হুমায়ূন আহমেদ সাহেব একটি লেখা দিয়েছেন প্রথমআলো পত্রিকায়। আমি সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কথা বলছিনা। যিনি লেখা দিয়েছেন, তিনি তাঁর সাহিত্য-পরিচয়ের ঊর্ধ্বে একজন বাবা হিসেবে মানুষের কাছে তাঁর মনের অবস্থা বোঝানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। লেখাটা যখন পত্রিকায় ছাপিয়েছেন, আমি ধরে নিচ্ছি তিনি চেয়েছেন বাংলাদেশের সকল মানুষ, যারা কিনা সকালের খবরের কাগজ প্রথমআলো হাতে নিয়ে পড়ে কিংবা অনলাইনে পড়ে, তারা এই লেখা পড়ুক।
একবন্ধুর দেওয়া লিঙ্ক ধরে আমি অনলাইন ভার্সনটা পড়লাম। লেখকের অনেক ভক্তের মন্তব্য-ও পড়লাম। বেশিরভাগ মন্তব্যে দেখলাম লেখকের মেয়েদের প্রতি তাদের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে, লেখকের প্রতি করুণা প্রকাশ পেয়েছে। অল্প কয়েকজন আবার লেখকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কটাক্ষ করেছে, আবার দু’একজন তাঁর মেয়েদের পক্ষে মন্তব্য রেখেছেন।
যেহেতু লেখাটি কোনও গল্প/কবিতা নয়, আমি লেখাটিকে সাহিত্য ক্যাটাগরিতে ফেলতে পারলামনা। কথাসাহিত্যে একটা ইস্যু থাকে, একটা বক্তব্য থাকে, যা কিনা প্রাসংগিক আলোচনার ভিত্তিতে বের হয়ে আসে, যা কিনা পাঠকদের তথা দেশের মানুষদের ভাবনার খোরাক যোগায় কিংবা তাদের ভাবনাকে আরো ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলে। উদাহরণ হিসেবে আমি কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের লেখার কথা বলতে পারি।
আত্মকথন। হুমায়ূন আহমেদ সাহেব আত্মকথন ছাপাচ্ছেন। ব্লগে আমরা যেমন লিখে থাকি, মাঝে মাঝে। ঔপন্যাসিক, লেখক হুমায়ূন আহমেদের অনেক লেখা আমার ভালো লাগে। কিছু কিছু বই রীতিমত সংগ্রহে রাখার মতো। তাঁর লেখনশৈলী কিংবা সাহিত্য-মান নিয়ে কথা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করার আগ্রহও আমার নেই। তিনি ক্যানসার রোগে আক্রান্ত, ইনশাআল্লাহ তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন, এই কামনা করি।
আমি কথা বলবো সেইসব মন্তব্যকারীদের নিয়ে, যারা কিনা এই লেখা পড়ে সহানুভূতি-উপচানো মন্তব্যে প্রথমআলো তো বটেই, ফেসবুক পর্যন্ত ভাসিয়ে দিয়েছেন। আমি অন্যকোনও নেটওয়ার্কে তেমন সক্রিয় নেই, জানিনা এমন সহানুভূতির জোয়ারে সেইসব এলাকাও ভেসেছে কিনা। তিন-ডাব্লিউ নামের এই লেখা পড়ে মন্তব্যকারীরা লেখকের মেয়েদের প্রতি প্রচন্ড ক্ষোভে মাতোয়ারা হয়েছেন। কেন? কারণ লেখক বলেছেন, তিনি মানুষ হিসেবে খারাপ, কিন্তু তিনি একজন ভালো বাবা। তাঁর পঞ্চাশোর্ধ জীবনের বইয়ের দুই-এক লাইনের ঘটনা-বর্ণনার মাধ্যমে তিনি তাঁর মেয়েদের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার সার্টিফিকেট নিজেই দিয়ে ফেললেন। সমগ্র দেশের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফেললেন তাঁর কন্যাদেরকে, যার ফলশ্রুতিতে পাঠকদের এইধরণের মন্তব্য।
এত রাগ কেন আপনাদের ওনার মেয়েদের প্রতি? ওনার জন্যে এত সহানুভূতি কেন? কারণ তিনি দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত বলে? নাকি পত্রিকাটা প্রথমআলো বলে? নাকি তিনি হুমায়ূন আহমেদ বলে? তা-ও আবার এই লেখার ভিত্তিতে?!! একই লেখা যদু-মধু-রাম-শ্যাম কেউ লিখলেও কি এমন মন্তব্য আসতো?
