somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের সংস্কৃতি; আমাদের অহংকার

০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জাতির সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাষ্কর্য, চারু ও কারু প্রভৃতি শিল্পকর্মই মূলত মানবজীবন ও জগতের প্রতিচ্ছবি। মানুষের মননশক্তি, চিন্তাশক্তি ও সৃজনশক্তির মধ্যদিয়ে মানবসংস্কৃতি রূপ লাভ করে। কোন একটি জাতির জীবনযাত্রা যেমন- আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, উৎসব-অনুষ্ঠান, ধর্মকর্ম, প্রাত্যহিক ক্রিয়াকলাপ, শিক্ষাদীক্ষা, খেলাধূলা, আমোদ-প্রমোদ প্রভৃতির নিয়মপদ্ধতিই হচ্ছে সংস্কৃতি। একটি জাতীয় ঐতিহ্যই তার সংস্কৃতিকে বিকশিত করে। দীর্ঘদিনের জীবনাচার ও জীবনচর্চার সম্মিলন সংস্কৃতির বুনিয়াদ গড়ে তোলে। এককথায় সংস্কৃতি হল প্রগতি ও পূর্ণতা লাভের একটি সচেতন কর্মপ্রয়াস। আমরা জানি কোন জাতির সংস্কৃতি অকস্মাৎ গড়ে উঠে না। জাতীয় জীবনের দীর্ঘকালের সাধনা ও সৃষ্টির সংরক্ষণ দ্বারা সংস্কৃতির স্বতন্ত্র ও সম্পূর্ণ রূপ লাভ করে। অধিবাসীদের পুরুষানুক্রমে কৃত কাজকর্ম যখন বৈশিষ্টের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে উঠে তখনই জাতিগত পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালীর নিজস্ব সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। জাতির উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা লাভের সূচনা থেকে এ দেশের নির্দিষ্ট পরিবেষ্টনে পারিপাশ্বিকতার প্রভাবে যুগে যুগে স্তর পরম্পরায় জীবন ধারার অনুবর্তন-বিবর্তন দ্বারা আপন মহিমায় বাঙালী জাতি একটি অনন্য সদৃশ অখন্ড রূপ পরিগ্রহ করেছে।

দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাঙালী জাতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হলেও আমাদের সমাজ সংস্কৃতির নিরূপক ও নিয়ামক দিক সমূহের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। বিশেষ করে গ্রাম বাংলার অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রায় অভিন্ন। কৃষি ভিত্তিক উৎপানে, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এবং উৎপাদন সম্পর্কে তেমন পরিবর্তন হয়নি বল্লেই চলে। শ্রমবিমুখতা, দৈবনির্ভরতা, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামী, ভোগবাদ ইত্যাদি কারণে আমাদের চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে তেমন পরিবর্তন সাধিত হয়নি। ফলে বাঙালী সংস্কৃতির নিজস্ব রূপ বৈশিষ্ট আকারে প্রকারে প্রায় অভিন্নই থেকে গেছে।

আমাদের বাঙালী সংস্কৃতির একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বাংলার লোকজ সংস্কৃতি। লোকজ সংস্কৃতি বাংলায় বসবাসকারী উপজাতীয়দের আদিম সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। উপজাতীয় সাঁওতাল, গারো, মনিপুরী, চাকমা, মারমা প্রভৃতি জনসগোষ্ঠীর মধ্যে সহাবস্থান, সহযোগিতা, আদান-প্রদান, পারষ্পরিক বিবাহ, জীবন-জীবিকা ইত্যাদির মধ্যদিয়ে উপজাতীয় উপাদানে বাঙালীর স্বতন্ত্র লোকজ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। লোকজ সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক লোক সাহিত্য। বাংলার লোক সাহিত্য সমৃদ্ধ, বিচিত্র ও বিপুল। লোক সাহিত্যের প্রতিটা শাখার মধ্যেও রয়েছে বৈচিত্র। লোক কাহিনীর মধ্যে রূপকথা, পুরাকথা, ব্রতকথা প্রভৃতি রয়েছে। ছড়ায় আছে- ছেলে ভুলানো ছড়া, ব্রতের ছড়া, খেলার ছড়া ইত্যাদি। গ্রাম বাংলার ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদও বৈচিত্রধর্মী। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর চিত্রকর্ম, নকশী কাঁথা, নকশী পাটি, নকশী পিঠা প্রভৃতি এখনো গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের স্বাক্ষর রাখে। লোক সংগীতের বৈচিত্রও কম নয়। এখনো গ্রাম বাংলার জারি, সারি, মুর্শিদী, ভাওয়াইয়া, বাউল, লালন প্রভৃতি লোকজ গানে লোকজ বাদ্যযন্ত্র সারিন্দা, ঢাক, ঢোল, ডুগডুগি, একতারা, খঞ্জরি, কাসিঁ, জুড়ি, করতাল, বাঁশী ইত্যাদির ব্যবহার আমাদেরকে বিমোহিত করে।

লোক সংস্কৃতির আরেকটি বড় নিদর্শন পাওয়া যায় লৌকিক খেলাধুলায়। লৌকিক খেলাধুলার মধ্যে হাডুডু, বাউছি, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, ডাংগুলি, লাঠিখেলা, কানামাছি, কড়িখেলা, নৌকাবাইচ, ধাঁধার খেলা গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় খেলা হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে তথাকথিত আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রাম বাংলার এইসব ঐতিহ্যবাহী খেলা বিলুপ্তির পথে। বাঙালী জাতির বিচিত্র দিক ষ্পর্শ করে লোক সংস্কৃতির এই অসংখ্য উপাদান। জাতীয় জীবনের গভীরে এর শেখড় প্রথিত। বাঙালীর ঐতিহ্যমন্ডিত নিদর্শণ এই উপাদান হতে অনুসন্ধান করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমান নগর সংস্কৃতির প্রভাবে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যমন্ডিত লোকজ সংস্কৃতির চর্চা ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমরা এখনও অনেকটা পিছিয়ে আছি। কেননা আমাদের নগর সংস্কৃতি হচ্ছে পাশ্চাত্য প্রভাবপুষ্ট, আধুনিকতার আলোকপ্রাপ্ত সঙ্করধর্মী। নগর জীবনে চাকুরি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে কেন্দ্র করে নগরবাসীর সাথে দেশ-বিদেশের নিরন্তর যোগাযোগ এবং বর্তমান আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে নগর সংস্কৃতি দ্রুত পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের ফলে তথাকথিত আধুনিক নগর সংস্কৃতি তথা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আবত্তে আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে হারাতে বসেছি। এখনই সময় বাংলার ঐতিহ্যমন্ডিত লোকজ সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয় নিয়ে নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি করা। আমাদের শেকড় অনুসন্ধান ও সংরক্ষণে আমাদেরকেই ব্রতী হতে হবে।

বিশ্ব দরবারে আমরাই একমাত্র জাতি; যে জাতি রক্তদিয়ে নিজেদের ভাষাকে সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছে। এ জন্য বিশ্ববাসি বাঙালীদের সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করে। এটা আমাদের অহংকার। এই চেতনা নিয়েই মহান মুক্তিসংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা আমাদের আত্মপরিচয় ফিরে পেয়েছি। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, আদিবাসী সকলের সম্মিলনে বাঙালী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ ৪০ বছর পরও দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে আমাদের সেই অর্জন কলুষিত হচ্ছে। দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পুনর্বাসিত হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর সাথে মিলে বাঙালী হত্যা করেছে; যারা এখনও আমাদের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি তারাই এখন ধর্মের লেবাসে রাজনীতির নামে সমাজের তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত ও বিপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করছে। আমরা বাঙালী না মুসলমান অথবা হিন্দু সেই পুরাতন প্রশ্ন ছাড়াও এক নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে আমরা বাঙালী না বাংলাদেশী?

এখনো আমাদের দ্বিধা-বিভক্তি কাটেনি। এই বিভক্তির কারণ হয়তো বৃটিশ শাসনামলে বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনে দু'শতাব্দীকাল ব্যাপী বাঙালীদের মধ্যে যে বিষবাষ্প ছড়ানো হয়েছে তার ক্রিয়া হতে বাঙালীর মন-মানস এখনো সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হতে পারেনি। বৃটিশ শাসনামলের অনেক রীতি-নীতি এখনো আমাদের সমাজ জীবনে অনুসৃত হয়! কিন্তু আমরা আশাহত নই। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের চরম ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত শক্তি এবং সেই শক্তি ও ত্যাগের মহিমায় ঐতিহ্যমন্ডিত বাঙালী সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার প্রত্যয় নিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের আত্মপরিচয় খুঁজে পাবো।





সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১১ সকাল ১১:০৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×