somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক্সক্লুসিভ সমকালীন রাজনীতির দায়িত্বশীল প্রতিচ্ছবি

০২ রা ডিসেম্বর, ২০১১ দুপুর ২:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




১৯৯৮ সনে জাতীয় দৈনিক মুক্তকণ্ঠের সাহিত্য সাময়িকী খোলা জানালা‘র জন্য একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছিলেন আততায়ীর হাতে নিহত সব্যসাচী লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ। রাজনীতিবিদগণ নামে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে লেখা সেই উপন্যাসের ভূমিকাটি লিখে শোনাচ্ছিলেন তিনি আমাকে। তাঁর নিজের হাতে মূল উপন্যাসটির ক¤েপাজ করা ফ্লপি ডিস্কটি তখন আমার পকেটে। তাঁর হাতে লেখা ভূমিকাটি নিয়ে উপন্যাসের অলংকরণ করবে শিল্পী ধ্রুব এষ। ভূমিকাটি তিনি শুরু করেছিলেন খুব সম্ভবত এমন একটি বাক্য দিয়ে-- ‘রাজনীতিবিদদের দু’টি মুখ’... ভূমিকাটি পাঠ করে শুনিয়েছিলেন তিনি আমাকে পুরোটাই। সেটি পাঠ শেষে আমি তাঁকে বলেছিলাম, ‘স্যার, রাজনীতিবিদদের দু’টি মুখ নয়- আমার মনে হয় অনেক ক’টি মুখ। দশানন বললেও ভুল বলা হবে না হয়তো।’ আমার কথা শুনে বোধকরি কিছুটা থমকে ছিলেন তিনি। এরপর তাঁর বাসা থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা শাহবাগের আজিজ মার্কেট পর্যন্ত এসেছিলাম। বলেছিলেন আরও কথা বলার প্রয়োজনীয়তার কথা কিন্তু ব্যস্ততার জন্য আর তাঁর সঙ্গে এ প্রসঙ্গে পরে কথা হয়নি আমার।
রাজনীতি বিষয়ে সব চাইতে বহুল উল্লেখিত বই মেকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স। বইটি যারা পড়েছেন তারা রাজনীতি সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণাই পোষণ করবেন। রাজনীতিতে আমাদের দেশে মেকিয়াভেলির দর্শন সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ এবং প্র্যাকটিস করেছেন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। যেহেতু হুমায়ুন আজাদ স্যারের রাজনীতিবিদগণ উপন্যাসটির বিষয় ছিল এরশাদ জমানার রাজনীতি-- তাই আমি নির্দ্বিধায় রাজনীতিকদের দশানন বলে উল্লেখ করতে পেরেছিলাম। মূলত স্বৈরশাসকরা রাজনীতিকে সত্যিকার অর্থেই ডিফিকাল্ট করে ফেলে। তারা এত ডাইমেনশনে রাজনীতি চালায় যে রাজনীতিকদের সহস্রানন দশা কিংবা পরিণতি ঘটে। তাঁরা নিজেরাও বলতে পারেন না তাদের বহুধাবিস্তৃত অস্তিত্ব বা মুখগুলোর কথা। সত্য-মিথ্যা, গুজব-প্রচারণার বুদবুদে তারা দশচক্রে ভগবান ভূতে পরিণত হন। রাজনীতি সে কারণেও হয়তোবা রাজনীতিমনস্ক পাঠকের কাছে আগ্রহের বিষয়। বাংলাদেশে সংবাদপত্র পাঠকদের এখনো প্রধান খোরাক রাজনীতি। রাজনীতির সদর-অন্দরের খবরাখবর নিয়ে এখনো পাঠকদের ঔৎসুক্যের সীমা-পরিসীমা নেই। একটা প্রবাদ আছে- প্রেমে আর রাজনীতিতে অন্যায় বলে কিছু নেই। মেকিয়াভেলির দ্য প্রিন্সেও এ বক্তব্য প্রাধান্য পেয়েছে। আমাদের দেশেও রাজনীতির এই ধারাটিরই প্র্যাকটিস করছেন রাজনীতিকরা । কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিমনস্ক সাধারণ মানুষ কিন্তু এই আপ্তবাক্যের ঠিক বিপরীত ধারার- তারা রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহী পরিপূর্ণ মোরালিটির ওপর বিশ্বাস রেখে। তাদের কাছে নীতি ও আদর্শই মুখ্য বা প্রধান। ফলে দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে তারা আদর্শহীন রাজনীতিকদের সুযোগ পেলেই প্রত্যাখ্যান করেছেন।
