somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিতীয় পুরুষ

২৯ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ৯:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক

“হ্যালো”।
“স্যার, একজন ভদ্রমহিলা এসেছেন আপনার সাথে দেখা করার জন্য। নাম রিনা খন্দকার”।
“এই নামে কাউকে তো আমি চিনিনা। বলে দাও স্যার ব্যস্ত আছে। আজ দেখা করতে পারবে না”।
“স্যার, উনি গত কালকেও এসে বসে ছিলেন। আপনি দেখা করেন নি। বলেছিলেন আজ দেখা করবেন”।
“বলেছিলাম নাকি? ঠিক আছে পাঠিয়ে দেও”।

কি যে হয়েছে আমার! আজকাল কিছু মনে রাখতে পারিনা। অফিসে ইদানীং কাজের চাপ পড়েছে খুব। মা খুব বেশি অসুস্থ, বাবা সারাদিন তার কাছে হাসপাতালে পরে থাকেন। আর আমিও সবকষ্ট ভুলে থাকার জন্য পৈত্রিক ব্যাবসায় মনোযোগী হবার চেষ্টা করছি।

“আসব স্যার?” দরজা খুলে উকি দিল একজন মাঝবয়সী মহিলা।
“জি আসুন। .. বসুন”।
মহিলা বসল। বোঝা যায় একসময় মহিলা অনেক সুন্দরী ছিলেন। বেশভুষা দেখেও মনে হচ্ছে সম্ভ্রান্ত ফ্যামিলির। “স্যার, আপনাকে কয়েকটা কথা বলার জন্য এসেছি”।
“একটু দ্রুত বলবেন কারন আমার সময় কম, হাতে অনেক কাজ”।
“জি আমি দ্রুতই বলব। আপনি একটু শক্ত হন, কথাগুলো হজম করা আপনার জন্য একটু ডিফিকাল্ট হবে”।
এবার আমি মহিলার প্রতি একটু মনযোগী হলাম। “আমি শক্ত আছি, আপনি বলুন”।
“আমি আপনার বাবা ফাহাদ চৌধুরীর ২য় স্ত্রী”।

যত শক্তই থাকিনা কেন, এই কথা হজম করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। কেউ যদি বলে আজ কেয়ামত হবে, তাও বিশ্বাস করব আমি। কিন্তু আমার বাবা গোপনে ২য় বিয়ে করেছেন এটা কোনমতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

মহিলা বলে চলেছে, “একসময় এই অফিসেই চাকরি করতাম। আমি ছিলাম আপনার বাবার প্রাইভেট সেক্রেটারি। আমার রুপে পাগল হয়ে আপনার বাবা আমাকে কাছে পেতে চেয়েছিল। সেইজন্য গোপনে আমাকে বিয়েও করে। ব্যাবসায়িক কাজের কথা বলে আমাকে নিয়ে বাইরে থেকে হানিমুন করে আসে। আমাকে কথা দিয়েছিল আপনার মা কে তালাক দিয়ে আমাকে ঘরে তুলে নেবে। কিন্তু সেই হানিমুন করে আসার পর আপনার বাবা আমূল বদলে গেল। আগের স্ত্রীর জন্য তার ভালবাসা উথলে উঠল। সব কিছু অস্বীকার করতে লাগল! কিন্তু আমিও কম যাই না। আপনার বাবার সাথে আমার সম্পর্কের সব প্রমান আমি রেখে দিয়েছিলাম। সব কিছু প্রকাশ করে দেয়ার ভয় দেখালাম। তারপর থেকে আপনার বাবা আমার ভরন পোষণের জন্য মাসে মাসে আমাকে ২০,০০০ টাকা করে দিত”।
এই পর্যন্ত বলে মহিলা থামল। আমি বললাম, “আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?”
“আর একটু আছে”।
“শেষ করুন, তারপর আমার যা বলার বলছি”।

মহিলা একটু হাসল। হাসিটা সুন্দর। হয়ত আগে আরও সুন্দর ছিল। মহিলা সম্বোধনটা আপনি থেকে তুমিতে নামিয়ে আনল, “তোমাকে বলতে বাঁধা নেই, আমি ভাল মেয়ে ছিলাম না। তোমার বাবা যা দিত তা দিয়ে আমার মোটামোটি চলে যেত! বোঝোই তো! রুপ যৌবন ছিল বলে ফাহাদের মত দুই একজন জন জুটিয়ে নিতে সমস্যা হতনা। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল বয়স হবার পর। এখন আর আগের মত কাটতি নেই! ওই ২০,০০০ টাকায় কি আর ঢাকা শহরে চলা যায়? তাই তোমার বাবাকে বললাম বরাদ্দ বাড়িয়ে দেবার জন্য। কিন্তু সে একদম না করে দিল। এখন তো আর তোমার বাবার দেখাই পাওয়া যায় না!”
মহিলা আবার একটু থামল। আমিও চুপ করে থাকলাম। মহিলা বলল, “এতক্ষন বসে আছি একটু চা নাস্তার কথা বলা উচিৎ ছিলনা তোমার?”
“আপনি আপনার কথা শেষ করুন”।
“কথা আর বিশেষ কিছু নেই, আমার বরাদ্দ বাড়িয়ে দিতে হবে। মাসে মাসে ৪০,০০০ টাকা পেলে আমি আমার মুখ বন্ধ রাখব। ব্যাস!”
আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, “আমি আপনার একটা কথাও বিশ্বাস করিনি”।
মহিলা তিক্ত ভঙ্গীতে হাসল, “আমি জানতাম তুমি বিশ্বাস করবে না। তাই কিছু নমুনা সাথে করে নিয়েই এসেছি। মহিলা হ্যান্ডব্যাক থেকে একটা এনভেলপ বের করল। আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল। এর মধ্যে ফাহাদ আর আমার অন্তরঙ্গ কিছু ছবি আছে, মোবাইলে তুলেছিলাম। দেখার আগে বুঝে নাও সহ্য করতে পারবে কিনা!”

