somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিকনিক

২০ শে নভেম্বর, ২০১১ রাত ১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ধসে পড়া দেয়ালের যেটুকু বাকি, সেটাই স্মরণ করিয়ে দেয় তার প্রাচীনতার রূপ। দাঁত বের করা ইটের ফাঁকে ফাঁকে লোনাধরা কারুকাজ; কী সৌকর্য, কী ভীষণ সৌন্দর্য! সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। হঠাৎ পেছন ফিরে দেখি দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে স্বপ্না, হাসছে। বলল, 'দেখ তো কেমন লাগছে?'
অবাক হয়ে ওকে দেখলাম।
'কী! কী হলো?'
আমি তবুও নির্বাক, ও আরো একচোট হেসে নিল। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে হাতের ক্যামেরাটি তুলে ধরলাম। একটি ফাশ, একটি ছবি।

ভাঙা রাজবাড়ির ভেতর, সরু একটা সিড়ি উঠে গেছে, খাঁজগুলো সব ভাঙা, দেয়ালের ইট-সুরকিতে খাড়া ঢালের সৃষ্টি হয়েছে। হাত বাড়িয়ে স্বপ্নাকে টেনে তুলতে হলো। পেছনে রীনা, কেমন বিষন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বললাম, 'কি রে, আয়।'
অসম্মতি জানালো। দৃষ্টি যেন আর একটু ঘোলা। আমি সরে এসে রেজাকে বললাম, 'দেখো তো।'
রেজা ওকে উপরে তুললো।

রাজবাড়ির সমস্ত অবয়ব কালের আবর্তে ধসে গেছে। মাত্র কয়েকটি দেয়াল যাই যাই অবস্থায় টিকে আছে, কোনো রাণীমার ষ্পর্শের অপেক্ষায় অভিমানী বৃদ্ধা যেন। বটবৃক্ষ জন্মেছে এ ধ্বংসাবশেষের ওপর। আরিফ আগেই উঠে এসেছে, বটের ছায়ায় ওকে দেখা গেল। আমরাও এগিয়ে গেলাম ওর দিকে, চওড়া দেয়ালের উপর দিয়ে। রেজা ছবি তুলছে-ধ্বংসাবশেষ, দেয়াল আর আমাদের।

একটা সরু দেয়াল, হয়তো কখনো চওড়া ছিল, স্বপ্নার হাত ছুঁলাম, ও আমাকে আরো আঁকড়ে ধরলো। দেয়াল পার হয়ে এলাম তারপর বটবৃক্ষের ছায়া। দেয়াল জড়িয়ে উঠেছে কোন একদিনের ঘুমন্ত বীজ, অঙ্কুরিত হয়ে আজ ছড়িয়ে দিয়েছে তার বাহু, ধীরে ধীরে ছোট চারাগাছ থেকে হয়ে উঠেছে এই বৃক্ষ, ইটের ফাঁক গলে আষ্টেপৃষ্ঠে ছড়িয়েছে মূল।

স্বাপ্না আমাকে ডাকলো, 'আয় একটা ছবি তুলি।'
ওর ডাক কেন যে উপেক্ষা করতে পারি না। ও আমার বাম বাহুর ছোঁয়ায়, হাত দিয়ে চুল সরালো; চুলগুলো এলিয়ে গেল আমার কাঁধে। আমার কেন যেন ভীষণ ভালো লাগছে। কেন এমন লাগছে? আরো একটু চেপে এলো ও। আহ! আমার সমস্ত কোষ, সমস্ত শিরা-উপশিরায় যেন ঢেউ খেলে গেল...।
রীনার চোখে সানগ্লাস। ও কি এদিকেই তাকিয়ে আছে? বোঝা যাচ্ছে না। ভেতরে অস্বস্তি বোধ করলাম। ডাকলাম ওকে, 'আয়।'
এবার রীনার সঙ্গে, আবার ফাশ, আরও একটি ছবি।

রেজা ডাকছে, 'সূর্য ভাই!'
দেখলাম সুমনকে নিয়ে আরেক দেয়ালে উঠে দাঁড়িয়েছে ও। সুমন বলল, 'একটা ছবি তুলে দিন।'
আমার হাতে ক্যামেরা, রোদ এড়িয়ে চমৎকার একটা কোজআপ এলো। ওরা দেয়ালে দেয়ালে দৌড়াদৌড়ি করছিল, সাবধান করতে হলো। দেয়াল টপকে সরে এলাম স্বপ্নার কাছে, আরিফের সঙ্গে গল্প করছিল ও, কিসের গল্প? কেন যেন ঈর্ষা বোধ করলাম। ওখান থেকে ওকে সরিয়ে আনতে মনের তাড়না অনুভব করলাম। কিন্তু এটা কি ঠিক হবে? তবুও ডাকলাম, 'এদিকে আয়, তোর একটা ছবি তুলি।'
'কোথায়?'
'আহ, আয় না!' মনের মাঝে কেন যেন শঙ্কা, ধরা পড়ার ভয়। সিড়ি আর ভাঙা দেয়ালের পাশে দাঁড় করালাম ওকে, 'এখানে? ভালো আসবে তো?'
'আসবে। তুই দাঁড়া।'
আমি নিজেও জানি না কেমন হলো লোকেশানটা। তবুও তো সরিয়ে আনা। মনে ভয় ভয়, স্বপ্নাকে কি হারাবো? না কখনই না। কিন্তু সেই কথাটা তো আজও বলা হলো না। হবে কি? আরিফ বলল, 'দোস্ত, বোর লাগছে, চল যাই। খাবার হলো কি না দেখি।'
'ঠিক আছে চল।'
স্বপ্না বলল, 'চল আমারও ভাল লাগছে না।'
আরিফের দিকে তাকালাম, কেন ও বোর ফিল করছে? এর কোন রহস্য আছে কি?
রেজা বলল, 'সূর্য ভাই, তিনটা বাজে, ক্ষিদে পেয়েছে।'
'হ্যা চলো '।
সিড়িটা ওপর থেকে বেশি ঢালু মনে হচ্ছে। স্বপ্নার হাতের স্পর্শের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু ও একাই নামলো কোন সাহায্য ছাড়াই। রীনার চোখে সানগ্লাসম, ওকে বুঝতে পারছি না। কী ভাবছে ও, নিশ্চুপ। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্না ডাকলো, 'এই সূর্য।'
'হ্যা।'
'আয় ভ্যানে উঠব, সামনে একটা রিকশা-ভ্যান দেখছি'।
'দাঁড়া আসছি।' নিচে নেমে এলাম।

স্থানীয় ভাষায় হেলিকাপ্টার, আমরা চড়ে বসলাম, রেজা গেয়ে উঠল, 'আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে...।'
এর সাথে সাথি হলো আমাদের সকলের কণ্ঠ।
রামসাগর দীঘির চারপাশে আঁকাবাঁকা রাস্তা। তার ওপর দিয়ে রিকশা ভ্যানে করে আমাদের কোরাস দল এগিয়ে চলল। মাথা উঁচু দেবদারু খাঁটি সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে মাঝে বাতাসে হেলেদুলে উঠছে, যেন আমাদের কোরাসে তাল মেলাচ্ছে। বাবলা গাছ, মহুয়ার বন আর হঠাৎ মাথা তুলে থাকা কিছু পিকনিক শেড।

আধো ডুবন্ত একটি সিঁড়ি। স্বপ্না হঠাৎ দৌড়ে গেল। বলল, 'পানিতে নামব'। ওর দেখাদেখি সবাই ছুটে গেলাম পানি ছুঁয়ে দেখতে। জল ছোঁড়াছুঁড়ি করে এক অদ্ভুত আনন্দ বয়ে যাচ্ছিল আমাদের মধ্যে। পিচ্ছিল সিঁড়িতে হাঁটু পানিতে নামলাম। দূরে ওই পাড়ে ছোট ছোট টিলার ফাঁকে আমাদের সাদা গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। গাড়ির পাশে একটা ঢিবির ওপর একটা সুন্দর গাছের নিচে বসলাম। বিদেশী গাছ, অনেকটা দেবদারুর মতোই, কিন্তু কচি পাতাগুলো লাল লাল। আমরা কেউ গাছটা চিনি না।

