somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবার লেখা স্মৃতিকথা থেকে-৬ :: মুক্তিযুদ্ধ ও বাবার গল্প

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
উত্সর্গ:
সেইসব বীর বিদ্রোহী আত্মার স্মরনে,
যাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা।



আজ স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর বিজয় দিবসে বাবার কথা মনে করছি। প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে বিজয় দিবস আসবে। এর মাঝে কত কান্না, কত অশ্র“ স্তব্ধ হয়ে আছে। কত দুঃখের স্মৃতি বিজড়িত এ কাহিনী। এ আমাদের জীবন থেকে মুছে যাবার নয়।

আমার ছেলেবেলা থেকেই বাবা কাপড়ের ব্যবসা করতেন। নেত্রকোনার হরেন্দ্র- ধীরেন্দ্র সাহার কাপড়ের দোকান হতেই বাবা তার দোকানের মালা-মাল আনতেন। প্রতি সপ্তাহেই প্রায় নেত্রকোনা যেতেন। বাবার সাথে আমিও মাঝে মাঝে নেত্রকোনা যেতাম।
একদিনের কথা মনে আছে আমাদেও পাশের বাড়ীর কদর আলী মামা, বাবা, আমি নেত্রকোনা যাই। তখন শীত কাল। শীতের কাপর কিনব। শহরে যেয়ে জানতে পারলাম যে অনেক যায়গাতে কলেরা ডায়রীয়ার প্রাদূর্ভাব। বাবার কাপড় কেনা হলে, সুমন্ত বাবু নামে দোকানের এক পরিচালক কিছু কমল ও ফল-মূল কিনে এনে আমাদের দিয়ে বলেন, শহরে কোন হোটেলে কোন কিছু খাবেন না। আমরা কিছু না খেয়েই তাড়া-তাড়ি শহর থেকে বের হয়ে আমি। বাবার জীবনের অনেক কিছুই আজ ভুলে গেছি। এখন আর মনে করতে পারছি না।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবাকে দেখেছি সংখ্যালগু হিন্দুদের প্রতি দরদী মহানুতিশীল, বন্ধু রূপে। অনেক বিপন্ন হিন্ধু আপন মালামাল বাবার কাছে গচ্ছিত রেখে তারা সীমান্তের ওপারে চলে যায়।
দেশ মুক্ত হলে এসব মাল তাদের ফেরৎ দিয়ে দেয়া হয়। আমতলার জোগেশ মাষ্টার -বাবার কাছে তার এক গাভী রেখে যান। নেত্রকোনার “সোনালী মেডিকেল হলের মালিক যতীন বাবু লাল রঙের ফলিপিস রেডিও রেখে যান। স্বরমুশিয়া গ্রামের যতীন্দ্র ও আমতলা গ্রামের গোপাল কিছু টাকা হরেন্দ্র - ধীরেন্দ্র সাহার কাছে গচ্ছিত রেখেছিল। যখন নেত্রকোনার সোনালী ব্যাংক লোট হয়ে যায় তখন হরেন্দ্র-ধীরেন্দ্র সাহার কাছে যে টাকা গচ্ছিত ছিল তা” তারা ফেরৎ দিতে ব্যথ হন। তখন তারা যতীন্দ্র ও গোপালকে বলে দেয় ; তোমরা শুনই গ্রামের ইসহাক আলী মিয়ার কাছে যাও তাঁর কাছে আমাদের কিছু টাকা পাওনা আছে। যখন গোপাল ও যতীন্দ্র বাবার কাছে আসে। তখন বাবা ১৩, টাকা মন দরে ধান বিক্রি করে তাদের টাকা পরিশোধ করে দেন। এই যতীন্দ্র - গোপাল রবাবার প্রশংসায় পষ্ণমুখ ছিলেন।


অনেক বিপন্ন মানুষের মান শম্ভ্রম রক্ষায় তিনি অগ্রনী ভূমিকা পালন করতেন। অনেক স্বর নার্থী ও বিপন্ন মানুষের খাবার ও টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে দেখেছি তাঁকে। কুনা পাড়া গ্রামে “বড় আবু” ধান-পাটর ব্যবসা করতেন। সংগ্রামের এক সঙ্গীন মুহুত্তে পাক- হানাদার- বাহিনীর ভয়ে বিপন্ন হয়ে দু’টি সুন্দরী যুবতী মেয়ে ও স্বর্ন টাকা নিয়ে আমাদের গ্রামে আসে, আলাল বেপারী ও হেকিম নামে দুজন লোকের কাছে স্বর্ন ও টাকা গচ্ছিত রেখে দু’টি মেয়েকে নিয়ে বড় আবু সীমান্ত পার হবার আগেই মেয়ে দু’টিকে সন্ত্রাসী রা ছিনিয়ে নেয়। এই শোকেই বড় আবু এখানে মৃতু বরন করে। দেশ মুক্ত হবার পর বড় আবুর ছেলে এসে স্বর্ন ও টাকা দাবী করলে, পূবোর্ক্ত ব্যক্তিরা সম্পূর্ন ভাবে অস্বীকার করে ইত্যকার কত কান্নার গল্পই না এখানে লুকাইয়া আছে।
আমি “ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যুক্ত ছিলাম। অধ্যাপক মোজাফকর আহমদ এর গ্র“পে। বেগম মতিয়া চৌধুরী ও সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে আমরা নির্বাচনী প্রচরনায় আটপাড়া এনেছি। আমার ছোট ভাই শামসুর রহমান মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্পে চলে যায়। পাক-হানাদার বাহিনী এ খবর পেয়ে যায়।

পাক বাহিনী যখন আমাদের বাড়ী অগ্নি সংযোগের জন্য আসে তখন পূর্ব দিক হতে মুক্তি বাহিনীর গুলির আওয়াজ পেয়ে পূর্ব দিকে তারা সরে যায়। এই ভয়ে আমাদের বাড়ী রক্ষা পেয়ে যায়। এটাও আল্লাহ্র অসিম অনুগ্রহ। আমাদের পাশের বাড়ীর লালমিঞা ও মোশেদ মিঞা গুলিবিদ্ধ হয়ে যায় ও মাটিতে তারা লুটিয়ে পড়ে। এর পরের বাড়ীর লুদু মিঞার স্ত্রী তখন গর্ভবতী ছিলেন। উঠানে ধান রোদ দেওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়। গুলির আঘাতে তার গর্ভ পাত হয়। সে দিনের সে সন্তান আজও বেঁচে আছে। তার নাম রাখা হয় “গুলি চান”। এর পরে পাক-বাহিনী প্রত্যেক বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়-
এই আগুনের তাপে বাতাসের ধোঁয়ায় সব কিছু আচ্ছন্ন হয়ে যায়। দূর থেকে যারা এই অগ্নিকান্ড দর্শন করেছে , সবাই বলছে আমাদের বাড়ীতে আগুন জ্বলছে। আমার এক ছোট বোন শামসুন্নাহার আমার বই গুলির জন্য আক্ষেপ করেছে যে, আমার সংগৃহীত বই গুলি পুড়ে গেছে বলে ধারনা করেছে। অথচ আল্লাহ্ আমার এই বইগুলি রক্ষা করেছেন। আমার বাবা তখন বাড়ীতে ছিলেন। দেখেছি তার মাঝে অসীম মনোবল, পাক-বাহিনী হাতে ধরা দেওয়ার দুরন্ত সাহস। কিন্তু, পাক-বাহিনী আমাদের বাড়ীতে আসে নাই।
আমরা বাড়ী হতে তখন পালিয়ে গেছি, আমার স্ত্রী তখন গর্ভবতী। সব ক্ষেতে তখন ধান, এই ধানি জমি পেরিয়ে আমার স্ত্রী ও অন্যান্য মেয়েরা দূরবর্তী গ্রামেচলে যায়।
প্রায় নয়মাস ধরে পাক-বাহিনীর অত্যাচার চলে। তাদের ভয়ে আমার মা ও অন্যান্য মেয়েরা মোহনগঞ্জ থানার কমলপুর গ্রামে আমার বোনের বাড়ী চলে যান।
এর পর দেশ তাড়াতাড়ি মুক্ত হয়ে যায়। আমাদের থানার পাক-বাহিনী সরে যায়। আল্বদও ও রাজাকারদের মেরে থানার পূব পাশে গর্তে পুঁতে রাখা হয়।
আমার মা সেদিনের কথা স্নরণ হলেই কাঁদতেন। স্বাধীনতার পর পরেই আমাদের বাড় তে ডাকাতি হয়। কাপড়ের দোকান ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে ডাকাতেরা নৌকা যোগে সরে পরে।

তখন বর্ষা কাল। আমাদের বাড়ীর পশ্চিম পাশে হাওর বর্ষা কালে নৌকানিয়ে চুরি ডাকাতি করা সহজ। ডাকাতির শেষ পর্যায়ে ডাকাতেরা আমার দেড় বছরের মেয়ে নারগিছকে নিয়ে চলে যেতে উদ্ধত হয়। আমার মা টাকা পয়সা ও অলংকার দিয়ে ডাকাতের হাত থেকে মেয়েকে ফিরায়ে আনে। একথা স্নরণ হলেই মা কাঁদতেন। আজ আর সেই মা নেই। ব্যথা হত চিত্ত মায়ের কবরের পারশ গিয়ে দাড়াই। হাত তুলে প্রার্থনা জানাই “ রাব্বির হাম্-হুমা কামা রাব্বা য়ানিছ-ছাগিরা” আজ স্বাধীনতার উনচল্লিশ বছর পর মুক্তি যুদ্ধেও কথা লিখতে গিয়ে বাবা-মার কথাই মনে পড়ছে বেশী করে।

সেদিনের স্নরনেই আমি কটি পুংক্তি রচনা করেছিলাম
“স্বাধীনতা তুমি,
“মায়ের -বোনের ধর্ষনের ইতিহাস
শিয়াল-শকুন, কুকুরে খেয়েছে মানুষের লাশ,
জানাযা হয়নি, কত মানুষ পায়নি কাফন
কে দেয় গোছল তার? এক কবরে হয় দাফন।


আজ চারিত্রিক-নৈতিক অবক্ষয়ের ক্ষনে ক্ষমতাবানদের কাছে প্রশ্ন থেকে যায়;
তব লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ভোগ করছে কারা? ধনী-লোটেরাদের বিচার করবে কোন বিচারক ?

নজরুলের প্রশ্নই এসে যায় -

“সমাজের অন্ধগলিতে বসে টাকার পাহাড় গড়ছে যে, মহা দস্যূররদল তাদের বিচার করতে কোন বিচারক ?

“চোর-ডাকাতের করিছে বিচার কোন সে ধর্ম-রাজ?
জিঞ্জাসা করো, বিশ্ব জুড়িয়া কে নহে দস্যূ আজ ?

ছোটদের সব চুরি করে আজ বড়রা হয়েছে বড়।
যারা যত বড় ডাকাত-দস্যূ জোচ্চোর দাগাবাজ,
তারা তত বড় সম্মানী-গুনি জাতি-সঙ্ঘেতে আজ।”

আজ পাক-বাহিনী দেশ থেকে সরে গেলেও সমাজে এই ধনী রাক্ষস ও লোক সরাবে কে? এরা ধর্ম বিশ্বাস করে না। আল্লাহ-রাসুল এদের থেকে অনেক দূরে।

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:২৫
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রফেসদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×