একদিন পার্লার থেকে বের হয়ে রিকশা নিবো রিকশাওয়ালা তার কত কি সব অসুখের কথা, চিকিৎসার কথা বলে কিছু টাকা বেশি চাইল। আমি বিশ্বাস করি নাই। এটাতো বাড়তি কিছু টাকা রোজগারের একটা ফন্দি হইতে পারে। খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। তারপরে তাকে বাদ দিয়ে অন্য একটা রিকশায় উঠে গেলাম। কিন্তু পিছন ফিরে যখন তার করুণ, হতাশ মুখটা চোখে পড়ল মনটা এত খারাপ হয়ে গেছিল। পার্লারে পাঁচশ টাকার কাজ করাতে পারলাম আর ওই অসহায় লোকটাকে আমি পঞ্চাশটা টাকা দিতে পারতাম না?
একদিন রাস্তার জ্যামে গাড়ি আটকা পড়ে গেল। জানলা দিয়ে বেশ বুড়ো একটা লোক সাহায্য চাইতে লাগল। চোখ ফেটে তার পানি পড়ছে, বারবার বলছিল আমি ভিক্ষুক না বইন। কিন্তু অবস্থার কারণে এখন আমাকে হাত পাততে হইতেছে। সিগন্যালে গাড়ি আটকা পড়লে যেসব সাহায্যপ্রার্থী এসে হাত বাড়ায় তাদের আমি কখনো গুরুত্ব দেই না। কাকে বিশ্বাস করবো? এরা সবসময় মিথ্যা বলে, যেটা না তার দশগুণ বলে টাকা হাতানোর ফন্দিতে থাকে। বেশিরভাগই ভয়ংকর প্রতারক, মিথ্যাবাদী। অসহায় মানুষটার করুণ, অপমানিত মুখ থেকে আমি চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু সারাদিনে আর এক মূহুর্তের জন্য স্বস্তি পাইনি। কি হতো যদি তাকে দশটা টাকা দিয়েই দিতাম? কেন বিশ্বাস করলাম না অসহায় মানুষটার কথা?
একদিন বন্ধুরা মিলে ধানমন্ডী লেকে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এক মহিলা উদভ্রান্তের মত সামনে এসে বলল তার বাবা মারা গেছে। দেশে যাবে কিন্তু গাড়ি ভাড়া নাই। আমরা যদি একটা সাহায্য করতাম সে তার বাবাকে শেষ দেখা দেখতে পারতো। কিন্তু আমরা তখন আড্ডায় ডুবে ছিলাম। মহিলার কথায় বিরক্ত হলাম আর বিশ্বাসই করলাম না। সে কাঁদতে কাঁদতে উদভ্রান্তের মত ছুটতে লাগল ওখানে বসে থাকা প্রতিটা মানুষের কাছে। সে যখন অনেক দূরে চলে গেল হঠাৎ আমি যেন ফিরে এলাম বাস্তবে। যত বড় ঠকবাজই হোক নিজের বাবাকে নিয়ে কি কেউ মিথ্যা বলবে? তার চোখে যে উদভ্রান্ত দৃষ্টি আর পানি ছিল সেগুলো কি মিথ্যা হতে পারে? কেন বিশ্বাস করলামনা? কেন তাকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করলাম না? কি করতাম যদি এমন কোন পরিস্থিতিতে আমি পড়তাম? সারাদিন আমি কেঁদেছিলাম নিজের বাবার কথা ভেবে। কিন্তু যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে।
জানি অনেক ঠকবাজ, প্রতারক আছে চারপাশে। মানুষকে বিশ্বাস করা খুব কঠিন আজকাল। কিন্তু বিশ্বাসইতো যেকোন কিছুর মূল ভিত্তি। কোন একটা সম্পর্কের প্রথম শর্ত হল বিশ্বাস। এটাই যদি না থাকে তাহলে কোন কিছুতেই আর টিকানো যায় না একটা সম্পর্ক। বিশ্বাস না থাকলে এগুনো যায় না একটা পা-ও।
চাইলে আমরা যেকোন বিষয় নিয়ে দিনভর তর্ক করতে পারি। যুদ্ধও শুরু করতে পারি। কিন্তু যদি বিশ্বাসটা আনতে পারি তাহলে এক নিমিষেই কত কিছু পাওয়া হয়ে যায়। এরজন্যইতো বহুকাল আগে পন্ডিতরা বলে গেছে
"বিশ্বাসে মিলায় বস্তু
তর্কে বহুদূর"
বিশ্বাস করতে পারি নাই বলে বহুদিন বহু কাজ করে পরে হাত কামড়েছি নিজের। আফসোস করেছি। কিন্তু আজকে সেই সুযোগ দেইনি আর নিজেকে। ফেরার পথে যে রিকশাটায় উঠলাম সে রিকশাওয়ালা খুব করুন গলায় বলছিল, এক অপারেশনের রোগী আরেকজনকে বাঁচাতে রাস্তায় নামসি। সে নিজে অসুস্থ। পায়ে কি যেন সমস্যা দেখলাম। তার স্ত্রীর সিজার হয়েছে। হাসপাতালে আছে। এক ব্যাগ রক্ত দিয়েছে, ডাক্তার বলেছে আরো দুই ব্যাগ লাগবে। দুই হাজার টাকা লাগবে সেজন্য। রক্তের গ্রুপ মিলল না বলে দিতে পারলাম না। কিন্তু কিছু সাহায্যতো করতেই পারি। নিজের সাধ্যের মধ্যে তাই তাকে বাড়তি কিছু টাকা দিয়ে দিলাম। জানিনা লোকটা সত্যি বলছে নাকি মিথ্যা কিন্তু তার সদ্যোজাত শিশুটির জন্য করুণ আকুতি আমি কি করে অস্বীকার করি? তাই বিশ্বাস করলাম। যে নতুন প্রাণ এই কুতসিৎ, কদর্য পৃথিবীতে এসেছে সে যেন অন্তত বিশ্বাস না হারায়।