স্বপ্না কেশবিন্যাস করছিল। আমি তাকিয়ে আছি ওর দিকে। এই মেয়েটি কি জানে, আমি তাকে কত ভালবাসি! মেয়েরা নাকি অনেক কিছু আগেই বুঝতে পারে, ও কি পারে? হয়তোবা। স্বপ্না আমার দিকে ফিরে তাকাল।
'কীরে! কি দেখিস?'
'তোকে।'
'আমাকে?' এক চিমটি হাসি ওর মুখে।
'হ্যাঁ।' উপর নিচে মাথা দোলালাম।

সময়ের ফর্দ বাঁধা ছিল। খাদ্য গ্রহণের সময় বেশ বড় একটা প্রাণী হালুম করে দিলাম সকলে মিলে। দানবের কথা রূপকথার গল্পে শুনেছি, কিন্তু মানবের দাঁত খিঁচিয়ে মাংশ ছেঁড়া দেখতে কিন্তু খারাপ লাগে না। পেটের জন্য ভোজটা আরামপ্রদ। আর্দ্র আবহাওয়া, উত্তরের বাতাস, মেঘগুলো ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্রামের পরিসর ছিল সামান্য। তবু নিকোটিন প্রত্যাশী হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। রীনা সঙ্গী হলো।

ছোট্ট একটা টিলা, তিনটি খেজুর গাছ, বাতাসে তাদের বহুগুলো নাড়িয়ে গল্প করছে যেন। একটি চালতা গাছ, লম্বা হয়ে ছায়া ফেলেছে ওদের পায়ের কাছে। বসলাম পাশাপাশি, রীনা নিশ্চুপ। মনের ভেতর তোলপাড়, কী বলবে ও? মনের অনুভুতি আমি নিজেই ধরতে পারছি না। একটু ভয় ভয়, একটু যেন কৌতুহল আমাকে দোলা দিচ্ছে।

'আমার চিঠিগুলো দিয়ে দিবি।' হঠাৎই আক্রমণ এবং যথাযথ ভাবেই।
'আমাকে বিশ্বাস করিস না?' আমি বলি।
'না।'
আমি নিশ্চুপ রইলাম। একটি বর্ণে একটি শব্দ, ধরাশায়ী করলো যেন। এতটাই ক্ষোভ ওর মনে! আমি অবাক হলাম।
'কি, দিবি না?' তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসা রীনার।
'যদি না দেই?'
কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না, মুহুর্তে শার্টের কলার খামচে ধরলো ও। বলল, 'আমি তোকে ঘৃণা করি সূর্য, প্রচন্ড ঘৃণা করি। আই হেট ইউ। আমি তোকে চিনে ফেলেছি।'
হঠাৎ উঠে চলে গেল ও। আমি তাকিয়ে রইলাম শুধু। বাতাসে খেজুর পাতা ঝিরঝির শব্দ তুলছে...। আমি উদাস তাকাই, রীনা চলে যাচ্ছে, ঐতো দূরে নড়ে উঠলো স্বপ্না।
আমার চোখে স্বপ্নার হাতছানি ডাক, স্পর্শের তৃষ্ণা। আমি কী করবো? গাড়ির হর্ণ শোনা গেল। পা দুটিকে পাথরের মতো ভারী লাগছে। তবু পাথরকে নাড়াতে হয়।


===============
[ গল্পটি ০৩ জানুয়ারি ২০০১ তারিখে প্রথম আলো বন্ধুসভায় প্রকাশিত। বৃটিশ প্রবাসী আমার এক বন্ধুর উদ্দেশ্যে লেখাটি এ ব্লগে প্রকাশ করা হলো। ]
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরূপের সাথে হলো দেখা

লিখেছেন রোকসানা লেইস, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৫



আট এপ্রিলের পর দশ মে আরো একটা প্রাকৃতিক আইকন বিষয় ঘটে গেলো আমার জীবনে এবছর। এমন দারুণ একটা বিষয়ের সাক্ষী হয়ে যাবো ঘরে বসে থেকে ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×