ইন্টারভিউ উইথ হিস্ট্রি-ওরিয়ানা ফালাচি রচিত একটি বহুল পঠিত বই। বইটি আমাদের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে আছে এ জাতির মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকারও। পাশাপাশি এতে স্থান পেয়েছে ফিলিস্তিনি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতের সাক্ষাৎকার। আছে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর চালানো ইসরাইলী গণহত্যার অন্যতম নায়ক ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামায়ারের সাক্ষাৎকার, আছে ইন্দিরা গান্ধী, জুলফিকার আলী ভুট্টো, কিসিঞ্জার সহ আরো অনেক নামী দামী নেতার সাক্ষাৎকার। বইটির বাংলা অনুবাদ আমার হাতে এসেছে আনোয়ার হোসাইন মঞ্জু’র করা। যিনি একসময় ঢাকা ডাইজেস্ট পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
ব্লগে অনেকদিন ধরেই চলেছে মুজিবের এই সাক্ষাৎকার নিয়ে আলোচনা সমালোচনা। যারা মুজিবের সাক্ষাৎকারটাকে গুরুত্ব দিয়ে তাকে হেয় করার ফালাচির কৌশলের কাছে মাথানত করেছেন তারা হয়তো জানেন না যে এই ফালাচি সিআইয়ের একজনএজেন্ট ছিলেন। এবং শেষ জীবনে নিজ দেশ ত্যাগ করে আমেরিকায় স্থায়ী হয়েছিলেন। এমনকি আমেরিকার প্রশংসা করতে গিয়ে নিজ দেশ ইটালীকে গালাগালি পর্যন্ত করতে পিছপা হননি।
ফালাচি দেখাতে চেয়েছেন, শুধু মুজিব নয়, গোটা বাঙালী জাতিটাই কতটা বর্বর এবং রক্তপিপাসু ,খুনে, জল্লাদ! ফলে এদেশীয় কিছু জ্ঞানপাপী বইটা লুফে নিল। অনুবাদ হলো, ব্যাপক প্রসারের ব্যবস্থা হল। তাদের অধিকাংশই পুরো বইটা পড়লোনা। পড়ল শুধু একটা সাক্ষাৎকার। শেখ মুজিব এবং মুক্তিবাহিনী হয়ে গেলো গাদ্দার আর ফালাচী হলেন জাতীয় মুক্তির মহানায়ক! এমনকি তার এই বইয়ের রেফারেন্স দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ থেকে বলা হল মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধাপরাধ করেছে তাদেরও বিচার হতে হবে।
ফালাচির বই নিয়ে মুজিবের চরিত্রে কলংক লেপনের চেষ্টা বেশ জোরেশোরেই ব্লগগুলোতে চোখে পড়ছিল। ভাবছিলাম একটা পোস্ট দিব। কিন্তু সময় করে উঠতে পারছিলামনা। দু-একটা মন্তব্য শুধু করছিলাম। (Click This Link)
ফালাচীর বইটা পড়ে তাকে আমার কাছে একজন মুসলিম বিদ্বেষী ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। কারণ তিনি গোল্ডামায়ারের মত একজন গণহত্যার নায়ককে বানিয়েছেন (তার সাক্ষাৎকারে) মমতাময়ী মা হিসেবে। আর আরাফাতকে বানিয়েছেন সন্ত্রাসী হিসেবে। এমনকি ভুটো আর ইন্দিরার আলোচনায়ও ইন্দিরাকে যেমন মহীয়সী হিসেবে দেখিয়েছেন তেমনি ভুট্টোকে দেখিয়েছেন খল, দাম্ভিক হিসেবে। তার সাক্ষাৎকারে যে ক’জন মুসলিমকে নিয়ে এসেছেন আপনি যদি বইটা পড়ে থাকেন তাহলে বুঝবেন কতটা বিকৃত ভাবে তাদের উপস্থাপনের চেষ্টা তিনি করেছেন। এ প্রসঙ্গে তার নিজের কথাই প্রণিধানযোগ্য: প্রতিটি সাক্ষাৎকারই আমার নিজের আঁকা ছবি। আমি যদি তোমার চিত্রকর হতাম এবং তোমার ছবি আঁকতাম, তবে সে সময় আমি তোমাকে যেভাবে আঁকতে চাইতাম সেভাবে আঁকার অধিকার কি আমার থাকতো না ?' http://www.sachalayatan.com/barnadut/20142
তার সম্পর্কে একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম বণর্বাদের দোষে তিনি নিজ দেশেই নিন্দিত। বলাবাহুল্য, তার এই বর্ণবাদ শুধু মুসলিমদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি তার আরেকটা বই আমার হাতে এসেছে (অনুবাদ) যেটার কিছু নমুনা দেখলেই বোঝা যাবে সে কতটা মুসলিম বিদ্বেষী। পাশাপাশি এটাও বলতে চাই তার মুসলিমবিদ্বেষ যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক আমি কিন্তু সে প্রসঙ্গে এখানে কিছু বলবনা।
১.আমি নির্দ্বিধায় বলতে চাই, সন্ত্রাসবাদের আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শনের দায়িত্বে আছেন অসংখ্য ইমাম। ফলে, নীতিগতভাবে তারাও সন্ত্রাসবাদীই।
২. আমি সরাসরি বলতে চাই, আমাদের সংস্কৃতিতে মুয়াজ্জিন, মিনার, সংযম নিয়ে মিথ্যে গলাবাজী, অপমানসূচক চাদর, অবমাননাকর বোরখার কোনো স্থান নেই। আর কোন স্থান থাকার প্রয়োজন যদি দেখা দেয়, তা-ও আমি দেবোনা। (এখানে বলা দরকার, তিনি অনেক আগে থেকেই ইতালিতে মুসলিম অভিবাসনের বিরুদ্ধে, এবং তিনি চান পুরো ইউরোপ থেকে মুসলিমদের সমূলে উচ্ছেদ।)তার মতে মুসলমানরা হল-সন্ত্রাসী, চোর, ধর্ষণকারী, অভিযুক্ত আসামী, দেহজীবী, ভিক্ষুক, মাদক পাচারকারী, ছোঁযাচে রোগে আক্রান্ত।
৩. .....এই সেই পাহাড় (পাহাড় বলতে বুঝিয়েছেন ইসলাম ধর্মকে), যা বিগত চৌদ্দশত বছর ধরে নড়েনি, অন্ধত্বের চূড়া থেকে যে একবিন্দুও ওঠেনি, সভ্যতার সন্ধানে যে তার দরজা খুলে দেয়নি, স্বাধীনতা-গণতন্ত্র-প্রগতির কথা যে কখনো জানতে চায়নি। এক কথায় যে আজ অবধি পাল্টায়নি।পশ্চাৎমুখী প্রভুদের (রাজা-রাজপুত্র-শেখ-ব্যাংকার) লজ্জাহীন ধনদৌলতের পরও পাহাড়টি আজো বেঁচে আছে এক লজ্জাজনক দারিদ্র্যর মধ্যে, বেড়ে উঠছে এমন এক ধর্মের দানবিক অন্ধকারের মধ্য দিয়ে যে কেবল ধর্মই উৎপাদন করতে পারে। পাহাড়টি ক্রমশই নেমে যাচ্ছে অশিক্ষার দিকে (ভুলে গেলে চলবেনা যে, প্রায় প্রতিটি মুসলিম প্রধান দেশেই অশিক্ষার হার ষাট শতাংশের বেশি)। এই সে পাহাড় যে তথ্যের জন্য ভরসা করে পশ্চাৎপদ ইমামদের উপর অথবা কার্টুনের উপর। এই সে পাহাড় যে গোপনে আমাদের হিংসা করে, স্বীকার না করলেও আমাদের জীবন যাত্রায় ঈর্ষাকাতর। আবার নিজেদের জাগতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যদশার জন্য আমাদের দায়ী করে।
৪. ‘মুর্খ কোথাকার!’ সম্বোধনে ইয়াসির আরাফাত প্রসঙ্গে বলেন, এই মিথ্যেবাদী লোকটি কেবলমাত্র ইসরাইলের অস্তিত্ব অস্বীকার করার সময় (গোপনে) খুব নিষ্ঠার পরিচয় দেন। এমনকি এই ভন্ড লোকটাকে সময় জিজ্ঞেস করবার সময়ও বিশ্বাস করা যায় না। এই আপাত বিপ্লবী লোকটা তার নিজের দেশের মানুষের জন্য ন্যূনতম গণতন্ত্রও নিশ্চিত করেনা।
৫.মক্কার দন্ডায়মান তাঁবুতে আমি কখনো যাইনা। নবীর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি প্রার্থনা বাক্য বা দোয়া পড়তে যাই না। আমি তাদের মসজিদের গায়ে মূত্রপাত করিনা। কখনো, মলত্যাগও করিনি।(- এখানে কি তার ইসলামের প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হয়েছে ? নাকি ততধিক অবজ্ঞা ?)
এরকম আরো অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে যেখানে তিনি মুসলিম জাতির প্রতি তার ক্ষোভ উদগীরণ করেছেন। বইটি বাংলায় প্রকাশ করেছে সন্দেশ। প্রকাশকের একটি কথা প্রণিধানযোগ্য- ফালাচি একসময়ে বামপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর পর গত দেড় দশকে ইউরোপীয় বামপন্থীদের অনেকেই তাদের সুর বদলে ফেলেছেন। তারা কেউ কেউ আমেরিকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভেতর নতুন সময় ও নতুন সহস্রাব্দের যথাযথ প্রতিশ্রুতি খুঁজে পেয়েছেন। এই সব বামপন্থীদের বিভ্রান্তির এক করুণ উদাহরণ ওরিয়ানা ফালাচি। আমাদের দেশে একসময় অনেকেই ফালাচি ও তার সতীর্থ বামপন্থীদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন। এই বই সে বিভ্রান্তি দূর করবে, গ্রন্থটি প্রকাশের পেছনে আমাদের এই বিবেচনাও কাজ করেছে।
তো ফালাচির সব কথাই কি মিথ্যা ? নিশ্চয়ই কিছু কিছু সত্য আছে। এই যুক্তি দিয়ে মুজিব বিরোধীরা বলতে পারেন যে, মুজিবের বিরুদ্ধে যে কথাগুলো বলেছেন তা সব সত্য। আর ইসলাম সম্পর্কে যা বলেছেন তার সবই মিথ্যা। খুব ভাল কথা। একই যুক্তি দিয়ে আমি যদি বলি ইসলাম সম্পর্কে যা বলেছে সব সত্য আর মুজিব সম্পর্কে যা বলেছে সব মিথ্যা। মানবেন আমার কথা ?
এবার আমি কুরআনের একটি আয়াতের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব- হে মুমিনগণ, যদি কোন ফাসেক ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন খবর নিয়ে আসে তবে তা যাচাই না করে তোমরা এমন কোন কাজ কোরোনা যাতে করে তোমাদের পরবর্তিতে পস্তাতে হয়। (সুরা হুজরাত, আয়াত-৬)
আর কিছু বলার নেই আমার। আমার এই পোস্টের কল্যাণে যদি কোন ছাগুগোত্রীয় আমাকে আওয়ামী দালাল বলে মনে করেন তাদেরকে বলব আমার আগের ব্লগগুলো পড়লে আপনি বুঝবেন আমি কে ?
ওরিয়ানা ফালাচি বলেছেন মুজিব খুব খারাপ লোক ছিল অতএব সে খারাপ!!!
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
গরমান্ত দুপুরের আলাপ
মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন
রাজীব নূর কোথায়?
আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন
=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=
©কাজী ফাতেমা ছবি
মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।
হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।
ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন
মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে
ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন