সাত বছরের বালক বিজয় আর তা মা গল্প করছে।ছেলেকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করিয়েছে গ্রামের স্কুলে।তার সাথে বাড়ির অন্য ছেলেমেয়ে থাকায় বিজয়ের মাকে তার সাথে যেতে হয়না।অন্য সবার সাথে বিজয় দলবেধে স্কুলে যায়।স্কুল ছুটির সময় হলে মা বাড়ির পুব কোনায় গিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে বিজয়ের পানে।ছোট্ ছেলে সাথে অন্য ছেলেমেয়ে থাকলেও মা চিন্তায় থাকে ঠিক মত আসতে পারবে কিনা,কারো সাথে ঝগড়া করে কিনা,অন্য কোথাও চলে যায় কিনা?সব চেয়ে বেশি চিন্তা তখনই হয় যখন ছেলের ফিরতে একটু দেরি হয়।যখন দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে উঠে আমার ছেলে বিজয় আসছে,হ্যা,সে-ই আমার বিজয়,বিজয়ই এভাবে হাঁটে মা’র গর্বে বুক ফুলে উঠে ছেলে লেখাপড়া করে আসছে।মা চেয়ে চেয়ে দেখে কী সুন্দর আমার বিজয়ের হাঁটা কেমন কেমন গুটি গুটি পায়ে হাটছে ব্যাগটা কাধে নিয়ে,আবার হাসে যখন দেখে রাস্তায় পড়ে থাকা কিছুকে ফুটবল বানিয়ে কেমন করে খেলতে খেলতে আসছে,কিংবা নানা রকম দুষ্টমি করছে।যখনি বিজয় তার মা কে দেখতে পায় আম্মু বলে দূর থেকেই চিৎকার শুরু করে দৌড় দেয় মায়ের বারন উপেক্ষা করে।মাও চিৎকার করে বলতে থাকে আস্তে আস্তে বাবা পড়বি,কে শোনে কার কথা।দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরে মাকে।মায়ের আচল তলে লুকিয়ে পড়ে।পরে মায়ের হাত ধরে ঘরে ফিরে।মা চুলোয় আগুন দিচ্ছে আর ছেলে পাশে বসে খাচ্ছে,আর চলছে তাদের মধ্য গল্প।স্কুলে আজ কী ঘটল না ঘটল সব ভাগাভাগি হচ্ছে মা আর ছেলের মাঝে।ছোট ছেলে পৃথিবী সম্পর্কে তার জ্ঞানই বা কতটুকু,তাই পৃথিবীকে জানার আগ্রহ নিয়ে অন্য সকল শিশুর মত সেও তার মাকে নানা রকম প্রশ্ন করে।তার মাও যেভাবে তাকে বুঝানো সম্ভব সেরকম করেই তাল মিলিয়ে যাচ্ছে।হঠাত করে সে বলে উঠল;
-মা,কাল স্কুল বন্ধ,ক্লাস হবেনা,স্যাররা বলছে যাওয়ার জন্য কিসের নাকি অনুষ্ঠান হবে?কালকে নাকি ১৬ ডিসেম্বর!
-ও হ্যাঁ।কাল তো ১৬ ডিসেম্বর।বিজয় দিবস।
- হ্যাঁ,স্যাররাও বলছে কাল বিজয় দিবস।মা,বিজয় দিবস কী?
-বিজয় দিবস হল,বাঙ্গালীর মুক্তির দিবস।বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যুদ্ধ হয়েছিল
-যুদ্ধ?কার সাথে?
-হ্যাঁ,পাকিস্তানিদের সাথে।তোমরা তখন কোথায় ছিলে?
-আমরা তখন ছোট ছিলাম।
-তোমাকে মারেনি?
বিজয়ের মুখে এ প্রশ্ন শুনার সাথে সাথেই নিরবে তার মায়ের চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে।সে কান্না কন্ঠেই ছেলেকে বিজয় দিবস কি তা তার প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়।
মায়ের কান্নার কারন হল,-বিজয়ের প্রকৃত বাবা ছিল মুক্তিযোদ্ধা।সে যুদ্ধে শহীদ হয়েছে।আর যুদ্ধের সময় বিজয় ছিল তার গর্ভে।নবজাতক ছেলের মুখ দেখে যেতে পারলনা বিজয়ের বাবা।তাকে যুদ্ধে যেতে বারন করেছিল বিজয়ের মা।কিন্তু তার দেশপ্রেম তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি।সে তখনো জানতো কিছুদিন পর সে পিতা হবে।সে বিলকিস কে বলে দেখো আমি ঘরে লুকিয়ে থেকে কী লাভ যদি দেশ স্বাধীন না হয়,বিজয় না আসে?তাহলে আমার সন্তান পৃথিবীতে এসে কী লাভ,যদি সে স্বাধীন ভুখুন্ড না পায়?আমার ছেলের জন্য হলেও আমাকে যুদ্ধে যেতে হবে।মোশাররফের তীব্র ইচ্ছা বিলকিসের মন গলাতে সমর্থ হয়।মোশারফ যুদ্ধে চলে যায়।তার পোষ্টিং হয় কুমিল্লায়।খুব বেশি দূরে তাকে যেতে হয়নি,নোয়াখালী থেকে কুমিল্লা।বিজয়ের জন্মলাভের খবর বিলকিস চিঠি দিয়ে মোশাররফকে জানায়-
“
……আমরা ভালো আছি।আমাদের জন্য চিন্তা করতে হবেনা।আমাদের ছেলে হয়েছে।নাম কী রাখবো ভেবে পাচ্ছি না।ছেলের জন্য একটা সুন্দর নাম খুজবেন।ছেলে ঠিক তার বাবার মত হয়েছে।ওখানকার কী খবর আমাদের চিঠি দিয়ে জানাবেন?তাড়াতাড়ি ফিরে আস,বাবু তার আব্বাকে দেখার জন্য কাঁদছে।আম্মার শরীরটাও বেশি ভালো নেই।সারাক্ষন শুধু মোশাররফ মোশাররফ করে…………
”
মোশাররফের ছেলে হওয়ার খুশিতে সেদিন পুরো ক্যাম্পে আনন্দ বিরাজ করেছিল।ছেলেকে এখনো দেখতে না পেরে আর মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে মোশাররফের মন ব্যাকুল হয়ে উঠে বাড়ির জন্য।ক্যাম্পের সবাই মোশাররফকে স্বান্তনা দেয়।মোশারফকে বউকে ফিরতি চিঠি পাঠায়-
“
……আমরা ভালো আছি।আমাদের জন্য চিন্তা করো না।কাল একটা অপারেশন আছে আল্লাহর কাছে দোয়া কর যেন ভালো ভাবে অপারেশনটা শেষ করতে পারি আর আমার বিজয়ের জন্য বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারি।অপারেশন শেষ করে আমি একবার এসে বিজয়কে দেখে যাব…………
”
আর আসা হল না মোশাররফের।সেই অপারেশন সফল হলেও মোশাররফ সেই সফলতায় জীবন হারাল।পরবর্তীতে মোশাররফের সাথে একই ক্যাম্পে থাকা পাশের এলাকার কামালের মাধ্যমে বিলকিস জানতে পারে মোশাররফ শহীদ হয়েছে।এবং পরিস্থিতি অনুকুলে না থাকায় তাকে সেখানেই কবর দেয়া হয়েছে।ছেলের নাম বিজয় রাখা হল আর দেশেরও বিজয় হল ঠিকই কিন্তু মোশাররফ ফিরে এলো না।বিজয় আনতে গিয়ে মোশাররফ পরাজিত হল।যদিও প্রকৃত অর্থে এ পরাজয় নয়।এ মোশাররফের বিজয়-ই।তার আত্নত্যাগের ফসল হল এই বিজয়।
কেটে গেল অনেকদিন।পরিস্থিতি অনুকুলে আসল।দেশ স্বাধীন হল।মোশাররফের শহীদ হওয়ার কথা শুনে তার বৃদ্ধ মা সেদিনই হার্ট এটাক করে মারা গেল।বিলকিস তার বাবার বাড়ি চলে গেল।ভেবেছিল বিজয় কে নিয়ে-ই বাকি জীবন কাটিয়ে দিবে।তা হল না।পরবর্তীতে আরেকজনের সাথে বিলকিসের বিয়ে হয়।বর্তমানে বিলকিস ঐ ঘরেই আছে।নতুন করে বিজয়ের আর কোন ভাই বোন হয়নি।অনেকটা সুখেই কাটছে তাদের দিনকাল।
মায়ের মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনে বিজয় তার মা কে বলেছিল,-মা আমিও যুদ্ধ করবো,আবার যুদ্ধ হবে কবে?আমিও শহীদ হব।
ছোট্ট ছেলের মুখে এমন সাহসী কথা শোনে মা বিজয়কে জড়িয়ে ধরে।আর বলে
-না,বাবা,আমি আর কাউকে হারাতে চাই না।তোমাকে আর যুদ্ধ করতে হবে না,আমরা এখন স্বাধীন,আমাদের কেউ আর কিছু করতে পারবেনা।
আজ ১৬ই ডিসেম্বর।মহান বিজয় দিবস।অন্য ছেলেমেয়ের সাথে বিজয় অনুষ্ঠান দেখতে স্কুলে চলে গেল।স্কুল সাজানো হয়েছে রং বেরং্যের কাগজের টুকরা আর পতাকা দিয়ে।অনেক দোকান পাটের সামনেও পতাকা টাঙ্গানো হয়েছে।বিজয় কিছুক্ষন থেকে বাড়ি চলে আসল।আসার সময় কোথা থেকে একটি কাগজের পতাকা পেয়ে নিয়ে আসার সময় ছেলেমেয়েদের কাড়াকাড়িতে পতাকাটি ছিড়া যায়।বিজয় কাদতে কাদতে বাড়ি ফিরে।তার মা জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে।বিজয় মাকে খুলে বলে।তারপর মাকে বলে
-মা,আমাকে একটা পতাকা বানিয়ে দাও।
-পতাকা দিয়ে কি করবি?
-সব খানে দেখছি পতাকা টাঙ্গানো।তারা কেন টাঙ্গায়িছে?আর তুমি না একদিন বলেছিলে আমাদের বাঙ্গালিরা এই পতাকার জন্য যুদ্ধ করেছিল।আমাকে একটা পতাকা দাও আমি আমাদের ঘরের সামনে টাঙ্গিয়ে দিব।
মায়ের মনে পড়ে যায় ঘরে একটি পতাকা থাকার কথা।মা খুজতে থাকে।খুজতে খুজতে আবার মায়ের মনে পড়ে যায় পতাকাটি মোশাররফ সাথে করে নিয়ে গেছে।মা কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা।বিজয়কে কি করে থামাবে?মা বিজয়কে ডেকে ঘরে নিয়ে যায়।বলে আমি তোমার কপালে সুন্দর করে একটি পতাকা একে দেব।তুমি সারাদিন ঘুরবে আর সবাই দেখবে কেউ ছিড়তে পারবে না।ছেলেবেলায় মায়েরা শিশুদের কপালে টিপ দিয়ে দিত।ঠিক তেমন করে আজ বিজয়ের মা বিজয়ের কপালে একটি লাল টিপ একে দেয় আর তার চারপাশে সবুজ রঙ দিয়ে পতাকার মত করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা একে দেয়।বিজয় আয়নার সামনে নিজেকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে যায়।মায়ের আচল থেকে পতাকা খচিত বিজয় দৌড়ে বেরিয়ে যায়।বিজয়ের উচ্ছ্বসিত চেহারা দেখে মায়ের চোখ জলে ভিজে যায়।মা চেয়ে থাকে আর বিজয় দৌড়ে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায়।