শব্দকে মোয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনির মতো মনে হলো আমার কাছে।
লোকটার কাছে তার পরিচয় জানতে চাইলাম আমরা। সে বললো তার নাম আবদুল মালেক, ঢাকার একজন ব্যবসায়ী। সামনের পানিতে পাশাপাশি পড়ে থাকা তার তিন ভাই বদরুজ্জামান, শাহজাহান এবং মুল্লুকজাহানের লাশ সে সনাক্ত করতে পেরেছে। তারাও ঢাকায় ব্যবসা করতো। পারিবারিক একটা ব্যবসা ছিল তাদের। আব্দুল মালেকের আর কোনো ভাই নেই ।
মালেক বললো, “মঙ্গলবার সকাল ৭টায় পাকিস্তানী সৈন্যরা ওদের ধরে নিয়ে যায়। কাকতালীয়ভাবে আমি সেদিন একটু আগেই উঠে বাইরে গিয়েছিলাম।”
এই পর্যায়ে আমার সঙ্গীটি কাঁদতে শুরু করলো, সে ঢাকার এক ছাত্র। নাম নাজিউর রহমান। সে-ই আমাকে পথ দেখিয়ে এই ইটভাটিতে নিয়ে এসেছে। নাজিউর তার বোনের স্বামীকে খুঁজছিলো। অক্সফোর্ডের পিএইচডি-ধারী ডঃ আমিনউদ্দীন বেঙ্গল রিসার্চ ল্যাবরেটরিজের প্রধান। মঙ্গলবার সকাল ৭টায় পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
রহমান বললো, “আমি দুঃখিত, আমাকে উনার খোঁজ করতে হবে এখন।” তার মাফলারও এখন মুখে উঠে এসেছে।
আমি গতকাল মাত্র তিন ঘন্টা ঢাকায় ছিলাম। এ খবরটা তখনো ছড়ায়নি বললেই চলে। জনতাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল, কিন্তু তারা ছিল বেশ সুশৃঙ্খল । তখনো তারা হাসিমুখে ভারতীয় সৈন্যদেরকে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিল এবং ইতস্তত এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছিল।
কিন্তু বেশকিছু গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, বিশেষ করে রাতে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থানরত সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি বিস্ফোরণোমুখ। লোকজন অভিযোগ করছে যে, সীমান্তের ওপার থেকে আসা মুসলিম বিহারীরা বাঙ্গালীদের হত্যা করতে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাহায্য করছে।
আট মাস আগে আমি যখন যশোরে ছিলাম তখন ঠিক এ কারণেই সেখানে এক দাঙ্গা বাঁধে এবং বেশ কিছু বিহারীকে হত্যা করা হয়।
ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের এই হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে যশোরে যা ঘটেছিল, তার চেয়ে অনেক খারাপ ব্যাপার। কাজেই কিছু প্রতিশোধমূলক ঘটনা অনিবার্য।
নানান গুজব-গুঞ্জন আর অন্যান্য সাংবাদিকের মুখে এ ধরনের প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডের কথা শোনা ছাড়া আমি নিজে কেবল মুক্তিবাহিনীর দু’জন তরুণের কথা বলতে পারি। তারা আমাকে গাড়ি চালিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়েছিল। পারভেজ মামাসালেক নামে তাদের একজন আমাকে গর্বভরে বললো, আগের দিন সে বিহারী খুঁজে বেড়িয়েছে।
‘‘আমরা হঠাৎ কিছু গুলির শব্দ শুনতে পাই। আগেই জানতে পেরেছিলাম এই বেজন্মা বিহারীরা আমাদের ছেলেদের হত্যা করছে। আমরা ওদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলি। স্টেন হাতে আমাদের দু’জন ওদের বাড়িতে ঢোকে।” বিহারীরা বাগানের একটা গাছে গিয়ে উঠেছিল। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ওদের কাকের মতো গুলি করে মারে। “অবশ্যই আমরা ওদের মেরেছি। ওরা এতদিন আমাদেরকে মেরেছে।”
১৪ই ডিসেম্বর, রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীর লাশ।
"বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা..." .
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
স্বর্গের নন্দনকাননের শ্বেতশুভ্র ফুল কুর্চি
কুর্চি
অন্যান্য ও আঞ্চলিক নাম : কুরচি, কুড়চী, কূটজ, কোটী, ইন্দ্রযব, ইন্দ্রজৌ, বৎসক, বৃক্ষক, কলিঙ্গ, প্রাবৃষ্য, শক্রিভুরুহ, শত্রুপাদপ, সংগ্রাহী, পান্ডুরদ্রুম, মহাগন্ধ, মল্লিকাপুষ্প, গিরিমল্লিকা।
Common Name : Bitter Oleander, Easter Tree, Connessi Bark,... ...বাকিটুকু পড়ুন
সচলের (সচলায়তন ব্লগ ) অচল হয়ে যাওয়াটই স্বাভাবিক
যেকোন ব্লগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর, একটি ভয়ংকর খারাপ খবর; ইহা দেশের লেখকদের অদক্ষতা, অপ্রয়োজনীয় ও নীচু মানের লেখার সরাসরি প্রমাণ।
সচল নাকি অচল হয়ে গেছে; এতে সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন
হরিপ্রভা তাকেদা! প্রায় ভুলে যাওয়া এক অভিযাত্রীর নাম।
১৯৪৩ সাল, চলছে মানব সভ্যতার ইতিহাসের ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। টোকিও শহর নিস্তব্ধ। যে কোন সময়ে বিমান আক্রমনের সাইরেন, বোমা হামলা। তার মাঝে মাথায় হেলমেট সহ এক বাঙালী... ...বাকিটুকু পড়ুন
ছেলেবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনারই মেরেছে এমপি আনারকে।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন!
এই হত্যার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন
টাকা ভাংতি করার মেশিন দরকার
চলুন আজকে একটা সমস্যার কথা বলি৷ একটা সময় মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল৷ চাইলেই টাকা ভাংতি পাওয়া যেতো৷ এখন কেউ টাকা ভাংতি দিতে চায়না৷ কারো হাতে অনেক খুচরা টাকা দেখছেন৷ তার... ...বাকিটুকু পড়ুন