অনেকে বলে, মা-এর মত করে ভালোবাসতে একজন বাবা কখনও পারেনা। আমাকে বিভিন্ন অজুহাতে, ঘটনাচক্রে এই কথা শুনতে হয়েছে অনেকের কাছ থেকে। কিন্তু আমি এখনও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি এবং আজীবন করে যাবো, আমার বাচ্চাদের প্রতি তাদের বাবার ভালোবাসা, তাদের প্রতি আমার ভালোবাসার চেয়ে কম হবেনা। বেশি হলেও আমি অবাক হবোনা। প্রকাশ ভিন্ন হতে পারে, কিংবা অপ্রকাশিত থেকে যেতে পারে, তবু, ভালোবাসা আছে, এবং থাকবে। আমি একজন মা, আমার বাচ্চাদের আমি সমস্ত স্বার্থের উর্ধ্বে ভালোবাসি। একইভাবে ওদের বাবাও ওদের ভালোবাসে এবং বাসবে, আমি তাইই বিশ্বাস করি। স্নেহ নিম্নগামী। ওরা আমাকে কী দিলো, বা দিবে, সেটার হিসেব করে বাবা-মার ভালোবাসা হয়না। আমি বহুবার আমার বাবা-মা কে আঘাত দিয়েছি, আসলে আঘাত ছাড়া আর কিছু দিয়েছি বলে মনে পড়েনা। কিন্তু ওনারা মহান, আমাকে আজও ওনাদের প্রার্থনায় রেখেছেন। আমার বিপদের সময় আমাকে শক্তি দিয়েছেন। যদিও আমার সুখের সময় আমি বহুবার ওনাদের ভুলে গিয়েছিলাম। এমনই হয়ে আসছে, এমনটাই হয়ে থাকে। আমি জানিনা আমি কতটা ভালো-মা, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি এর বাইরে নিজের ভূমিকা ভাবতে পারিনা। বাবা-মা হিসেবে বাচ্চাদের সামনে সম্মানজনক কাজ করতে হবে, যাতে ওরা বাবা-মাকে নিয়ে হীনমন্যতায় না-ভুগে, কিংবা মনের ভেতরে কোনও কষ্ট না-পুষে রাখে। সন্তানেরা সবসময় কষ্ট দেবে এমনটা কাম্য নয়, তবু বাবা-মা ক্ষমা করে দেবে, এমনটা কাম্য। আমি বাবা-মা হিসেবে একজন মুরুব্বি, আমার সম্মান প্রাপ্য, তাহলে এর সাথে সাথে দায়িত্ববোধের কথা ভুললে চলবে কি করে? আমি একতরফা আমার দাবী রেখে যাবো, এমনকি সমগ্র দেশবাসীর সামনে আমার জানের-টুকরা বাচ্চাদের কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে সস্তা কান্নায় পত্রিকা ভাসিয়ে দেব, ওদের সেখানে কথা বলার কোনও সুযোগ নেই, কারণ তাদেরকে প্রথমআলো সেই সুযোগ দেয়নি; ওদের সেই পপুলারিটি নেই যেটা সাহিত্যিক হিসেবে আমার আছে---বাহ!! কেয়া বাত হ্যায়!!
আমার সাথে আমার বাবা’র যদি কোনও দ্বন্দ্ব থেকে থাকে, সেটার বিচার নিশ্চয় উনি পাশের বাসার মানুষের কাছে চাইবেন না! বাবা আমাকে মারতে পারেন, ধমক দিতে পারেন, সেই অধিকার ওনার আছে। আমার কাছে পিতৃত্বের অধিকার নিয়ে উনি স্নেহ চাইতে পারেন, আশ্রয় চাইতে পারেন, সম্পর্কের সেই জোর ওনার আছে। উনি দরকার হলে কোর্টে যেতে পারেন, প্রমাণ-সাপেক্ষে ওনার সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে পারেন। আবার সেই বাবা-ই কিন্তু নিজে না-খেয়ে সন্তানের মুখে খাওয়া তুলে দিতে পারেন। সেই বাবাই কিন্তু সারাজ়ীবন তিলতিল করে সঞ্চয় করা পেনশনের টাকা সন্তানের আব্দারের মুখে তার হাতে তুলে দিতে পারেন।
কিন্তু এমনকি কি কখনও হয়, যে একজন বাবা, নিজের সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে, বাচ্চাদের সাথে অসম প্রতিযোগিতায় নেমে, নিজেকে নিজেই জয়ী করে নিজের পিঠে বাহবা দিতে পারেন?
আমি জানিনা হুমায়ূন আহমেদ সাহেব এই মন্তব্যগুলো পড়ছেন কিনা। কেমন লাগছে একজন ‘ভালো-বাবা’র এখন? খুব খুশী উনি? এই যে ওনার এই ‘সাহিত্য-কর্মের’ মন্তব্য হিসেবে ওনার মেয়েদের প্রতি দেশের মানুষের এত রাগ ফুটে উঠছে, এইই তো চেয়েছিলেন তিনি? উনি তো self-declared ভালো-বাবা, আপনারা যারা পাঠক হিসেবে ওনাকে একজন বাবা-ভূমিকায় তুমুল ভোটে জয়ী করে দিলেন এবং সন্তানের ভূমিকায় তাঁর মেয়েদেরকে যা-তা বললেন, আপনাদের কী মনে হয়? একজন বাবা’র এখন কেমন অনুভূতি হওয়া উচিত? আপনারাও তো কারো-না-কারো বাবা/মা। বাচ্চাদের এমন পাব্লিক ইস্যু করে, ওনার জায়গায় নিজেকে রেখে দেখুন, এবার আপনারাও খুশী তো?