না চাচা,কলেজে যাচ্ছি।আনোয়ার ভাবলো একটা ফুল অবশ্যই দরকার।ভালোবাসা আর ফুল হল একে অপরের পরিপূরক।তাই আনোয়ার কলেজে ঢোকার আগে ফুলের দোকানে গেল।
আনোয়ার ফুলের দোকানে গিয়ে দোকানদারকে ফুলের দাম জিজ্ঞেস করল।
দোকানদারঃকয়টা নিবেন?কোন অনুষ্ঠানের জন্য?
আনোয়ারঃবেশি না,আর কোন অনুষ্ঠানের জন্যও না।
দোকানদাররা ফুলের স্তুপ থেকে ফুল বেছে বেছে আলাদা করে ভালো খারাপ আলাদা করে রেখেছে।
দোকানদারঃকাউকে দেয়ার জন্য?-ভাই,আপনে এটা নিয়ে যান(নিন),(একটা ফুল হাতে তুলে দিয়ে)।আপনার কোন টাকা লাগবেনা।যদি কাজ হয় তাহলে পরে দিলে চলবে।
আনোয়ারের ইচ্ছে ছিল সাথে……
আনোয়ারকে আর কোন কথাই বলতে দিল না আধো পাগল দোকানদারটা।তার কথার জন্য আনোয়ার কোন কথা বলার সুযোগ পেলনা।শেষ পর্যন্ত অপমানিত হয়ে ফুল না নিয়েই চলে আসল।
আনোয়ার আর কোন ফুলের দোকানে ঢু মারলেন না।মন খারাপ করে হাটতে লাগলেন।একটু এগুতেই দেখলেন একটি ভয়াবহ দৃশ্যের জীবন্ত প্রান।যা আনোয়ার কখনই আশা করেনি।কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস তাকে তা নিজের চোখেই দেখতেই হল।যার জন্য ফুল কিনতে গিয়ে একটু আগে আনোয়ার অপমানিত হয়ে এসেছেন ফুল দোকানদারের কাছে।সেই মেয়েটি তারই বর্ষের এক ছেলের সাথে হাঁটতে হাঁটতে এদিকে আসছে,হাতে ফুটন্ত টকটকে লাল গোলাপ,মুখে প্রাপ্তির হাসি।ছেলেটি আনোয়ারের ক্লাসের,আনোয়ারকে দেখে সে কেটে পড়ার চেষ্টা করল।পাশ কাটিয়ে হাটতে চাইল।সে ভাবল এই লিলিপুটের সাথে কথা বললে মেয়েটির সামনে তার আত্নসম্মানে আগাতে হানবে।তাই কথা না বলে এড়িয়ে যেতে চাইল।আনোয়ার ভাবল সে হয়ত তাকে দেখেনি।মেয়েটি সামনে থাকায় সে প্রথমে আনোয়ারকে অতিক্রম করল ।তারপর যখন ছেলেটি আনোয়ারকে অতিক্রম করতে যাচ্ছে আনোয়ার ডাক দিল –কিরে সুমন কই যাছিস?আনোয়ারের মনে তখনো আশার প্রদীপ নিভু নিভু করে জ্বলে যাচ্ছে।মনে করল বন্ধুর থেকে বিস্তারিত জানবে ঘটনাটা কী?কিন্তু সুমন তাকে না চেনার ভান করে এড়িয়ে গেল।আনোয়ারের ডাক মেয়েটির কান পর্যন্ত পোছে গেছে অথচ সুমন শুনতে পায়নি।সুমন আর মেয়েটি যখন একই রেখায় আসল, মেয়েটি সুমন কে জিজ্ঞেস করল-কে যেন সুমন সুমন বলে ডাক ছিল,সাড়া দিলে না কেন?সুমন বলল-কই শুনিনি তো।হতে পারে অন্য কাউকে ডেকেছে।বাংলাদেশে তো আর আমি একজন সুমন নই নিশ্চয়ই আরো অনেকে আছে।
সুর্যটা তখনো আনোয়ারের মাথার উপরে অবস্থান করছে।এত উজ্জ্বলতা,এত কিরন,এত তাপ!,কারো কারো শরীর ঘেমে একাকার।কিন্তু আনোয়ার এখনো অনড়।এই মুহুর্তে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা পাগলকেও হার মানায়।অথচ আনোয়ার পাগলকে হার মানিয়েই সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে সুর্যের এই প্রখরতাকে কিছুই মনে হচ্ছেনা,সে মোটেও টের পাচ্ছেনা।সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সূর্যকে অভ্যর্থনা জানানোর কারনেই হয়ত সুর্যটা তার উপরে এতটা সহায়।