বয়ঃসন্ধিকালে কখনো কখনো মাকে প্রতিপক্ষ মনে হয়। মায়ের শাসন-বারণ বিরক্তির উদ্রেক ঘটায় মেয়ের মধ্যে। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে মায়েরা এমন করেন? মেয়েরাই বা কী বলছে। কেন মনে প্রশ্ন আসে, মা কি আসলেই প্রতিপক্ষ?
‘আমার মা কর্মজীবী। স্কুল-কোচিং থেকে ফিরে একাই থাকতে হয় আমাকে। এই সময়টুকুতে কারও সঙ্গে বসে কথা বলতে ইচ্ছা করে। বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে সময়টা কাটাই। এটা নিয়েই মায়ের যত আপত্তি। ছেলেমেয়ে—সব বন্ধুর সঙ্গেই তো কথা বলি। কিন্তু মায়ের কথা শুনে মনে হয়, আমি শুধু ছেলেদের সঙ্গে কথা বলি।’ বলে সিনথি (ছদ্মনাম)। ‘এমনকি আমার বন্ধুরা বাসায় এলে মা বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। অপমানিত লাগে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আসলেই মা আমার ভালোর জন্যই কি এমন করেন? এতে কি আমার ভালো হচ্ছে, বুঝতে পারি না। খুব বিরক্ত লাগলে কথা বলি না। পরে অবশ্য ঠিক হয়ে যায়।’
সিনথির মা রোকেয়া আকতার (ছদ্মনাম) বলেন, ‘সারা দিন অফিসে থাকি। মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা হয়। বাড়িতে ফিরেই দেখি মোবাইলে কথা বলছে। পত্রিকা-টেলিভিশনে দেখি, মোবাইল ফোনের কারণে মেয়েরা কত ঝামেলায় পড়ে। যদি কোনো খারাপ ছেলের খপ্পরে পড়ে মেয়েটা! এসব ওকে কীভাবে বোঝাব, জানি না। জেদ করতে থাকে। তখন আমারও বিরক্ত লাগে।’
‘মা সারাক্ষণ কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকান। আমি বাসায় না থাকলে কম্পিউটারে আমার ব্যক্তিগত ফাইলগুলো দেখেন। সবচেয়ে কষ্ট পাই যখন বাসার কাজের লোককে জিজ্ঞাসা করেন আমি সারা দিন কী করেছি। এ কথাটা আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করেন না, বুঝতে পারি না।’ বলেন কলেজপড়ুয়া অনা। ‘কখনো মায়ের কষ্ট হবে বা অবিশ্বাস করবেন—এমন কাজ করিনি। খুব ছোট থেকেই আমার ডায়েরি লেখার অভ্যাস। আমার অনুপস্থিতিতে সেসব ঘাঁটাঘাঁটি করেন মা। কোনো কারণে হয়তো বাসায় ফিরতে একটু রাত হলো। তাহলে তো কথাই নেই। কী হবে, কী হতে পারত—এই একই কথা বারবার বলতে থাকেন। বাসায় বলে যাই বা দেরি হলে জানিয়ে দিই। তবু এমন করেন মা। আমি নিজের ভালোমন্দ বুঝি। এটুকু আস্থা নেই তাঁর আমার প্রতি।’
অনার মা বলেন, ‘মেয়ে বড় হয়েছে। এটুকু শাসন করতে হবে। সন্তান মানুষ করা অনেক কঠিন। মেয়ের দেরি হলে দুশ্চিন্তা কোন মায়ের হয় না? যেহেতু কর্মজীবী আমি। ফলে কাজের লোকের কাছেই তো সারা দিন থাকে। তার কাছে জিজ্ঞাসা করাতে দোষ কোথায়, জানি না। আর এ বয়সে আবেগঘটিত নানা ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে মেয়েরা। অনা চাপা স্বভাবের মেয়ে। কিছুই বলবে না আমাকে। তাই মাঝেমধ্যে ওর ডায়েরি দেখি। মা হলে এসব করতে হয়।’
মা যেন সানজানার কাছে প্রতিপক্ষ। তার মতে, ‘সবকিছুতেই মায়ের আপত্তি। হয়তো একটা বই পড়তে পড়তে বেশি রাত হয়ে গেল। তখনই শুরু করেন বকা দেওয়া। বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে গেলে মায়ের মুখ কালো হয়ে যায়। অথচ মায়ের বন্ধুদের বাসায় আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে হয়। তখন কিছু বলাও যাবে না। ক্যাপ্রি টপস, জিনস পরতে পছন্দ করি। মা সেখানেও বাদ সাধেন। এটা পরা যাবে না। অমুক পোশাকে বেমানান লাগবে। কেউ এলে তার সামনে বাড়তি একটা ওড়না পরতে হবে। কী যে মেজাজ খারাপ হয় তখন। অসহ্য লাগতে থাকে মাকে।’
সানজানার কথার সূত্র ধরেই ওর মা সাদিয়া ইসলাম বলেন, ‘আমি ওর বন্ধুদের বাসায় যাওয়া পছন্দ করি না। এটা ঠিক নয়। তবে সব সময় তো সব জায়গায় যাওয়া যায় না। এটা ও বুঝতে চায় না। মায়ের সঙ্গে মেয়েরা কি ঘুরতে যায় না? ও যেতে চায় না। একঘেয়ে লাগে তার কাছে। সারাক্ষণ নিজের মতো করে থাকতে চায়। আর রাত জেগে বই পড়লে পরদিন স্কুলে যেতে দেরি হবে। ক্লাসে ঘুম ঘুম লাগবে—এসব তো ও বোঝে না। মনে করে, মা বুঝি ওর শত্রু। আমি চাই, মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর মতো হতে। পারছি না কোনোভাবেই।’
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ৮:২৮