somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চট্টগ্রামের জল্লাদখানা ফয়স লেক

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'দেখলাম অগণিত মৃতদেহ। চক্ষু স্থির হয়ে গেল। সংযত হলাম। ভালো করে দেখলাম। এবার দেখলাম সব লাশ মেয়েদের। উলঙ্গ অবস্থায়। অধিকাংশ যুবতী এবং দুই-তিন দিন আগের মৃতদেহ মনে হলো। নজর করে দেখলাম যে, অধিকাংশ মৃত নারীর পেটে সন্তান। মৃতদেহগুলো এক এক স্তূপে ১০ জন ১৫ জন করে রাখা হয়েছে। এভাবে পাহাড়ের উপর বিভিন্ন স্থানে অনেক স্তূপ করে রাখা হয়েছে। আমার সঙ্গী একজন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। আমি কোনো রকমে সংজ্ঞা রেখে একে একে সব মৃতদেহ গুনে দেখলাম এক হাজার বিরাশিটি হতভাগ্য যুবতীর মৃতদেহ। এ অর্ধগলিত লাশগুলো দেখে মনে হলো, অধিকাংশের পেটে ছুরি দ্বারা আড়াআড়িভাবে আঘাত করে বধ করা হয়েছে ...।'
'৭১-এর ১১ নভেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকার প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল গোফরান নামে এক যুবকের বর্ণনাটি 'বাঙ্গালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম' গ্রন্থে এমনভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক ডা. মাহফুজুর রহমান।
শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমির একটি ফয়স লেক। ১৯৭১ সালে বিহারিদের রাজত্ব ছিল আশপাশ এলাকায়। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিহারিরা বাঙালি হত্যায় মেতে ওঠে। পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাহাড়তলীর বিশাল এলাকাজুড়ে যে দীর্ঘ ৯ মাস ধরে গণহত্যা চলে, তার সব লাশ ফেলা হয় পাহাড়তলীর নয়নাভিরাম ফয়স লেক পাহাড়ে। বিহারিরা ছিল দলবদ্ধ। চট্টগ্রাম শহরের টাইগারপাস, আমবাগান থেকে পাহাড়তলী সিডিএ এলাকার বিশাল অংশজুড়ে ছিল বিহারিদের তাণ্ডব। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে আমবাগান এলাকা থেকে বিহারিরা বাঙালিদের ঘরে ঘরে আগুন লাগাতে শুরু করে। সংঘবদ্ধ বিহারিদের একটি দল চট্টগ্রাম পুলিশ লাইন দখল করে নেয়। এরপর থেকে বেড়ে যায় অত্যাচারের মাত্রা। সবচেয়ে ভয়াবহ দিন ছিল ১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর। এদিন চারজন বিহারিকে বাঙালিরা হত্যা করেছে_ এ গুজব ছড়িয়ে হত্যা করা হয় বাঙালিদের। হত্যার পর ফয়স লেক পাহাড়ে লাশ ফেলা হয়। শুধু পাহাড়তলী এলাকা নয়, চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থান থেকেও লাশ এনে পাহাড়ের বিভিন্ন অংশে ফেলে পাকিস্তানিরা। বাঙালিদের দিয়ে গণকবর খুঁড়ে সেখানে লাশ ফেলে কবর খোঁড়ার কাজে নিয়োজিতদেরও হত্যা করা হতো।
পাহাড়তলীর সাবেক পাঞ্জাবি লেনের অধিবাসী উম্মে আতিয়া রহমান তার গ্রন্থে গণহত্যার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :১০ নভেম্বর ৭১। ভোরে ঘুম ঘুম অবস্থায় শুয়ে থাকতে স্বামীর কোরআন পড়ার শব্দ পাই। ৯ মাসের ছোট ছেলেটিকে নিয়ে আমি শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ শুনি পাশের বাসার সৈয়দুর রহমানকে বিহারিরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় আমার এক ভাতিজা এসে বলল, বিহারিরা মোতাহের সাহেবকে ডাকছে। মোতাহের সাহেব এবং ভাতিজাসহ সৈয়দ আহমেদকে বিহারিরা ধরে নিয়ে যায়। এরপর আমার ভাসুর মোজাম্মেল রহমান, বড় দেবর আমিনুল ইসলাম, দুই দারোয়ান সরোয়ার আলী ও কবীরকেও ধরে নিয়ে যায়। মোজাম্মেল সাহেব ৯ নভেম্বর আমার বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। এদের সবাইকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।
১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম শহরে পাকিস্তানি ও বিহারিদের গণহত্যার বেশিরভাগ লাশের ঠিকানা ছিল ফয়স লেকের পাহাড়ের আনাচে-কানাচে। অনেকাংশে পাওয়া যায় গণকবর। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারের আমলে পরিকল্পিতভাবে এ বধ্যভূমিটির নাম-নিশানা মুছে ফেলার চক্রান্ত চলে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ফয়স লেকের নয়নাভিরাম পাহাড়কে ঘিরে বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ফলে ১৯৭১-এর সবচেয়ে বড় বধ্যভূমিটি চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ বিনোদন কেন্দ্রে রূপ নেয়। পাহাড়তলী এলাকার সবচেয়ে স্পর্শকাতর একটি এলাকায় স্থাপিত হচ্ছে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুতল ভবন। যে স্থানে সবচেয়ে বেশি গণকবর আবিষ্কৃত হয় সে স্থানটিতে বেসরকারি ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শহীদ পরিবারের সন্তানরা। তবে আন্দোলনের পরও নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়নি। সাবেক