কিন্তু আনোয়ার বোধহয় এমনটা চায়নি।আনোয়ার চেয়েছিল ঐ ভয়াবহ দৃশ্যের সময় সুর্যটা নিভে গিয়ে পৃথিবীকে মুহুর্তের জন্য অন্ধকারে চেয়ে দিবে।তাহলে তো আর আনোয়ারকে এমন দৃশ্য দেখতে হত না।কিংবা দেখার পরে কেন পরিবেশটা পালটে দিয়ে হটাৎ করে বৃষ্টি পড়েনি।তাহলে হয়ত আনোয়ার স্বান্তনা পেত এই ভেবে যে আকাশ,চন্দ্র,সুর্য তারা সবাই তার জন্য কাঁদছে কিংবা তারাও এমন মেনে নিতে পারেনি।
আনোয়ার খোঁজ নিয়ে জানতে পারল আসলেই অই মেয়েটির ছেলেটির সাথে সম্পর্ক আছে।
আজ আর কলেজে যায়নি আনোয়ার।তার গলার স্বর নেমে এসেছে।হাঁটছে গুটি গুটি পায়ে।স্বাভাবিকের চেয়েও ধীরে।তার সমস্ত বল যে নিঃশ্বেষ হয়ে গেছে।এতক্ষন প্যান্টের ভিতর গুজে থাকা শার্ট প্যান্টের ভিতর থেকে খুলে ফেললেন।নদীর ধারে গিয়ে বসলেন।চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে।তবু একমনে চেয়ে আছেন কখনো নদীর দিকে কখনো আকাশের দিকে।মাঝে মাঝে হালকা বাতাস এসে নিজেকে ছুয়ে যায়,কখনো বা কয়েকটি চুল বাতাসের সাথে দোল খেয়ে উঠে।কিছুক্ষন পর নিজে নিজেই প্রকৃতির সাথে কথা বলতে শুরু করেছেন-‘’সৃষ্টিকর্তা যা কিছু করছেন মঙ্গলের জন্য।আগে জেনে গিয়েছি ভালোই হয়েছে।নিজের কষ্ট নিজের কাছেই থাক।কাউকে বুঝানোর দরকার নাই।আমার মত লিলিপুটকে সে কখনোই মেনে নিত না,শুধু শুধু অপমানিত হয়ে ফিরে আসতাম।’
এতদিন অন্য সবাই তাকে লিলিপুট বলে ডাকত বলে মন খারাপ করত অথচ আজ নিজেই নিজেকে লিলিপুট বলে স্বান্তনা দিচ্ছে।আনোয়ার জানেনা আদৌ তার জীবনে কেউ আসবে কি না?
নেতা আসবে কলেজে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে।তার দলের কর্মীরা প্রস্তুতি নিতে লাগল।নেতার সামনে মিছিল করবে,বিরাট মিছিল নিয়ে নেতাকে অভ্যর্থনা জানাবে।কলেজে তার দলের নেতারা জানতে পারল কলেজে একজন লিলিপুট আছে।লিলিপুট কে সাজিয়ে মিছিলের সামনে রাখলে সুন্দর দেখাবে,মিছিল সবার চোখে পড়বে।শুরু হল লিলিপুটকে নিয়ে টানা টানি।এ নেতার দল ও নেতার দল সবাই লিলিপুটকে চাচ্ছে।একবার এরা এসে হুমকি দেয় আপনি আমাদের সাথে থাকবেন আবার ওরা এসে হুমকি দেয় আপনি আমাদের সাথে থাকবেন।লিলিপুট এখনো অবগত নয় তাকে দিয়ে কি হবে।ভাবনার অধিক গুরুত্ব এবং লোক মুখে শোনা কথা লিলিপুটকে বুঝতে সহায়তা করল।লিলিপুট কাউকে হ্যাঁ বলার প্রশ্নই আসেনা আবার কাউকে না বলার সাহসটা ও যে বিকল হয়ে গেছে।আবার এদিকে নেতার ছেলারা লিলিপুটকে দলে ভিড়াবে বলে টাকা খেয়ে চলেছে,লিলিপুটের অজান্তে।লিলিপুট জানেনা তাকে দিয়ে ব্যবসা হচ্ছে।কখনো চিন্তা ও করেনি সৃষ্টিকর্তার এই সৃষ্টি নিয়ে সবাই টানা টানি ,হলিখেলা,ব্যবসা করবে।
পরে একদিন কয়েকজন মিলে লিলিপুটকে নিয়ে যায়।লিলিপুটকে নানা টালবাহানা কথা বলে নয় ছয় দিয়ে বুঝিয়ে,টাকা দিবে বলে বলেছে আবার বলেছে বেশি কিছু করবেনা,এমনি তাদের সাথে থাকার জন্য…।।
আপনি না করবেন না!বস অনেক খুশি হবে।
পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠে আরে না লিলিপুট ভাই কিছু মনে করবে না।এতে তো লিলিপুট ভাই আনন্দ পাবে।আমার নিজের-ই তো করতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমাকে দিয়ে করলে তো আর সুন্দর দেখাবে না।পেছন থেকে একজন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে-‘মিয়া,এটাতে ভালোটাকা পাওয়া যায়।আজ এখানে কাল ওখানে।আপনি বলবেন আমাকে আরো বেশি টাকা দিতে হবে,অন্যরা আরো বেশি দেয়।।ইত্যাদি।মিয়া, ভালো ব্যবসা হবে চেম্বার খুইলা বসেন।’
আনোয়ার পরিস্থিতির শিকার,তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য।তার মুখে কোন শ্লোগান নেই।হাঁটার ইচ্ছে নেই বা শক্তি পাচ্ছেনা।কিন্তু তারপরও মনে হচ্ছে পেছেন থেকে তাকে ধাক্কা দেয়া হচ্ছে এবং সে বলেই তিনি হাঁটছেন।
//কেমন করে ছিড়ে গেল মায়ার বাঁধন আনোয়ার টের ও পেলনা।এমনটা করবে সে জীবনেও ভাবেনি,নিজের রক্ত কিভাবে নিজের সাথে বেঈমানী করে আনোয়ার সেটা বিশ্বাস করেনা,মানতে রাজি নয়।কিন্তু বাস্তবতা তাকে মেনে নিতে বাধ্য করেছে।সন্তান যেমনই হোক মা বাবার সন্তানের প্রতি একটা টান সবসময় থাকবে।আনোয়ার বুঝে উঠতে পারছেনা।আনোয়ার কোন সন্ত্রাসী নয়,বখাটে নয়।ভাই বোন কারো সাথে কোন প্রকার বিরোধ নেই।পারিবারিক সম্পদ নিয়েও কোন দিন কথা বলেনি।তাহলে কোন অপরাধে তাকে ফেলে যাওয়া হল।পারিবারিক বন্ধন থেকে ছিন্ন করে দিল।যখনি সময় পায় আনোয়ার এসব কথা বলে নিজে নিজে চোখের জল ঝরায়,স্বান্তনা খোঁজে চোখের জলে।তার প্রতিটি পদে পদে পরিবারের কারো না কারো কোন না কোন স্মৃতি তাকে নাড়া দেয়।তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও কখনো এক মুহুর্তের জন্য পরিবারের প্রতি বিন্দু পরিমান ঘৃনা তার জন্মায়নি।সব সময় তার মনে পরিবারের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিলো এবং এখনো আছে।
//আনোয়ার এখন এক অফিসের কেরানি।অনার্স পাস করে এই চাকরি করতে হচ্ছে।অফিসের বসেরাও তাকে লিলিপুট আনোয়ার বলে ডাকে।আনোয়ার কিছু মনে করে না/বলেনা।কারন বসের সাথে মিশে চলে দু,চার পয়সা পাওয়া যায়।তাই অফিসে লিলিপুট নামে সম্বোধন আনন্দের সাথে গ্রহন করে।শীত কালের খরস্রোতা নদীর মত চলছে আনোয়ারের জীবন।কোন ঢেউ নেই,স্রোত নেই,জোয়ার ভাটা নেই।সকাল হলেই অফিসে যাওয়া ,সন্ধ্যা পর্যন্ত লিলিপুট শব্দ কানে নেয়া আর টুকটাক কাজের মাঝে কাটিয়ে দিয়ে বাসায় ফেরা।যেদিন অফিসে বেশিবার লিলিপুট শুনে সেদিন একটু বেশি ক্লান্ত থাকা,বাসায় এসে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া।আর না হয় বেশির ভাগ দিনই বাসায় এসে ঘুমানোর আগে পরিবার আর নিজের কথা ভেবে একটু চোখের ব্যায়াম করে নেয়,দুষিত পানি দিয়ে চোখকে গোসল করায়,নিজেকে হালকা করে।অতপর আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়া।
আনোয়ার এখন একা,চিন্তা ভাবনাও তেমন নেই।কোন রকম শুয়ে বসে জীবন কাটিয়ে দেয়াই তার কাজ।ভবিষ্যত নিয়ে তার কোন পরিকল্পনা নেই।বলা চলে আনোয়ারের জীবন অনেকটা লিলিপুট জীবন আর ভাবনা ও লিলিপুট ধরনের।তবুও আনোয়ারের বেতনের অধিকাংশই জমা থাকে,একজনের খরচ আর কতই বা হয়।ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রকাশ না পেলেও অন্তর ঠিকই জ্বলে।কাউকে খুজে বেড়ায় মনের অগোচরে।যদি কখনো ভবিষ্যত হয় তাহলে হয়ত এ অর্থকড়ি কাজে লাগবে।তাই সে জমা রাখে।আর না হলে পড়ে থাকবে অন্তরালে।
একা একা থাকতে কত ভালো লাগে?মন চাইলেও মনের কথা শোনার মানুষ তো নেই, তাই মনের কষ্ট মনে জমা রেখেই নিজে নিজেই কথা বলে।ছুটির দিনে মন ভরে সময় নিয়ে চোখের ব্যায়াম চলে।অঝোর ধারায় স্রোত বইয়ে দেয় দু চোখের কোনে।নিজের শারিরিক গঠন আর পরিবারের অবহেলাই তাকে একান্নার জোগান দেয়।
সারাদিন কাজের মধ্য থাকার পর ও বাকি সময়টুকু যেন তার কাটতেই চায়না।সারাদিনের ক্লান্তি যেন কারো পরশের ছোয়ায় বিশ্রাম নিতে চায়।কর্ম ,চিন্তা আর ভাবনার মাঝে কত লুকিয়ে থাকা যায়?যৌবনের তীব্র বেগ যে অন্য দশ জনের মত তার শরীরে ও বইছে।কত আর থেমে রাখা যায়?মাঝে মাঝে যে মন চায় ব্রেক ফেল করতে।কিন্তু সেই অবস্থার সৃষ্টি কোন মতেই করতে পারেনা।অদ্ভুত কিছু খারাপ ভাবনা মনের মধ্যে উকি দিলেও নিজের সাহসকে প্রসারিত করার সুযোগ হয় না কিংবা সাহস হয় না।আবারও কোথায় যেন বাধা খেয়ে যায়।নিজেকে বড় মহত,জ্ঞানী মনে হয়।মনে হয় এটা কি করে সম্ভব?আমি কেন এমন করবো?সৃষ্টিকর্তা আমাকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন,আমার জীবনের ছক তিনি নিশ্চয়ই সাজিয়ে রেখেছেন।দিন যায় রাত যায়।প্রকৃতি তার নিয়মেই চলতে থাকে।লিলিপুটের মনের দুয়ার কেউ খুলতে আসে না।কেউ লিলিপুটকে বুঝতে চায় না।লিলিপুট যেন নিজের মধ্যেই জীবন্ত মৃত।বেঁচে থেকেও জীবনের স্বাদ পাচ্ছেন না।
লিলিপুট আজ নিজের বাড়ি থেকে অনেক দুরে।গ্রাম থেকে দূর বহুদুর চলে গেছে।অচেনা এই এলাকায় ছোট্ট একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকছে,আর একটি অফিসে চাকুরি করছে।ছোট কেরানির চাকুরি,শুধু মাত্র একজন বলে বেতন যা পান ভালোভাবেই চলে।এমনকি কিছু জমানো ও যায়।এলাকার মানুষের মত এখানকার মানুষেরা সারাক্ষন ব্যঙ্গ,রঙ্গ তামাশা না করলেও ইদানীং তাদের চাহনীতে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।দেখলেই কেমন যেন বাকা হাসি দিয়ে চেয়ে থাকে।আর ফিসফিসিয়ে একে অপরকে কী যেন বলে।নিজে সংবরন করতে চেষ্টা করলেও কিভাবে যেন লজ্জা চলে আসে, টের পায়না লিলিপুট।মাথা নিচু করে মাটিতে তাকিয়ে রাস্তা পার হতে হয়।তবু সে অনেকটা স্বস্তিতে,অচেনা মানুষ,চেয়ে চেয়ে হাসে,ওদের মত দেখলেই ব্যঙ্গ করে না।