আমি নির্বিকারচিত্তে এনভেলপ খুললাম। কিন্তু প্রথম ছবিটি দেখেই আমার মনে হল যেন পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেছে। আমার বাবাকে আমি এই ভঙ্গীতে পোজ দেওয়া অবস্থায় কল্পনাও করতে পারিনা। পরের ছবিগুলো দেখার আর সাহস হলনা। আমি এনভেলপ বন্ধ করলাম।
মহিলা হাসতে হাসতে বলল, “বলেছিলাম না! সহ্য করতে পারবে না”!
“আমি বিশ্বাস করিনা। এই ছবি সত্য নয়। আজকাল ফটোশপে এইসব কাজ করা খুব সহজেই করা সম্ভব!”
“তাই নাকি?” মহিলা আবার একটু হাসল। “মোবাইলে করা দুই ঘণ্টার ভিডিও ফুটেজ আছে! সেটাও বুঝি ফটোশপে করা! বিয়ের কাগজ পত্র, হানিমুনে যাওয়ার প্লেনের টিকেট, যে হোটেলে থেকেছি তার কাগজ পত্র সহ সব কিছুই বুঝি ফটোশপে করা? তুমি বিশ্বাস কর আর না কর! আদালতে এটা বিশ্বাস করানো আমার জন্য মোটেও কঠিন হবেনা! তুমি কি চাও আমি তাই করি? নাকি টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ রাখবে”।
আমি ঠিকমত ভাবতে পারছি না কিছু। আমার বিশ্বাস নড়ে গেছে। সারাজীবন ভেবে এসেছি আমার বাবা একজন আদর্শ মানুষ। আজ তার ঘৃণ্য অতীত দেখে আমি শিউরে উঠছি। “প্লিজ আমাকে একটু সময় দিন। আমি কোনও কিছু ভাবতে পারছি না!”
মহিলা বলল, “ঠিক আছে, আমি দু দিন বাদে আসছি। এর মধ্যে আমার টাকা রেডি থাবে আশা করি”।

আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। আমার চেনাজানা পৃথিবীটা যেন উল্টে গেছে। আমি স্বাভাবিক ভাবে কিছু চিন্তা করতে পারছি। মহিলা চলে যাচ্ছিল, আবার পিছন ফিরে আমার দিকে তাকাল, “আর একটা কথা জানা দরকার তোমার...”
“আর কি জানতে বাকি আছে?”
“তোমার বাবা যে শুধু চরিত্রহীন ছিলেন তাই নয়। সে একজন খুনি!”
আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মহিলা বললেন, “তোমার বাবার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তার নাম ছিল শামিম। সে তোমার বাবার সব কুকীর্তি সম্পর্কে জানত। সে যেন মুখ খুলতে না পারে সে জন্য তাকে তোমার বাবা মেরে গুম করে ফেলেছিল!”
শামিম! হ্যা এই নামটা আমার পরিচিত! কারও মুখে বেশ কয়েকবার শুনেছি বলে মনে হচ্ছে!


দুই


সপ্তাহ খানেক যাবত মা হাসপাতালে। আমার মায়ের নানান ধরনের রোগ। গ্যাসটিক, আলসার, ডায়াবেটিকস, কিডনির সমস্যা, লিভারের সমস্যা সহ আরো নানা রকমের সমস্যা ধরা পরেছে। বাবা সারাদিন হাসপাতালে মায়ের কাছে পরে থাকে। তাই অফিসে সময় আমাকেই দিতে হয়। এইসময় বাবার এই ঘৃণ্য অতীত জেনে ফেলাটা আমার জন্য কত বড় আঘাত তা কাউকে বোঝাতে পারব না। বাবার সাথে কথা বলা দরকার। তাকে জানানো দরকার তার ভাল মানুষের মুখোশের আড়ালে কি লুকিয়ে আছে তা আমি জেনে ফেলেছি।

কিন্তু হাসপাতালে এসে যে দৃশ্য দেখলাম তারপর বাবাকে কিছু বলার সাহস হলনা। মায়ের কেবিনে ঢুকেই দেখি বাবা তার কোলের উপর মায়ের মাথাটা নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাবা নিরবে কাদছে, দুগাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে মায়ের কপালে টপ টপ পড়ছে। মায়ের দুচোখও ভেজা। এই মানুষটা আমার মাকে কতটা ভালবাসে তা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানেনা। এই মানুষটা আমার মাকে না জানিয়ে গোপনে একটা বাজে মেয়েকে বিয়ে করেছে? কিভাবে সম্ভব? মনে হচ্ছে এর মাঝে একটা কিন্তু লুকিয়ে আছে। সেই কিন্তুটা আমাকে খুজে বের করতেই হবে।
মায়ের চোখ পড়ল আমার উপর। কাছে ডাকল, “জুবায়ের! আয় বাবা। এদিকে আয়”।

আমি এগিয়ে গিয়ে মায়ের কাছে বসলাম। মা বলল, “তোর বাবাকে কাঁদতে না কর! পুরুষ মানুষ এভাবে কাঁদলে কেমন দেখায় বলত?”
বাবা ভাঙা গলায় বললেন, “যুবায়ের, তোর মায়ের কাছে একটু বসে থাক। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি”। আমার বাবার অনেক আগে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। সেই এক্সিডেন্টে তিনি গলায় আঘাত পেয়েছিলেন। তাতে ভোকালকর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার পর থেকেই তার একটু ভাঙা ভাঙা উচ্চারনে কথা বলেন।
বাবা পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেলেন কেবিন থেকে। বাবা চলে যেতেই মা বলল, “যুবায়ের তোর বাবাকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারিস না? পুরুষ মানুষ সারাদিন এভাবে কাঁদলে চলে? প্রত্যেকটা মানুষকে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হবে, কেউ আগে কেউ পরে। আমি না হয় একটু আগেই চলে যাচ্ছি!”
“এইভাবে বলনা আম্মু। তোমার কিছু হবেনা...” বলে আমিও চোখের পানি ছেড়ে দিলাম।
আম্মু বললেন, “তুইও তোর বাবার মতই”।
আমি চোখের পানি মুছে বললাম, “বাবা সম্পর্কে একটা কথা জিজ্ঞেস করি আম্মু?”
“হ্যা কর”।
“বাবা সবসময় এমন একলা একলা থাকে কেন? বাবার কোনও বন্ধু নেই? কক্ষনো তো কোনও বন্ধু বান্ধব দেখিনি তার!”
মা হাসলেন, “তোর বাবার বন্ধু বান্ধব নেই? তোর বাবার মত ফুর্তিবাজ মানুষ খুব কমই ছিল! বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা আর গান-বাজনায় মেতে থাকত সারাদিন”।
“তাহলে?”
“জানিনা। হঠাৎ করে তোর বাবা সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। একদম বন্ধ!”
“কেন?”
“ঐযে এক্সিডেন্টে ভোকালকর্ডে আঘাত লাগল। তার পর থেকেই সে এমন একলা একলা থাকা শুরু করল। মানুষের সাথে মিশত কম, কথা বলত কম, অফিস আর বাসাই ছিল তার ঠিকানা”।
“এমন কি হতে পারে যে বাবার সেই এক্সিডেন্টের পিছনে বাবার কোনও বন্ধুর হাত ছিল আর তাই বাবা এক্সিডেন্ট থেকে বাঁচার পর বন্ধু বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে?”
“হতে পারে!”
“বাবার খুব কাছের কোনও বন্ধু ছিল?”
“হ্যা, শামিম”।
“শামিম! এখন তিনি কোথায় আছেন বলতে পার?”
“তোর বাবা বলেছিল কোন একটা দুর্ঘটনায় সে মারা গেছে”।
আমার আরও কিছু জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু বাবা ফিরে আসায় আর প্রশ্ন করতে পারলাম না। বাবা আবার আম্মুর মাথার কাছে গিয়ে বসলেন। আম্মুর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলেন। এই মানুষটা আমার আম্মুকে পাগলের মত ভালবাসের। ইনি গোপনে একটা বাজে মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছেন, কাউকে খুন করেছেন এসব আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি বুঝতে পারছি সব রহস্য লুকিয়ে আছে শামিম নামের বাবার ঐ বন্ধুর অন্তর্ধানের মাঝে। যেভাবেই হোক আমাকে সত্য ঘটনা জানতে হবে!


তিন

দুই দিন পর.....

“আসব?”
“জী আসুন”।
রিনা খন্দকার আমার মুখোমুখি বসল।

গত দুদিনে আমি কিছু খোঁজ খবর করার চেষ্টা করেছি। মাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম বাবার বন্ধু শামিম আহমেদ একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করত। ভেবেছিলাম ২৫ বছর আগের কোনও এমপ্লয়ির খোঁজ বের করা সম্ভব হবেনা। কিন্তু সেই কোম্পানির অফিসে গিয়ে অত্যাধুনিক কম্পিউটারাইজড ডাটাবেজ ঘেঁটে শামিম আহমেদ নামের একজন পুরনো এমপ্লয়ির খোঁজ বের করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। সেখানে বলা হয়েছে ২৫ বছর আগে ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে শামিম আহমেদের কোনও খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে জানা যায় ১লা ফেব্রুয়ায়ারিতে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে তিনি মারা যান।

আমি দুর্ঘটনাটা নিয়ে বিস্তারিত জানার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির পেপার সেকশনে গিয়েছিলাম। দিন তারিখ মিলিয়ে দুর্ঘটনার দিনের কিছু দৈনিক পত্রিকা বের করলাম। পত্রিকা থেকে যা জানা গেল ঐদিন সায়েন্স ল্যাব এলাকায় একটা পিক আপ ভ্যান দিক হারিয়ে এসে রাস্তার পাশের পেট্রোল পাম্পের তেলের ট্যাংকারে ধাক্কা খায়। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। আশে পাশের বেশ কিছু গাড়ির ড্রাইভারও নিয়ন্ত্রন হারিয়ে এসে ধাক্কা খায়। ফলে আরও দুইবার বিস্ফোরণ ঘটে। এই ঘটনায় ১৪ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। যারা নিহত হয় তাদের মধ্যে কয়েক জনের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। যাদের নাম ঠিকানা জানা গেছে তাদের মধ্যে শামিম আহমেদ নামে কেউ ছিলনা। এ থেকে শিওর হওয়া যাচ্ছে না এই ঘটনায় আসলেই শামিম আহমেদ মারা গিয়েছিল কিনা। আর কিছু ব্যাপার পরিস্কার হওয়া দরকার। আর এদিকে দুদিন বাদে যথাসময়ে রিনা খন্দকার এসে হাজির।

আমি বললাম, “আপনাকে যা আনতে বলেছিলাম সব এনেছেন?”
“হ্যা.... এনেছি”।
মহিলা হ্যান্ড বাগ থেকে একটা সিডি বের করে দিল।
আমি বললাম, “এটা কি?”
“কেন? ভিডিও ফুটেজ!”
“আপনি ভাল করেই জানেন আমি ভিডিও ফুটেজ দেখতে চাইনি! কাগজপত্র গুলো কোথায়?”

মহিলা বিনা বাক্য ব্যয়ে ব্যাগ থেকে বেশ কিছু কাগজ পত্র বের করে দিল। আমি দেখলাম জার্মানি, অস্ট্রিয়া আর বেলজিয়ামের বেশ কয়েকটা নামকরা হোটেলের কাগজপত্র আর প্লেনের টিকেট। সব কিছুর ফটোকপি এনেছে, রিস্ক নেয়নি মহিলা। কিন্তু বার্লিন থেকে ঢাকায় ফেরার প্লেনের টিকেট দেখে খটকা লাগল আমার।
“প্লেনের টিকেট বলছে, বাবা আর আপনি ইউরোপ গিয়েছেন ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ আর দেশে ফিরেছেন ২০ তারিখ!”
“হ্যা তাই।”
“আপনি যে বললেন বাবা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শামিম কে গুম করেছে! সেটা ইউরোপ থেকে ফেরার পর না আগে?”
“অবশ্যই পর!”
“কিন্তু বাবার সেই বন্ধুতো ১ তারিখ থেকেই নিখোঁজ ছিল”।
“সেটার অন্য কোনও কারন থাকতে পারে! কারন ইউরোপ যাওয়ার দিনই তোমার বাবা শামিম সাহেবের সাথে দেখা করেছেন। আমিও ছিলাম সেখানে! সারাদিন তোমার বাবা আমার সাথেই ছিল।”
“বাবার যে এক্সিডেন্ট হয়েছিল, গলায় আঘাত পেয়েছিল সেটা ইউরোপে থাকা অবস্থায় হয়েছিল?”
“একদমই না। ইউরোপ থেকে তোমার বাবা সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছিল। তারপর বেশ কিছুদিন আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ ছিল। কোথাও ছিল, কি করেছে তার কিছুই আমার জানা নেই। তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছি যে এই সময়টাতেই তোমার বাবা শামিমকে খুন করেছে। হতে পারে গলার আঘাতটার জন্য শামিমই দায়ী!”
আমি ডেক্সের ড্রয়ার খুলে একটা প্যাকেট বের করলাম। “এখানে ৪০০০০ আছে। আশা করি মাসে মাসে এটা পেলে আপনি মুখ বন্ধ রাখবেন?”
“সানন্দে!”

মহিলা প্যাকেটটা ব্যাগে ভরে বেরিয়ে গেল। আমি গভীর চিন্তায় পরে গেলাম। এই রহস্যের কোনও কুল কিনারা পাচ্ছিনা! রিনা খন্দকার বলছে বাবা ইউরোপ থেকে ফেরার পর শামিম আহমেদকে খুন করেছে। কিন্তু শামিম আহমেদ তো ১ তারিখ থেকেই নিখোঁজ! এদিক থেকে ভাবলে বাবা শামিম আহমেদের নিখোঁজ হওয়ার সাথে জড়িত নয়।

কিন্তু রিনা খন্দকারের কথা ফেলে দেওয়াও যাচ্ছে না! কারন প্লেনের টিকেট বলছে বাবা ইউরোপ থেকে ফিরেছিলেন ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ। আমি অফিসের পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে দেখেছি বাবা ইউরোপ থেকে ফিরে আবার অফিসের কাজ শুরু করেছিলেন মার্চ মাসের শেষের দিকে। তাহলে মাঝের এই একমাস বাবা কি করেছেন?
মায়ের কাছে শুনেছি বাবা মাস দুয়েকের জন্য ইউরোপে গিয়েছিল ব্যাবসায়ের কাজে। সেখানে একটা এক্সিডেন্ট হয়। তাতে ভোকাল কর্ডে আঘাত লাগে এবং বাবার কণ্ঠস্বর নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু রিনা খান বলছে বাবা ইউরোপ থেকে ফিরে এসেছে সুস্থ অবস্থায়!
আমার মনে হচ্ছে সেই ১ তারিখের দুর্ঘটনাটা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানা দরকার। নিশ্চিত হওয়া দরকার আসলেই সেই ঘটনায় শামিম আহমেদ মারা গিয়েছিল কিনা।


চার

কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দিল একজন তরুণী।
“অফিস থেকে আজ এত আগেই ফিরে এলে ভাইয়া! শরীর খারাপ.......” বলতে বলতে আমার দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেল মেয়েটি। তারপর আমতা আমতা করে বলল, “আসলে...আমি..আমি ভেবেছিলাম ভাইয়া এসেছে! আপনি কার কাছে এসেছেন?”
আমি মৃদু হাসলাম, “জী আমি ডা. এহতেশামসের কাছে এসেছি”।
“আপনি কি বাবার পরিচিত কেউ?”
“ঠিক তা না! আসলে একবার উনি আমার এক আত্মীয়ের চিকিৎসা করেছিলেন। সেই ব্যাপারে কথা বলতেই এসেছি”।
“আচ্ছা। আপনি ভেতরে এসে বসেন, আমি বাবাকে বলছি”।