বিএনপি জোট সরকারের আমলে ওই স্থানে গণকবরের নাম-নিশানা মুছে ফেলা হয়। শহীদ পরিবারগুলোর দেওয়া সাইনবোর্ড উপড়ে ফেলা হয়। শহীদ পরিবারের সন্তানদের আন্দোলনের মুখে পাহাড়তলী বধ্যভূমি শেষ পর্যন্ত সরকারি স্বীকৃতি পেলেও পরবর্তী সময়ে স্মৃতিস্তম্ভ ও জায়গা নিয়ে নানা নাটক চলে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের যে নয়টি বধ্যভূমি অধিগ্রহণ, সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে; চট্টগ্রামের পাহাড়তলী তার অন্যতম। স্থানীয় সাধারণ জনগণের কাছে এটি 'জল্লাদখানা' বলে পরিচিত। পাহাড়তলী, আমবাগান, ঝাউতলা, ওয়্যারলেস কলোনি ও সাবেক পাঞ্জাবি লেন তথা বর্তমান শহীদ লেনে একাত্তরের ৯ মাস বিহারি অধ্যুষিত এসব এলাকায় নির্বিচারে সাধারণ বাঙালি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। এখানে আছে অনেক রক্তাক্ত ঘটনার স্মৃতি। শহীদ পরিবারের সদস্যসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতিতে এগুলো এখনও অম্লান। একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বরে এসব এলাকায় যেখানে যাকে পাওয়া গেছে তাকেই হত্যা করেছে পাকিস্তানি নরঘাতকরা। ১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর ২০ রমজানের দিনে পাক হায়েনা, বিহারি পশু আর তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে প্রায় দুই হাজার নিরীহ সাধারণ বাঙালিকে হত্যা করেছে বলে শহীদ পরিবার সূত্রে জানা যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালের ৩০ নভেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও পাহাড়তলী বধ্যভূমিটি অধিগ্রহণ ও সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। (পত্র সংখ্যা ৬১.৩৯.০.০.৬.৯৮-২৭ (৫৫) তারিখ ৭.০২.৯৯) এরপরই রায়েরবাজার বধ্যভূমিটি ৬.৫১ একরের ওপর ১৭৬১.১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে সংরক্ষিত হয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রামবাসীর দুর্ভাগ্য, বছরের পর বছর গেলেও এখানে এখনও নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। কিন্তু গত ১৩ বছরেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশ পালন করেননি কেউ। এখনও অরক্ষিতই রয়ে গেছে দেশের এই বৃহত্তম পাহাড়তলী বধ্যভূমিটি। ব্যক্তিমালিকানাধীন নির্মাণ কাজ বন্ধের দাবিসহ চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবিতে জোর আন্দোলন শুরু করে প্রজন্ম '৭১ নামে স্বাধীনতার সপক্ষের একটি সংগঠন। ওই সংগঠনের সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ড. গাজী সালেহ উদ্দিন আদালতে মামলা করায় পাহাড়তলী বধ্যভূমির ওপর ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমারত নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, 'যেখানে বধ্যভূমি সেখানেই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে হবে। তিনি বলেন, 'আমরাই প্রথম বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলি। সেই আন্দোলনের ফসল হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়।' তিনি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমিসহ দেশের সব বধ্যভূমি সংরক্ষণের জোর দাবি জানান। এত আন্দোলন আর প্রতিবাদের মুখেও থেমে নেই কাজ। গোপনে চলছে সব। বিনোদন কেন্দ্র আর বহুতল ভবনের নিচে প্রতিনিয়ত চাপা পড়ছে ৭১-এ শহীদ হাজার হাজার মানুষের গণকবর। হয়তো একদিন নতুন প্রজন্ম ভুলে যাবে এখানকার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমিটির কথা।


Click This Link
১০টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্যামুয়েল ব্যাকেট এর ‘এন্ডগেম’ | Endgame By Samuel Beckett নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা

লিখেছেন জাহিদ অনিক, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৮



এন্ডগেম/ইন্ডগেইম/এন্ডগেইম- যে নামেই ডাকা হোক না কেনও, মূলত একটাই নাটক স্যামুয়েল ব্যাকেটের Endgame. একদম আক্ষরিক অনুবাদ করলে বাংলা অর্থ হয়- শেষ খেলা। এটি একটা এক অঙ্কের নাটক; অর্থাৎ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামে ভুল থাকলে মেজাজ ঠিক থাকে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৫


বেইলি রোডে এক রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে একজন একটা পোস্ট দিয়েছিলেন; পোস্টের শিরোনামঃ চুরান্ত অব্যবস্থাপনার কারনে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডকে দূর্ঘটনা বলা যায় না। ভালোভাবে দেখুন চারটা বানান ভুল। যিনি পোস্ট দিয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×