somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বস নাম্বার ওয়ান: অবিশ্বস্ত অথচ আকর্ষণীয়

১৭ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ১১:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বস নাম্বার ওয়ান হলো থাইল্যান্ডের মাটিতে দুই বাংলাদেশির আন্ডারওয়ার্ল্ড বস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াইয়ের কাহিনি। এক পক্ষে আছে নায়ক হৃদয় খান, আরেক পক্ষে আছে ভিলেন ডলার তালুকদার ও তার বাহিনী। তাদের শত্রুতার উপলক্ষ অবশ্য হূদয় খানের বাবা এবং প্রেমিকা। তবে এমন নয় যে এরা সবাই থাইল্যান্ডে বাস করে; বরং বাংলাদেশের শত্রুতার জের পাতাইয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এবং এর শেষ পাতাইয়ার মাটিতেই হয়। ফলে ছবি দেখে মনে হবে, পাতাইয়া কক্সবাজারের মতোই কাছের কোনো জায়গা এবং সেখানকার বিচ এলাকায়, অন্য কেউ নয়, সব বাংলাদেশিই দাপিয়ে বেড়ায়। ছবির পাতাইয়াপ্রীতি এতই প্রকট যে কাহিনি যখন থাইল্যান্ডে উড়ে যায়নি, তখনো হৃদয় খান ও তার প্রেমিকা আলো চৌধুরী পাতাইয়া বিচেই ডেট করে। ব্যাকগ্রাউন্ডের নানা থাই আলামত (যেমন—থাই ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড) আড়াল করার চেষ্টা করেননি পরিচালক।

মোহাম্মদ হোসেনের প্রযোজনায় ও বদিউল আলম খোকনের পরিচালনায় নির্মিত শাকিব খাননির্ভর চলচ্চিত্র-কারখানার এই ছবিকে হিট বানানোর দায়িত্ব শাকিব খানের কাঁধেই বর্তেছে। বাকিদের দায়িত্ব তাঁকে কেবল সমর্থন দেওয়া। ফলে শাকিব খানের আক্রোশের শিকার হওয়ার জন্য মিশা সওদাগর অভিনীত ডলার তালুকদার চরিত্রকে কিছুটা বাড়তে দেওয়া হয়েছে। আর সংঘাত শুরুর উপলক্ষ হিসেবে শাকিব খানের বাবা রাহাত খানরূপী প্রবীর মিত্রকে স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির প্রধান হিসেবে দেখানো হয়েছে। রাহাত খান চাঁদা না দেওয়ার পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চাঁদাবাজদের আক্রমণের শিকার হন। বাবাকে রক্ষা করতে গিয়ে হৃদয় আহত হয়। এই চাঁদাবাজদের গডফাদার হলো ডলার তালুকদার। হাসপাতালে রক্ত দিয়ে হৃদয়কে বাঁচিয়ে দেয় আলো চৌধুরী। ফলে তাদের মধ্যে প্রেম হয়; বিয়েও ঠিক হয়। ওদিকে ডলার বাহিনীর সঙ্গে হৃদয়ের শত্রুতা নানা সূত্রে বাড়তেই থাকে। বিয়ের দিন আলোকে কিডন্যাপ করে ডলার বাহিনী। তাকে উদ্ধার করতে হৃদয় ডলারের আস্তানায় গেলে তাকে প্রচণ্ড মারধর করে ডলার বাহিনী এবং আলোকে গুলি করে। অজ্ঞান আলোকে নিয়ে একটি জিপে করে হৃদয় যেতে চাইলে ডলার হৃদয়কে গাড়ি থেকে টেনে নামায় এবং গাড়িটি রাস্তা থেকে পাহাড়ের নিচে পড়ে আগুন লেগে যায়। ডলারের লোক পুলিশ অফিসার হৃদয়কে গ্রেপ্তার করে আলোকে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যার অভিযোগে।

একসময় হৃদয় জেল থেকে পালায়। এ সংবাদ পেয়ে ডলার তার পুরো বাহিনী নিয়ে পাতাইয়া পালায়। সেখানে গিয়ে সে আন্ডারওয়ার্ল্ডের বস নাম্বার ওয়ান হওয়ার মিশনে নামে। আর ডলারের খোঁজ দিয়ে হৃদয়কে পাতাইয়া ডেকে নেয় ক্রাইম রিপোর্টার আশা চৌধুরী। সেখানে গিয়ে হৃদয় খানও দাবি করতে থাকে, সে-ই বস নাম্বার ওয়ান। তারও এক বাহিনী গড়ে ওঠে। ফলে এ দুই পক্ষের সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। দেশ থেকে ডলার ধরে নিয়ে আসে হৃদয়ের মা-বাবা, ভাই-ভাবি ও ভাতিজাকে। ডলারের হাতে একে একে নিহত হয় ভাই ও বাবা। এদিকে আশা ও হৃদয় একসঙ্গে কাজ করলেও এবং প্রকাশ্যে আশা হৃদয়ের প্রেমপ্রত্যাশী হলেও শেষ পর্যন্ত আশা হৃদয়কে খুন করে বোন আলোকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায়। জানা যায়, আলো মারা যায়নি। অচেতন আলোকে নিয়ে ড্রাইভারবিহীন জিপটি পাহাড়ের নিচে পড়ে গেলেও শেষ মুহূর্তে সে গাড়ি থেকে রাস্তায় ছিটকে যায়। আর তখনই চট্টগ্রাম থেকে ড্রাইভ করে ফিরছিল আশা। আশা আলোকে নিয়ে থাইল্যান্ডে চলে আসে। দীর্ঘদিন সে হাসপাতালে কোমায় রয়েছে। এই কাহিনি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলো ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় এবং বোনকে বলে যে হৃদয় তাকে কখনোই ধর্ষণ বা খুন করতে চায়নি, বরং সব সময় ভালোবেসেছে। আশা ক্ষমা চায়, হৃদয় ফিরে পায় প্রেমিকাকে। এবার হৃদয় ডলার বাহিনীকে একাই হত্যা করে।

বস নাম্বার ওয়ান চলচ্চিত্রটি বহু কাকতাল ও অসংগতিতে পরিপূর্ণ। যখনই বাবা আক্রান্ত হয়, হৃদয় সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। জেল থেকে পালানোর নৈতিক সমর্থন দেন জেলার সাহেব, যিনি আবার আলো-আশার বাবা। অচেতন আলোকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আবিষ্কার করে তারই বোন। এসব হলো অসংখ্য কাকতালীয় ঘটনার কয়েকটি। অসংগতিরও শেষ নেই। হৃদয় মারামারি করে মাথায় চোট পেল। মারামারি করল সে এক পোশাকে, ব্যান্ডেজ বেঁধে বাসায় ফিরল আরেক পোশাকে। আলো বলছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কথা, অথচ দেখা গেল এফডিসির ভেতরের এক রাস্তা। দৃশ্য—রাজপথের সিগন্যালে ফুল বিক্রির, অথচ তা চিত্রায়িত হয়েছে এফডিসির ভেতরে, দুই সারির কয়েকটি গাড়ির পরেই এফডিসির হলুদ রঙের দেয়াল দেখা যায়। আর দর্শকের বুদ্ধির ওপর পরিচালকের চূড়ান্ত অনাস্থা দেখা গেল ওই অংশে—কাহিনি বাংলাদেশে ঘটছে, অথচ বারবার ক্যামেরা চলে যাচ্ছে থাইল্যান্ডে। ডলার যখন ঘোষণা দিয়ে থাইল্যান্ড যাচ্ছে এবং তাকে অনুসরণ করে হৃদয়ও সেখানে যাচ্ছে, কেবল তার পর থেকেই থাইল্যান্ডকে দেখানো যেত। আগের অংশে পাতাইয়া বিচ দেখানোর লোভ সংবরণ করতে পারা উচিত ছিল পরিচালকের। ফলে চলচ্চিত্রের কাহিনিবিন্যাস ও চিত্রায়ণ অবিশ্বস্ত ঠেকে।

ভিনদেশে গিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের বস নাম্বার ওয়ান হওয়ার প্রতিযোগিতাটির যৌক্তিকতা একেবারেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিশেষত ওই দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ড বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেটার অনুমোদন এত সহজে কিছুতেই দেবে না। ডলারের একটা প্রেক্ষাপট হয়তো আছে, কিন্তু হৃদয় খানের পক্ষে এত অল্প সময়ে ভিনদেশে গিয়ে একটা বাহিনী গড়ে তোলা কতটুকু সম্ভব? এই ক্ষমতা ও অর্থ সে কোথায় পেল? যে আশা চৌধুরী তাকে সাহায্য করছে, তারই বা থাইল্যান্ডে কতটুকু ভিত্তি আছে? সে কোন চ্যানেলের সাংবাদিক—দেশের, না থাইল্যান্ডের? এসব মৌলিক প্রশ্নের কোনো মোকাবিলাই করা হয়নি। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কেবল ধারাবাহিকভাবে অসম্ভব সব ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আগের ঘটনাগুলো কাহিনিতে যৌক্তিকভাবে প্রতিষ্ঠা না করেই পরের অসম্ভব ঘটনাগুলো হাজির করা হয়েছে।

দুর্বল গতানুগতিক কাহিনি এবং অবিশ্বস্ত চিত্রায়ণের পরও ছবিটির দর্শক টানার উপাদান রয়েছে। এ ছবির অন্যতম বাজি হলেন শাকিব খান। শুরুর দিকে ভারতীয় অভিনেতা সালমান খানকে অনুকরণ করলেও এখন তিনি তাঁর নিজস্ব সাবলীল অভিনয়রীতি দাঁড় করিয়েছেন। আলো-আশার চরিত্রে নিপুণ ও সাহারা উতরে যান তাঁদের সৌন্দর্য, বিশ্বস্ত পোশাক-আশাক ও চলনসই অভিনয়কুশলতা দিয়ে। ডলার তালুকদার চরিত্রটিতে শক্তিমান অভিনেতা মিশা সওদাগরও মানানসই ছিলেন।

এফডিসির মানের তুলনায় ছবিটির মুদ্রণমান বেশ ভালো। এ জায়গায় যে যথেষ্ট মনোযোগ পরিচালক-প্রযোজক দিয়েছেন, তা পর্দায় রঙে ও দৃশ্যের গভীরতায় স্পষ্ট। ফলে পাতাইয়ার চমকপ্রদ লোকেশন দর্শকের চোখে আরাম দেবে। পাহাড় থেকে গাড়ি পড়ে যাওয়ার দুটি কাটপিস অবশ্য ব্যবহার করা হয়েছে। সেগুলোর প্রিন্ট ছিল যাচ্ছেতাই। যে কাটপিসকে সহজে চেনা যায়, তা ব্যবহার না করাই ভালো। আসাদুজ্জামান মজনুর ক্যামেরাও বেশ নিয়ন্ত্রিত ছিল। শটের ধারাবাহিকতা নির্মাণের ক্ষেত্রে, বিশেষত নৃত্যগীত ও মারামারির দৃশ্যগুলো অনেকখানি ত্রুটিমুক্ত ছিল। সাধারণত এ দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের চিত্রগ্রাহকেরা অনেক গোলমাল করে ফেলেন। তবে অন্য সব ছবির মতোই মারামারির দৃশ্যগুলোতে ব্যবহূত সাউন্ড ইফেক্ট পীড়াদায়ক। ব্যবহূত পাঁচটি গানের একটিও খুব চেনা গানের নকল নয়, গানগুলো শুনতেও মন্দ নয়। তাই সংগীতপরিচালক আলী আকরাম শুভকে ধন্যবাদ দিতে হয়।

প্রথম আলো, আনন্দ পাতায়, ১৭ নভেম্বর, ২০১১ তারিখে প্রকাশিত।
১৮টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×