আমি ড্রয়িং রুমে বসলাম। মেয়েটি দু মিনিট বাদেই ফিরে এল, “বাবা বারান্দায় বসে আছেন। আপনাকে যেতে বলেছেন”।
একজন ষাটোর্ধ লোক ইজি চেয়ারে বসে পেপার পড়ছিলেন। আমাকে দেখে অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলেন। “আসুন, বসুন”।
আমি বুঝলাম ইনিই ডা. এহতেশামস। তার সামনা সামনি একটা বেতের চেয়ারে বসলাম আমি। “আমাকে তুমি করেই বলতে পারেন। আমার নাম যুবায়ের চৌধুরী। আমি একটা ঘটনা সম্পর্কে জানতে এসেছি”।
ডা. এহতেশামস বললেন, “কোন ঘটনা?”
“ঘটনাটা অনেক পুরনো। প্রায় ২৫ বছর আগের”।
“ওহ গড! এত আগের কথা কি আর মনে আছে? ইয়ং ম্যান! আমার বয়স ৬৫, ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দিয়েছি ২ বছর আগেই”।
“স্যার, আমার মনে হয় ঘটনাটা আপনার মনে আছে। সায়েন্স ল্যাব এলাকায় একটা মারাত্মক এক্সিডেন্ট হয়েছিল। অনেক মানুষ হতাহত হয়। তাদেরকে স্থানীয় একটা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। আপনি তখন এই মানুষগুলোর চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন”।
“হ্যা মনে আছে আমার। সেই ঘটনা সহজে ভোলার নয়”।
“স্যার, আমরা ধারনা করছি সেই ঘটনার ভুক্তভোগীদের মধ্যে শামিম আহমেদ নামে একজন যুবক ছিলেন, আমার বাবার বন্ধু। কারন ঘটনার দিন থেকে তিনি নিখোঁজ। তিনি আহত হয়েছিলেন না মারা গেছেন সে সম্পর্কে আমরা আজও নিশ্চিত হতে পারিনি”।
ডা. এহতেশামস বললেন, “আমার হয় মারাই গেছে। আহত হলে তো সে নিখোঁজ হয়ে যেত না! তার পরিবারের কাছে তো সে ফিরেই যেত”।
“আমি হ্যা বোধক মাথা নাড়লাম”।
“সেই ঘটনায় ১৪-১৫ জন মারা গিয়েছিল। বেশিরভাগ লাশই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। চেনার কোনও উপায় ছিলনা। তখন তো ডিএনএ টেস্ট করার ব্যবস্থাও ছিলনা। যতদূর মনে আছে ৮ জনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল, বাকিদের সনাক্ত করা যায়নি। কাছাকাছি একটা কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়। আমার মনে হয় তুমি যার কথা বলছ সে এই লোকগুলোর মাঝে একজন হবে”।

আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। ভেবেছিলাম এখানে এসে একটা কুল কিনারা পাব, কিন্তু পুরো ব্যাপারটা এখনও ঘোলাটেই রয়ে গেল।
“সেই দিনের কথা আমি কখনো ভুলতে পারব না! কি যে বীভৎস অবস্থা! লাশগুলো পুড়ে হার মাংসের স্তূপ হয়ে গিয়েছিল। আর যারা আহত হয়েছিল তারাও...” ভদ্রলোক যেন সেই পুরনো দিনে ফিরে গেছেন। কিভাবে কি হয়েছিল বিস্তারিত বলে চলেছেন।

ডা. এহতেশামস এর মেয়ে একটা ট্রেতে করে চা নাস্তা নিয়ে এল। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিল। মনে হয় একটু আগের ঘটনায় এখন অপ্রস্তুত হয়ে আছে। প্রথম দেখাতে মেয়েটিকে সুশ্রী মনে হয়েছিল, এখন খেয়াল করে দেখলাম মেয়েটি আসলে অতিমাত্রায় সুন্দরী! চা এগিয়ে দিতে আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে থাকল। চায়ের কাপ নিতে নিতে আমি হাসলাম একটু, “ধন্যবাদ”।
মেয়েটি হালকা করে একটু মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। ডা. এহতেশামস এর স্মৃতিচারন থামালাম আমি, “থাক স্যার, এসব শুনতে আর ভাল লাগছে না। নিজের কথা বলুন, অবসর জীবন কাটছে কেমন?”
“এইতো, ভালই চলছে। নিশ্চিন্ত জীবন! বারান্দায় বসে আকাশ দেখা আর পত্রিকা পড়া ছাড়া কোন কাজ নেই”।
“আপনার ছেলে মেয়েরা?”
“আমার এক ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে অপূর্ব, ব্যাংকে চাকরি করে। মেয়েটার নাম মিথিলা, অনার্স পড়ছে”।
আমার ঠোঁটে হাসি ফুটল, যাক নামটা তাহলে জানা গেল! আমি চায়ের কাপে শেষ একটা চুমুক দিয়ে উঠে পড়লাম। “আজ তাহলে যাই স্যার”।
“তোমার সাথে কথা বলে ভাল লাগল ইয়ং ম্যান। আবার এসো”।
আমি চলে যেতে উদ্যত হয়েছি, তখন পিছন থেকে ডাকলেন ডাক্তার। “শোন”।

আমি পিছন ফিরে তাকালাম। ডাক্তার বললেন, “যারা আহত হয়েছিল, তাদের সবাইকে দেখার জন্য আত্মীয় স্বজনরা এসেছিল। শুধু একজনের খোঁজে কেউ আসেনি। লোকটা বলেছিল তার আপন কেউ নেই। লোকটার নাম মনে নেই, তার সমস্ত মুখের চামড়া পুড়ে গিয়েছিল। সেই সময় ডা. জন ডেনভার নামে একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ প্ল্যাস্টিক সার্জন তার মেডিকেল টিম নিয়ে বাংলাদেশ এসেছিল। তারা বিনা খরচায় আমাদের দেশের এসিডদগ্ধ নারীদের প্ল্যাস্টিক সার্জারি করে আগের চেহারা ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ করছিল। ভদ্রলোক আমার পরিচিত ছিল। আমি তাকে একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলাম ডা. জন ডেনভারের সাথে দেখা করার জন্য। তার পর কি হয়েছিল তা আমি আর জানিনা.....”

পাঁচ

বাবা বেডরুমের বিছানায় শুয়েছিলেন। আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আয় আয় যুবায়ের, আমার পাশে বস। আমার যে কি ভাল লাগছে জানিস? আল্লাহর রহমতে তোর মায়ের শরীর এখন ভাল। আগামীকাল রিলিজ করে দেবে”।
আমি বাবার বিছানার পাশে বসলাম।
“কয়েকদিন যাবত তোর দেখা পাচ্ছি কম। কোথায় এত দৌড়াদৌরি করছিস?”
আমি আস্তে করে বললাম, “তোমাকে কয়েকটা কথা বলব বাবা”।
আমার কণ্ঠে হয়ত এমন কিছু ছিল যা শুনে বাবার মুখে হাসি মুছে গেল। “কি বলবি?”
“রিনা খন্দকার আমার কাছে এসেছিল”।

বাবার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। মিনিট খানেক দুজনেই চুপ করে থাকলাম। তারপর বাবা শান্ত গলায় বলল, “যুবায়ের! আমার অতিত জীবনটা বেশি সুবিধার ছিল না ঠিকই কিন্তু সেই জীবন তো আমি অনেক পিছনে ফেলে এসেছি। তুমি তো জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখেছ আমি একজন সৎ মানুষ। আমি তোমাকে আর তোমার মাকে আমার নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালবাসি”।
“রিনা খন্দকার বলেছে তুমি তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শামিমকে হত্যা করেছ”।
“তুই রিনা খন্দকারের কথা বিশ্বাস করিস? তুই বিশ্বাস করিস আমি কাউকে খুন করতে পারি? শামিম দুর্ঘটনায় মারা গেছে”।
“রিনা খন্দকার যা বলেছে তার একবর্ণও আমি বিশ্বাস করিনি। তাই গত কয়েকদিন যাবত খোঁজ খবর করে জানতে পেরেছি শামিম আহমেদ আসলে সেই দুর্ঘটনায় মারা যায়নি”।
বাবা বললেন, “তাহলে?”
“তার মুখ পুড়ে গিয়েছিল। পরে প্ল্যাস্টিক সার্জারি করে ঠিক হয়ে গেছে”।
“তাই নাকি? কই আমি তো জানতাম না!” বাবা নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসলেন।
“হ্যা.. তার চেহারা ঠিক হয়েছিল কিন্তু ভোকাল কর্ডে যে আঘাত পেয়েছিল সেটা ঠিক হয়নি”।
বাবা চুপ করে থাকলেন।
“বাবা, আমি জানি... আমি জানি তুমিই শামিম আহমেদ। ফাহাদ চৌধুরীর সেই বন্ধু”।

বাবা চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকল। আমি ধরা গলায় বললাম, “বাবা! একটা সত্যি কথা বলবে? আমি আসলে কার সন্তান?”
বাবার চোখ বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গরিয়ে পরল, “তুই... তুই... আমার সন্তান যুবায়ের! আমার সন্তান!”
“কিন্তু অবৈধ সন্তান। আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল ফাহাদ চৌধুরী নামে লোকটির সাথে। তুমি মায়ের স্বামীর রুপে তার কাছে এসেছ! দীর্ঘ ২৫ বছর যাবত তুমি আমার মাকে ধোঁকা দিয়ে চলেছ!”
“ধোঁকাবাজ আমি? ফাহাদ ছিল একটা বিশ্বাসঘাতক। সে ত্রিনার সাথে বেইমানী করেছিল। ঘরে বউ রেখে রাত ভর মদ আর মেয়েমানুষ নিয়ে মেতে থাকত.....”
“থাক থাক! আমি আর একটা কথাও শুনতে চাইনা তার সম্পর্কে। সে যত খারাপই হোক, তোমার চেয়ে জঘন্য কাজ আর কেউ করতে পারবেনা!”
বাবা বড় করে দীর্ঘশ্বাস নিলেন। “তুই কি এখন সব কিছু তোর মাকে বলে দিবি?”
আমি কঠিন কণ্ঠে বললাম, “অবশ্যই বলব। সত্যি কথাটা তাকে জানান আমার দায়িত্ব”।

বাবা উঠে দাঁড়ালেন। চশমা চোখে দিলেন, “মানিব্যাগ পকেটে ভরলেন। আলমারি খুলে একটা ব্যাগপ্যাক বের করলেন”।
“কোথায় যাচ্ছ?”
“তোর মা সবকিছু জানার পর আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াব কেমন করে? তাই চলে যাচ্ছি”।
“যাচ্ছ, যাও। কিন্তু এতটুকু বলে যাও আসল ফাহাদ চৌধুরীর কি হয়েছিল?”
বাবা বিনাবাক্যব্যয়ে ব্যাগ গুছাতে লাগলেন।
“তুমি তাকে মেরে ফেলেছ তাই না? মারার পর লাশটা গুম করে ফেলেছ যেন এই কুকীর্তির কথা কেউ জানতে না পারে! তুমি ভুলে গিয়েছিলে সত্য কখনো চাপা থাকেনা”।
বাবা কোনও জবাব দিল না। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে রুম থেকে।
“কি হল? জবাব দিচ্ছনা কেন?”
বাবা ঘুরে দাঁড়াল, “তোর কোনও প্রশ্নের কোনও জবাব আমার কাছে নেই। শুধু একটা কথা জেনে রাখ..... তুই আমার অবৈধ সন্তান না। আমি তোর মায়ের সাথে কোন ধোঁকাবাজি করিনি”।



ছয়

কেবিনে ঢুকতেই মা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। “কিরে যুবায়ের? তোর বাবা কোথায়? ওর কান্না কাটিতে বোধহয় এই যাত্রায় আমি বেঁচে গেলাম রে! ডাক্তাররা বলেছে আজই আমাকে রিলিজ দিয়ে দেবে!”
আমি জোর করে মুখে একটু হাসি ফুটাতে চেষ্টা করলাম। “বাবা... আসছে...”
“থাক থাক ও একটু পরেই আসুক! পুরুষ মানুষ মেয়ে মানুষের মত হাপুস নয়নে কাঁদে! আমার নিজেরই লজ্জা লাগে!”

আমি মায়ের কাছ ঘেঁষে বসলাম। আমি এসেছি মাকে সত্যি ঘটনাটা জানাতে। জানি এটা সঠিক সময় না। কিন্তু এরচেয়ে ভাল সময় আর পাব কিনা কে জানে! মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, “যুবায়ের! আমার শরীরে নানান ধরনের জটিল সব রোগ ধরেছে। যে কোনও দিন ফট করে মারা যাই তার কোনও ঠিক নেই। ভাবছি এবার তোর একটা বিয়ে দিয়ে দেব”।

আমি মায়ের দিকে তাকালাম। কি সুন্দর সুখী একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি! অথচ আমি যে কথা গুলো বলব আজ তা শোনার পর এই মা হয়ত বাকি জীবনে আর কখনো হাসতে পারবে না!
“যুবায়ের! তোর বাবা আসার আগেই তোকে কিছু কথা বলতে চাই বাবা!”
“কি কথা মা?”
“তার আগে বলে নেই। কথাগুলো তুই মনোযোগ দিয়ে শুনবি এবং কথার মাঝখানে কিছু বলবি না!”
“ঠিক আছে মা”।

মা শুরু করল, “আমি ছিলাম ছা পোষা বাবার সন্তান। ৫ ভাইবোনের সংসারে অভাব অনটন ছিল নিত্য সঙ্গী। স্বপ্ন ছিল স্বামীর সংসারে গিয়ে সুখের মুখ দেখব। আমি তখন অনার্স পড়ি। পাশাপাশি একটা কোচিং সেন্টারে টিচিং করতাম। সেখানে একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয় আমার। ছেলেটার নাম শামিম আহমেদ। খুব সাদাসিধে ভীরু প্রকৃতির ছেলে। একটা সময় বুঝতে পারলাম ছেলেটি আমাকে ভালবাসে। আমিও ছেলেটিকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম। কিন্তু শামিম ছিল এতিম ছেলে। বন্ধুর বাবার বাড়িতে আশ্রিত ছিল। বন্ধুর টাকায় লেখাপড়া করত। স্বভাবতই একটা হীনমন্যতা কাজ করত তার মাঝে যার কারনে ছেলেটা একটা মেরুদণ্ড হীন একটা কাপুরুষে পরিনত হয়েছিল।

একদিন শামিমের বন্ধু ফাহাদের সাথে পরিচয় হল আমার। ফাহাদ ফুর্তিবাজ ছেলে। মেয়ে পটান ছিল তার কাছে অনেকটা চ্যালেঞ্জের মত। কিন্তু কিছুদিন বাদে সব কিছু চুকিয়ে দিয়ে আবার নতুন মেয়ের দিকে ঝুঁকে পরত। ছেলেটি একদিন আমাকেও প্রস্তাব দিয়ে বসল। আমি মনে প্রানে চাইছিলাম শামিম যেন এগিয়ে আসে। কিন্তু ঐযে বললাম, ছেলেটা ছিল কাপুরুষ! তার বন্ধু তার ভালবাসার মানুষকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে দেখেও তার মাঝে কোনও রিঅ্যাকশন হলনা। এদিকে ফাহাদের ছিল অর্থ বিত্ত সহ সব কিছু যার স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম। আমি জানতাম ফাহাদ আমাকে সাময়িক আনন্দ শেষে ছুড়ে ফেলবে, বিয়ে করবে না। তাই আমি একটা প্লান করে এগোচ্ছিলাম। ফলে একসময় ফাহাদ আমাকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠল। সে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। আমি রাজিও হয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম বিয়ের পর ফাহাদ সংসারে মনযোগী হবে, সব বাজে অভ্যাস ত্যাগ করবে। কিন্তু আমার ধারনা ভুল প্রমানিত হল। ফাহাদ ঘরে ভালমানুষের আচরন করত কিন্তু বাইরে সে ঠিকই তার নিজের মত করে চলতে লাগল। আমিও ভাব দেখালাম আমি কিছুই জানিনা। মনে প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে আমি সুখী একজন স্বামীভক্ত পত্নীর ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছিলাম। আমি বুঝতে পারলাম, মানুষের জীবনে অর্থ সম্পদের দরকার আছে ঠিকই, কিন্তু শুধুমাত্র অর্থই মানুষকে প্রকৃত সুখ এনে দিতে পারেনা। ৫ ভাই বনের সংসারে আমাদের অভাব ছিল ঠিকই কিন্তু আমরা খুব সুখী ছিলাম। সেই সুখ আমি ফাহাদের সংসারে কোনওদিন পাইনি।“

