জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী স্যার ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও কৃতি অনুবাদক। দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছিলেন। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিলতাও ছিল তার সঙ্গে। ঘুমের মধ্যেই সব শেষ, যেন মৃত্যুও তার চেতনার ভয়ে ভীত হয়েই এসেছিলো সকলের অগোচরে। ভোর ছয়টার দিকে বাবাকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে তার মেয়ে শাহীন দেখেন, তিনি আর নেই।
১৯২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি স্নাতক ডিগ্রি ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন কবীর চৌধুরী। তবে তার পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীর চাটখিলে। কবীর চৌধুরী মৃত্যুর আগে কিছু নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তিনি চেয়েছেন তাকে যাতে শহীদ মিনারে না নেওয়া হয়। তার জানাজা ও দাফন যেন খুব সাধারণভাবে করা হয়।
বাবা খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী এবং মা আফিয়া বেগম তাদের বড় ছেলের নাম রেখেছিলেন আবুল কালাম মোহাম্মদ কবীর। তবে কর্মজীবনে তিনি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী হিসেবেই পরিচিত হন।
কবীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি স্নাতক ডিগ্রি পান ১৯৪৪ সালে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদর বাহিনী তার ছোটভাই মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই কবীর চৌধুরীকে শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করা ছাড়াও বাংলা একাডেমীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ১৯৯৮ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক করা হয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।
প্রাচীন ইংরেজি কাব্যসাহিত্য; আধুনিক মার্কিন সাহিত্য; শেক্সপিয়র থেকে ডিলান টমাস; ইউরোপের দশ নাট্যকার; সাহিত্য সমালোচনা ও নন্দনতত্ত; পরিভাষা; শেক্সপিয়র ও তার মানুষেরা; অ্যাবসার্ড নাটক; পুশকিন ও অন্যান্য; শেক্সপিয়র ও গ্লোবথিয়েটার (১৯৮৭); অভিব্যক্তিবাদী নাটক (১৯৮৭); অসমাপ্ত মুক্তিসংগ্রাম ও অন্যান্য; নজরুল দর্শন; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তবুদ্ধির চর্চা; স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়; ছোটদের ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস এবং ছবি কথা সুরসহ শতাধিক বই লিখে গেছেন কবীর চৌধুরী।
যুক্তি আর মানবতার পক্ষে জীবনভর লড়াই চালিয়ে যাওয়া এই শিক্ষক কলম ছাড়েননি জীবনের শেষ দিনগুলোতেও। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের অপরিসীম ক্ষতি হলো। তিনি শুধু জাতীয় অধ্যাপকই ছিলেন না; ছিলেন জাতির বিবেক, জাতির অভিভাবক।
নিভে যাওয়ার আগেও তিনি হাজারো তরুন, যুবকদের হৃদয়ে প্রজ্বলিত করেছেন সেই সংগ্রামের আলো। তার দেখানো সেই আলোতেই তারা চলবে পথ, সংগ্রাম করে যাবে শোষিত মানুষের জন্য। জীবন দিয়ে হলেও চাইবে জাতির চিরশত্রু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও রেখে যাবে এক অস্বাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:২৩