একজন পাঠক হিসেবে আমি বলতে পারি, রাজনীতি নিয়ে লেখা যে-কোনও বইই পাঠককে আকৃষ্ট করে, সেটা রাজনীতিক-এর আত্মকথা হোক আর হোক তার রোজনামচা বা অন্য কিছু। তারই ধারাবাহিকতায় সংবাদপত্রের একজন রাজনৈতিক রিপোর্টার যখন রাজনীতির অনেক অকথিত বিষয়কে কথিত বিষয় করে তোলেন তখন তা ব্যাপক আগ্রহের কারণ হয় পাঠকের। দৈনিক যুগান্তরের বিশেষ সংবাদদাতা পীর হাবিবুর রহমানের লেখা বই অফ দ্য রেকর্ড পড়তে পড়তে আমি মাঝে মাঝেই রীতিমত বিদ্যুৎ¯পৃষ্ট হয়েছি। পথের রাজনীতি, রথের রাজনীতি আর প্রাসাদের রাজনীতির ভেতর একই সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার নানা ডাইমেনশন আবিষ্কার করে।
এ বছর একুশের বই মেলায় পীর হাবিবুর রহমানের দ্বিতীয় বই এক্সক্লুসিভ বের হয়েছে। এ বইয়ে পীর হাবিব তার কিছু এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট আর সেই রিপোর্টের পটভূমি তুলে ধরেছেন। যা রাজনীতিমনস্ক কৌতূহলী পাঠককে তৃপ্ত করবে। এ বইয়ের প্রথম লেখাটির শিরনাম অন্য এক বঙ্গবন্ধু-- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা তাঁর রাজনৈতিক সচিব জননেতা তোফায়েল আহমেদ-এর স্মৃতিচারণায় এক মহান নেতার মহৎ মানবিক চরিত্র ফুটে উঠেছে। তোফায়েল আহমেদ বর্ণনা করেছেন, স্বাধীনতা উত্তরকালে সারা দেশে যখন নকশাল আন্দোলনের নেতা কমরেড তোয়াহাকে পুলিশ, রক্ষীবাহিনী খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন তিনি তাঁকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুর বাসায় বসে তাঁর সঙ্গে গল্প করতে। কমরেড তোয়াহার আত্মজীবনীতেও বঙ্গবন্ধুর এই ঔদার্যের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন কমরেড তোয়াহা নিজে। রাজনৈতিক সহযাত্রীদের প্রতি এই ঔদার্য আরও অনেকের জন্য ছিল বঙ্গবন্ধুর। আজ রাজনীতির মানে যেন হয়ে উঠেছে পর¯পরের জানি দুশমনী কিন্তু একটা সময় এমন ছিল না। এমনটা কাম্যও নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে তো আরো বেশি কাম্য নয়- বর্তমান রাজনীতির এই কুৎসিত চেহারা। যাকে বলে রাজনৈতিক-সংস্কৃতি তা যেন পুরোপুরি লোপ পেয়েছে আমাদের বর্তমান রাজনীতি থেকে। পীরের লেখায় বারবার এই শব্দটি এসেছে বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন রাজনীতি প্রসঙ্গে। মরহুম সবুর খান, শাহ আজিজ, ফজলুল কাদের চৌধুরী, তোয়াহার মতো বিপরীত মেরুর রাজনীতিকদের প্রতি যে সহিষ্ণুতা সহমর্মিতা আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবনে দেখি তা কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের রাজনীতিতে শূন্য-- অনুপস্থিত। রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই অনুপস্থিতি এবং শূন্যতার কারণে রাজনীতি হয়ে উঠেছে অশ্লীল-খিস্তি খেউড়ের উৎস। পবিত্র জাতীয় সংসদ হয়ে উঠেছে বকাবকির কারখানা।
গত কয়েক বছরে সমকালীন রাজনীতি সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট- যেগুলো রাজনীতি সচেতন পাঠককে খুব আলোড়িত করেছে সেগুলোর সমাহার পীরের এই বই। যেমন হানিফের ধর্ম-কর্ম ও সাহাবুদ্দীনের ক্যাসেট, এরশাদ বিদিশার তালাক পর্ব, লিডার ও রাজনীতির মুখ, লন্ডন আফটার সেভেন সেভেন, পয়সা দিলে দুনিয়া মিলে দিল না দিলে ভোট মিলে না, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কার ইস্যু, মৃত্যুর কাছ থেকে দেখা, সারপ্রাইজ আর আলোর ইশারা, জাতীয় সরকার গঠনে দেশী বিদেশী জল্পনা এবং ঘনীভূত রাজনীতি ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ- এইসব প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে একজন নির্মোহ সংবাদকর্মী এবং সংবেদনশীল প্রতিবেদকের উপস্থিতি লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছে।
একজন সংবাদকর্মীকে কেবল খবরের পেছনে ছুটলেই হয় না বুঝতে হয় ঘটনার গতিপ্রকৃতিও। কেবল যা ঘটেছে তার বর্ণনাই সংবাদ নয়, সংঘটিত ঘটনার তাৎপর্য ও সম্ভাব্য পরিণতিতে আরও কী কী ঘটতে পারে তা বুঝে ওঠার চেষ্টা ও ক্ষমতাও তার থাকা প্রয়োজন। এটি আরও বেশি থাকা প্রয়োজন রাজনৈতিক বীট-এর সংবাদকর্মীর, যা কিনা আছে পীর হাবিবের। যাকে বলে সিক্সথ সেন্স- যে সেন্সের অধিকারী রিপোর্টারের কাছে সংবাদ এসে ধরা দেয় নিজে নিজে। যার হাতে প্রতিদিনের সংবাদ হয়ে ওঠে সংবাদের চেয়ে বেশি কিছু।
পীর হাবিবুর রহমানের এই বইটি পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে এই বইয়ের অনেক প্রসঙ্গ নিয়েই আলাদা আলাদা এক একটি বই হতে পারে। যেমন জাতীয় সরকার প্রসঙ্গে তার যে রিপোর্টিং, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কার প্রসঙ্গটি, হানিফের ধর্ম কর্ম প্রসঙ্গ কিংবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের ক্যাসেট প্রসঙ্গ। অন্য এক বঙ্গবন্ধু এবং লিডার ও রাজনীতির মুখ এগুলোও দাবি করে আরও বিস্তৃত পরিসর। একটি বইয়ের মধ্যেই পীর হাবিব অনেক বইয়ের উপকরণ জড়ো করেছেন।
আমাদের সমাজে রাজনীতিবিদরা বর্তমান সময়ে সবচাইতে অজনপ্রিয় ও নিন্দিত চরিত্র- এ কথা বললে বোধ হয় ভুল বলা হবে না। কিন্তু তারাও যে নানা স্বার্থ আর টানাপড়েনের অসহায় বলির পাঁঠা সে কথারইবা আমরা ক’জন খবর রাখি? রাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণ পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনে পীরের এক্সক্লুসিভ-এর মতো রাজনৈতিক বিষয়াবলী সমৃদ্ধ বইয়ের গুরুত্ব যে কোনও পাঠকই বোধ করবেন বলে আমার বিশ্বাস।
সমকালীন রাজনীতিকে হৃদয়বান কবির মমতায় গেঁথে তোলা এই বইটি পাঠক মাত্রকেই পড়তে বলব আমি, কেননা রাজনীতিকে কেন্দ্র করে রচিত একটি দায়িত্বশীল বই এটি। বইটির চমৎকার প্রচ্ছদ কবি আবু হাসান শাহরিয়ার কৃত।

এক্সক্লুসিভ। পীর হাবিবুর রহমান। প্রথম প্রকাশ : একুশের বইমেলা ২০০৬। প্রকাশক : সাহিত্য বিকাশ। প্রচ্ছদ : আবু হাসান শাহরিয়ার। মূল্য : ১৪০ টাকা।
শুচি সৈয়দ


০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যমদূতের চিঠি তোমার চিঠি!!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:০৮

যমদূতের চিঠি আসে ধাপে ধাপে
চোখের আলো ঝাপসাতে
দাঁতের মাড়ি আলগাতে
মানুষের কী তা বুঝে আসে?
চিরকাল থাকার জায়গা
পৃথিবী নয়,
মৃত্যুর আলামত আসতে থাকে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে
স্বাভাবিক মৃত্যু যদি নসিব... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×