এই পর্যন্ত বলে মা একটু দম নিলেন। আমি চুপ করে থাকলাম বাকিটুকু শোনার আশায়। মা একটু পানি খেল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, “২৫ বছর আগের কথা। ফাহাদ ইউরোপ গেল বাবসায়িক কাজে। ফিরে এল প্রায় ২ মাস পর। ফিরে আসার পর জানলাম, বার্লিনে থাকাকালীন একটা এক্সিডেন্ট হয় তার। তাতে ভোকাল কর্ডে আঘাত পায় এবং কণ্ঠস্বর নষ্ট হয়ে গেছে”।

মা আবার একটা বড় করে দম নিলেন, “আমি তিন বছর সংসার করেছি ফাহাদের সাথে। প্রথম দেখাতেই আমি চিনতে পারলাম এই ফাহাদ সেই ফাহাদ না। এটা শামিম। সে সময় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল শামিমের। তাতে তার ভোকাল কর্ডে ক্ষতি হয় এবং চেহারা পুড়ে যায়। পরে প্ল্যাস্টিক সার্জারি করে সে ফাহাদ সেজে আমার কাছে ফিরে আসে। আসল ফাহাদের কি হয়েছিল আমার জানা নেই। ফাহাদ আমার সাথে সারাজীবন বিশ্বাশঘাতকতা করেছিল। আমার মনের মধ্যে প্রচণ্ড ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল তার প্রতি, অপরদিকে আমি আবিষ্কার করলাম এই শামিম ছেলেটাকেই আমি প্রকৃতপক্ষে ভালবাসতাম। তাই আমি ফাহাদরুপি শামিমকেই আপন করে নিলাম। শামিম ঘুনাক্ষরেও জানতে পারল না আমি আসলে সব জানি”।

আমি চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে। ভাবছি, মানুষের জীবন কতই না বিচিত্র! গত সপ্তাহখানেক প্রচণ্ড দৌরাদৌরি করে আমি যা আবিষ্কার করেছি, তার সবই মায়ের আগে থেকে জানা! মা বলে চলেছেন, “তাই বলে তুই ভাবিস না তুই আমার অবৈধ সন্তান! সেই মার্চেই আমাদের বিবাহ বার্ষিকী ছিল। সেদিন শামিম আমাকে বলল, চল আজ আমরা একটা ছেলেমানুষী মজা করি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি করতে চাও? শামিম বলল, চল আমরা আবার বিয়ে করি! আমি শামিমের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলাম। সে চাইছিল আমাদের সম্পর্কটা বৈধ করে নিতে। আমি মনে মনে হেসেছিলাম কিন্তু কিছু বলিনি। এভাবেই কাটিয়ে দিলাম জীবনের ২৫টি বছর। শামিমের ভালবাসায় আমি যতটা সুখী হয়েছি, পৃথিবীর সমস্ত সুখ এক করলেও তা পাওয়া সম্ভব নয়”।

আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। আমি আস্তে করে বললাম, “আজ আমাকে এতসব বলছ কেন মা?”
“বলছি কারন আমার মনে একটা ভয় সৃষ্টি হয়েছে বাবা! মনে হচ্ছে আমি হয়ত এই পৃথিবীতে আর খুব বেশিদিন থাকব না। হঠাৎ করে যদি কখনো তুই জানতে পারিস আসলে ফাহাদ চৌধুরী যৌবনে কেমন মানুষ ছিল তাহলে হয়ত তুই তোর বাবাকে ভুল বুঝতে পারিস। একটা কথা মনে রাখিস! তোর বাবা শামিম আহমেদ পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল মানুষদের মত একজন। সে তোকে আর আমাকে যতটা ভালবাসে তা কোনও কিছুর বিনিময়ে পাওয়া সম্ভব নয়!”

নিজের প্রতি নিজের প্রচণ্ড ঘৃণা হচ্ছে আমার! পুরোটা না জেনে বাবাকে ওভাবে অপমান করে আমি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি!
“তোর প্রতি একটা অনুরোধ ছিল বাবা! রাখবি?”
“কি অনুরোধ, মা?”
“তোর বাবা আমাদের সুখী করেছে ঠিকই, কিন্তু নিজে কখনো সুখী হতে পারেনি। সে সারাজীবন মনে একটা কষ্ট পুষে রেখেছে। সে ভাবে আমার সব ভালবাসা বুঝি ফাহাদের জন্য। আমি মারা যাওয়ার পর তাকে বলিস আমি তাকে শামিম রুপেই ভালবেসেছি, ফাহাদ রুপে নয়”।
“ঠিক আছে মা”।
“তোর বাবা এখনও আসছে না কেন রে?”
আমি কিকরে মাকে বলব যে বাবা গতকাল রাত থেকে নিখোঁজ! এখানে আসার আগে সম্ভাব্য সব যায়গায় খোঁজ নিয়েছি, কোথাও কোনও খোঁজ পাইনি, হয়ত সারা জীবনের জন্য মানুষটাকে হারিয়ে ফেলেছি! আমাদের পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষে পরিনত করা এই মানুষটা সারাজীবন অসুখীই রয়ে গেল.........
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১০:৫৬
৪১টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রান্ত নিথর দেহে প্রশান্তির আখ্যান..... (উৎসর্গঃ বয়োজ্যেষ্ঠ ব্লগারদের)

লিখেছেন স্বপ্নবাজ সৌরভ, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৪২



কদিন আমিও হাঁপাতে হাঁপাতে
কুকুরের মত জিহবা বের করে বসবো
শুকনো পুকুর ধারের পাতাঝরা জামগাছের নিচে
সুশীতলতা আর পানির আশায়।

একদিন অদ্ভুত নিয়মের ফাঁদে নেতিয়ে পড়বে
আমার শ্রান্ত শরীর , ধীরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪

বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×