আমাদের সমাজে লোকজন যখন বিয়ে শব্দটি উচ্চারণ করে তখন তিনটি শব্দ পাশাপাশি উচ্চারণ করে। এই শব্দ গুলোহচ্ছে জন্ম,মৃত্যু ও বিয়ে।এবং এই বিয়ে শব্দটি যখন একক ভাবে উচ্চারিত হয় তখন এর পূর্বে শুভ বিশেষণটি সব সময় লাগানো থাকে।কাজ হিসেবে এটিকে সবসময় শুভ মনে করা হয়।যখন কারও মুখ থেকে শুনতে পাই শুভ কাজ তখন মনে করতে হবে বিয়ের কথা বলা হচ্ছে।তারমানে আমাদের সমাজে এটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র কাজ মনে করা হয়।মানব সমাজে সাধারণত দুই ধরণের বিবাহ প্রচলিত আছে।এক;আরোপিত বিয়ে দুই; প্রেমের বিয়ে।বাংলাদেশের অধিকাংশ বিয়েই হল আরোপিত বিয়ে ,শুধুমাত্র শহর অঞ্চলে দুই একটি প্রেমের বিয়ে হতে দেখা যায়।আরোপিত বিয়ে সাধারণত সংগঠিত হয় ঘটকের মধ্যস্থতায়।প্রথমেই শুরু হয় দেখাশুনা বা জানাশুনার পর্ব।বর পক্ষ দেখে মেয়েটির রুপ যৌবন,মেয়েটির গায়ের রঙ সাদা না কালো,সমাজে চলার মত বা কাজ চালানোর মত শিক্ষিত কিনা,পূর্বে মেয়েটির কোন প্রেমিক ছিল কিনা বা বর্তমানে আছে কিনা,বরপক্ষকে যৌতুক দেওয়ার মত টাকা পয়সা কনের পিতার আছে কিনা,ঘরকান্না, রান্নাবান্না ও সংসার সামলানোর কাজ কতটুকু পারে ইত্যাদি।কনে পক্ষ দেখে ছেলেটি কত টুকু শিক্ষিত,কত টাকা বেতনের চাকুরি করে ,চাকুরিটি সরকারী কিনা, ছেলের ফ্যামিলি স্ট্যাটাস কেমন ইত্যাদি।ছেলেটি দেখতে সুন্দর কি অসুন্দর সেটা তেমন বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না।দেখা দেখি এবং জানাশুনার পর্ব শেষ হলে শুরু হয় দেনা পাওনার পর্ব।কনের বাবা কত টাকা যৌতুক হিসেবে বর পক্ষকে দিতে পারবে এর উপর মূলত নির্ভর করে বিয়েটি হবে কিনা ।মেয়েটির গায়ের রঙ কা্লো হলে যৌতুকের পরিমান বেশী হবে এবং সাদা হলে যৌতুকের পরিমান কম হবে। বর্তমানে কিছু প্রচার প্র্চারনার ফলে যৌতুক শব্দটি নেতিবাচক হয়ে যাওয়ার দরুণ ভাষার সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী শহুরে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজে এটি একটি নতুন সুভাষণ ধারণ করেছে।এখন এটিকে যৌতুক না বলে উপহার হিসেবে অভিহিত করা হয়।শব্দটি পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে অর্থেরও কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।যৌতুক হিসেবে দেওয়া হয় নগদ টাকা এবং উপহার হিসেবে দেওয়া হয় বিভিন্ন ধরনের দ্রব্য সামগ্রী সেটি অবশ্য নগদ টাকা দিয়েই কিনতে হয়।এই যৌতুক বা উপহারের বিষয়টি অনেক দরকষাকষির পর নিষ্পত্তি হয়ে গেলে বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হয়।সুনির্দিষ্ট তারিখে বরপক্ষ বিশাল এক জনবহর নিয়ে কনের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হয়।কনের বাড়ি পৌছার সাথে সাথেই বরপক্ষকে যেটির সম্মুখীন হতে হয় সেটি হল বিয়ের গেট।এই গেট পূর্বে কলা গাছের সাহায্যে তৈরী করা হত এখন ডেকারেশনের লোকজন এসে তৈরী করে দিয়ে যায়।গেটের পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শাড়ীর পরা সুন্দরী মেয়েরা । মেয়েদের চেহারা, সাজ পোশাক ও গেট দেখতে যত বেশী সুন্দর হবে তারা তত বেশী টাকা আদায় করে নিতে পারবে বর পক্ষের নিকট থেকে । গেটের পাশে দাঁড়ানো মেয়েদের সাথে এবং বরের বন্ধুদের সাথে শুরু হয়ে যায় দর কষা কষি এবং আদিরসাত্বক চুটকি বিনিময় । এই চুটকি বিনিময় পর্ব শেষ হলে শুরু হবে খাওয়া দাওয়ার পর্ব । বর এবং বরের বন্ধুদের জন্য করা হবে আলাদা ব্যবস্থা, সব চেয়ে ভাল ভাল খাবার গুলো কে ওখানে এনে জড়ো করা হবে এবং শুরু হয়ে যাবে হাত ধোয়ানোর পর্ব । ঐ সুন্দরী ও সুন্দর সাজ পোশাকে সজ্জিত মেয়েগুলো সার বেধে চলে আসে হাত ধোয়ানোর জন্য । ওরা যেন অবুঝ বালক , সুন্দরী মেয়েরা এদের হাত ধুয়ে না দিলে ওরা খেতে পারবেনা।
হাত ধোয়ার পর্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথে ঐ অবুঝ বালক গুলো পরিনত হতে থাকে একেক জন বড় বড় পেটুকে।তারা একই সাথে খেতে ও নষ্ট করতে থাকে আস্ত আস্ত মুরগীর রোস্ট ,খাসীর মাংশের রেজালা,গ্লাশ গ্লাশ বোরহানি,প্লেট প্লেট পোলাও,মুঠ মুঠ সালাদ,হাড়ি হাড়ি দই মিষ্টি এবং বোতল বোতল ঠান্ডা পানীয়।খাদ্যের ভারে তারা ন্যাতিয়ে পড়ে,মেয়েদের সাথে আদিরসাত্বক আলোচনার জন্য এতটুকু বলও আর অবশিষ্ট থাকেনা।গুরুজনদের একটু কম করেই খেতে হয় কারন তারা জানে একটু পরেই বসতে হবে একটি গুরুত্বপূর্ন হিসাব কষতে।খাওয়ার পরেই উঠোনের মাঝখানে পাটি বিছিয়ে,হ্যাজাকের বা বৈদ্যুতিক আলোতে শুরু হয়ে যাবে হিসাবের কাজ।বর পক্ষের মুরুব্বিগন নাকের ডগায় হাই পাওয়ারের চশমা লাগিয়ে,মুখটি চাল কুমড়ার মত গম্ভীড় বানিয়ে পাই পাই করে বুঝে নিতে থাকে হিসাবটি। সোনার গহনা কতটুকু খাটি এটি বুঝার জন্য থাকে পাকা পাকা জহুরী এবং টাকার বান্ডিলের কড়কড়ে নোটগুলো আঙ্গুলে থুতু লাগিয়ে গুনতে থাকে।একটি নোট কম পড়লেই তারা বরকে সাথে নিয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে চলে আসবে।নির্মম দরকষাকষিটি নিষ্ঠুরভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর শুভ কাজটি শুরু হয়।এই অতীব পবিত্র কাজটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে মেয়েটির বেনারশী শাড়ীর আচল বরের পাঞ্জাবীর কোনার সাথে বেধে দেওয়া হয়।চঞ্চল, অস্থিরমতি,দস্যি মেয়েটি যে এখনো কুড়িতেই রয়ে গেছে ফুটেই উঠেনি সেই মেয়েটিকে মত সারা জীবন ধরে ঘুরতে থাকবে নর্দমার পাকে।মেয়েটির বাড়ীতে শুরু যায় কান্নার রোল,আর মেয়েটিকে কোরবানীর পশুর মত টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় যুপকাষ্ঠেরদিকে। মেয়েটিও কাদতে থাকে অঝোর ধারায়, কোরবানির পশু যেমন কাদতে থাকে জবাই করার পূর্বে।১৬ বা ১৭ বছরের কিশোরী মেয়েটি ভালো করেই বুঝতে পারে আজকে তার এই ফুল শয্যার রাতে তাকে ধর্ষিত হতে হবে এক বার দুইবার ,সারা রাত ধরে।যোনির রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে যাবে বিছানার চাদর তোষক এবং গোলাপের লাল পাপড়ি গুলো আরো টকটকে হয়ে উঠবে।মেয়েটির করুন আর্ত চিৎকার শুনে সমাজের লোকজন বরটির কাজের বাহবা দিতে থাকবে এবং বলতে থাকবে বাঘের বাচ্চা।হা বাঘের বাচ্চাইতো,যে জন্তুটি একটি নিরীহ প্রাণীকে একা পেয়ে তার নখ দন্ত দিয়ে কামড়ে রক্তাক্ত করে হাড় মাংশ চিবিয়ে পুরোপুরি খেয়ে ফেলতে পারে সে বাঘের বাচ্চা নয়তো কি গাধার বাচ্চা।প্রায় সব মেয়েই সারা জীবনের জন্য এই গাধার বাচ্চাদের দুঃখিত এই বাঘের বাচ্চাদের ছাগল রুপী আহারে পরিণত হয়।শুধু তাই নয় সম্পূর্ণ ভাবে লুপ্ত হয় এদের পরিচয়,এদের অস্তিত্ব।নিজ দেহের এবং মনের স্বত্তাধিকার টুকু এরা সম্পূর্ণ রূপে হারিয়ে ফেলে।থাকার মধ্যে থাকে কান্নাটুকু আর চোখের জল।এরা পরিচিত হতে থাকে অমুকের বউ,অমুকের ভাবী,অমুকের মা ইত্যাদি বিশেষনে।এদের নিজদের থাকেনা কোন স্বপ্ন,আশা, ভালবাসা।সে স্বপ্ন দেখে তার সন্তানদের ঘিরে।স্বপ্ন দেখে সে বীর মাতা হবে, কোন কোন সময় হয়ত তার স্বপ্ন পূরণ হয় কিন্তু সে কোন দিন তার দাসীর স্তর ভেদ করে উপরে উঠতে পারেনা।আমাকে যদি বলা হয় তুমি আর কোন স্বপ্ন দেখতে পারবেনা,তোমার কোন আশা থাকতে পারবেনা ,তুমি আর কোন নারীর প্রেমে পড়ত পারবেনা, তাহলে আমি সমস্ত সমাজ সংসারকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে নিজে ভস্মীভূত হয়ে যাব।অথচ তারা দিনের পর দিন রাত্রির পর রাত্রি স্বপ্ন হীন আশা হীন ভালবাসা হীন জীবন যাপন করে চলেছে।যে অমোঘ শক্তির কারনে তারা এমন জীবন যাপন করে চলছে সেই শক্তির সাহায্যে কি তারা এই পচে গলে যাওয়া সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ,(যে প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তারা অত্যাচারিত,শোষিত ,বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত)উপড়ে ফেলতে পারেনা? ভালোবাসা, প্রেম, প্রণয় একান্তই দুজন মানব মানবীর আবেগীয় এবং ব্যাক্তিগত বিষয়।কে কার সাথে এই প্রনয় সম্পর্কে জড়াবে এবং কতদিন এই সম্পর্কটি টিকে থাকবে এটা নির্ভর করবে তাদের ভাললাগা ,মন্দ লাগা এবং তাদের মনমানসিকতার উপর।বর্তমান আধুনিক সমাজে যেহেতু প্রত্যেকটি নরনারী তদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় গুলোতে পুরোমাত্রায় সচেতন সেহেতু বিয়ে নামক একটি চুক্তির মাধ্যমে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রও কতৃক দর কষাকষির মাধ্যমে ও জোর করে চাপিয়ে দেয়া প্রণয় সম্পর্ক কখনই সমাজের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পারেনা।এবং এই বিয়ে এমন একটি প্রণয় সম্পর্কের চুক্তি যেখানে মানব মানবীকে দাসখত দিতে হয় পরিবারের নিকট সমাজের নিকট ও রাষ্টের নিকট।রাজনৈতিক চুক্তিতে যে সমস্ত উ্পাদান উপস্থিত থাকে বিয়ে নামক এই প্রনয় সম্পরকের চুক্তিতেও ঐ উপাদান গুলোর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।নতুন আলোর আহ্বানে সময় এসেছে মানব মানবীর প্রণয় সম্পর্ককে সকল ধরনের অর্থনৈতিক দর কষাকষির ও রাজনৈতিক চুক্তির সকল ধরনের উপাদান থেকে মুক্ত করে তার নিজস্ব ভালবাসা ,প্রেম ,মায়া মমতার পথ ধরে হাটতে দেয়া।মানব মানবীর এই প্রণয় সম্পর্ক এই পথ ধরে হাটতে থাকলেই তারা পরস্পরকে বন্ধু মনে করতে পারবে ,জীবন যুদ্ধের সহযোদ্ধা মনে করতে পারবে একে অপরের অনুভূতি বুঝতে পারবে,ঘারে বাইরে দুজনে সমান তালে তাদের কাজ করে যেতে পারবে।এখনকার মত একজন আরেকজনকে দাস ও প্রভু মনে করবেনা কারন হৃদয় থেকে উৎসারিত ভালবাসায় কখনো দাস প্রভু সম্পর্ক থাকতে পারেনা।একমাত্র অবারিত ভালবাসাই পারে নর নারীকে কাধে কাধ রেখে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাতে।বিয়ে নামক চুক্তিটি কেবল পারে মানব মানবীর সম্পর্ককে আরো বেশী বৈষম্যমূলক করতে এবং সমাজকে আরও পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে।