somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিউচার ফিকশনঃ অমরত্ব

০৯ ই মে, ২০১৩ সকাল ১১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

****
লিন্ডা আমার নতুন বন্ধু। আবার একেবারে নতুনও বলা যায় না। অল্পক'দিনেই অনেক পুরোনো বন্ধুর চেয়েও তার সাথে বেশি সময় কেটেছে।
তার সাথে অনেক ব্যাপারেই আমার মিল আছে। সেও রাতে ঘুমায় না। আমিও না। লিন্ডাও আমার মতই কবিতা পড়তে ভালোবাসে। ভাবতে ভালোবাসে। একবার মজা করে জিজ্ঞেস করেছিলাম 'কি ভাবো'।
হেসে উত্তর দিয়েছিল। 'তুমি যা ভাবো তাই।'
বিনিময়ে আমিও হাসি। আমরা আসলে কেউই জানি না কি ভাবি। কিন্তু ভাবি।
লিন্ডা খুব মাইডিয়ার টাইপের মেয়ে। এককথায় খুব চমৎকার একজন মানুষ। তার সাথে থাকা সময়গুলো ভীষন উপভোগ করি।

আমি তখন সমুদ্রের কাছে বসে ঢেউ গুনছিলাম। চারশ ছাব্বিশ পর্যন্ত গুনেছি বা চারশ সাতাশ- ঠিক খেয়াল নেই, দেখি লিন্ডা ডাকছে।
'কি কর?'
'ঢেউ গুনি'
'বাহ। কত পর্যন্ত গুনলে?'
'চারশ সামথিং'
লিন্ডা হাসে। সবার হাসিই একরকম। কিন্তু লিন্ডার হাসিটা আমার কেন জানি খুব মিষ্টি লাগে।
'তোমার হাসিটা সুন্দর'
'তাই না?'
'হ্যা।'
লিন্ডা মুখ বাঁকায়।
আমরা অনেকক্ষন একসাথে থাকি। আমার আর ঢেউ গোনা হয় না।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটা অদ্ভুত। এখানে কেউ কারো আপন না। আবার সবাই সবার খুব আপন। সময় এখানে নিস্তরঙ্গ। আর মূল্যহীন। অথচ একসময় একচিমটি সময় বাঁচানোর জন্য কি না করেছি। আমার এখনো মনে পড়ে পরীক্ষার আগের সময়টাতে কিরকম ব্যস্ত থাকতাম। দেখা যেত নাস্তা খাওয়ার সময়টাও পড়ছি। নাস্তাটা খাওয়ার জন্যই খাওয়া। কোনরকম নাকে-মুখে খেয়েই উঠে পড়তাম। নইলে আবার দেরি হয়ে যাবে। সময়টাকে একটা বিশাল দৈত্য মনে হত। আমি আমার ছোট্ট শরীর নিয়েও তার সাথে ছুটতাম। তাকে কিছুতেই এগিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। দানবটাকে লাগাম পড়িয়ে না রাখতে পারলেই সর্বনাশ। এখন মনে হয় সময়ের সাথে রেস লাগা বিশাল সাহসের ব্যাপার।


****
'লিন্ডা তোমার বয়স কত?'
'জানোনা মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই।' সে হাসে।
'জানি তবুও ইচ্ছা হল'
'দাঁড়াও দেখতে হবে'
কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়। 'আঠারো চলে।'
'আঠারোর আগে কত?'
'জানো না? তিনশ। তিনশ আঠারো।'
'তিনশ আঠারোতম জন্মদিনের শুভেচ্ছা লিন্ডা'
লিন্ডা অবাক হয়। 'ধন্যবাদ'।

অমর মানুষদের জন্মদিনে খুব একটা উচ্ছ্বসিত হতে দেখা যায় না। অন্য দশটা সাধারন দিনের মতই সময় কাটে। বা সময় ঝিমায়। কেননা এখানে সময় সহজলভ্য। মরনশীল মানুষরা সময় নিয়ে দৌড়ঝাপ করবে। হা হুতাশ করবে। অমরদের জন্য কথাটা সত্যি না। এখানে 'time and tide wait for none' অর্থহীন প্রলাপ। বরং 'time and tide are waiting for you' শুনতে ভালো শোনায়।

'লিন্ডা তোমার গল্প বল'
'কোন গল্প'
'বেঁচে থাকার সময়ের গল্প, সবুজ গল্প, দূষিত কিন্তু পবিত্র গল্প।'
'আমরা কি বেঁচে নেই?'
ভাবনায় পড়লাম। আমরা বেঁচে আছি। থাকব। আমাদের হাতে অফুরন্ত সময়। এজন্যই সময় এখানে মূল্যহীন। সহজলভ্য। বড় সহজে সহজলভ্য।
'আমরা বেঁচে আছি লিন্ডা'
'কিন্তু আমি লিন্ডা নই। আর তুমিও রাতুল না। আমরা লিন্ডা আর রাতুলের মেমরি ম্যাপ।'
লিন্ডা থামে। 'সহজভাষায় আমরা একটা প্রোগ্রাম।'

আমরা একইসাথে বেঁচে আছি এবং বেঁচে নেই আসলে। ব্যাপারটা জটিল। মানুষের দেহ অক্ষয় না। একটা সময়ের পর তাতে ত্রুটি দেখা দেয়, চামড়া শিথিল হয়ে আসে, জরা জাগে, বার্ধক্য ঘিরে ধরে। বিজ্ঞানীরা দেহকে বাঁচিয়ে রাখতে অনেককাল চেষ্টা করে গেছে। তাতে লাভ হয় নি। দেহ সজীব থাকে নি। মনোযোগ দেয়া হয় মস্তিষ্কের দিকে। মস্তিষ্কের সকল মেমরি, ডাটার প্রতিলিপি সংরক্ষনের প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়। সম্পূর্ন মস্তিষ্কের ডাটার বাইনারি ম্যাপ ধারন করা হয় সিলিকন চিপে। মেমরি চিপটি 'ব্রেইনড্রাইভ'-এ স্থাপন করে যুক্ত করা হয় মূল কম্পিউটারের সাথে। ইন্সটলেশনের পর আমরা যুক্ত হই নেটওয়ার্কে। যেখানে শেয়ারিং অবস্থায় আছে অসংখ্য চিপ।

এইসব কথা আমি আর্কাইভে থাকা ডকুমেন্টারি থেকে জেনেছি। ডকুমেন্টারিতে আরো বলা আছে যে এই ধরনের ভার্চুয়াল সারফেস বা আমাদের ভার্চুয়াল অমর সমাজের ধারনা প্রাচীন পৃথিবীর 'ফেসবুক' নামক এক সাইট থেকে নেওয়া হয়েছে।


****
'রাতুল'
'হু'
'কি কর?'
'সমুদ্র দেখি। সমুদ্র কি বিশাল তাই না?'
'হু। সমুদ্র তোমার অনেক পছন্দের?'
'হয়তো। কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগে।'
'তুমি কখনো সমুদ্রে স্নান করেছ?'
'না'
লিন্ডা চোখ বড়বড় করে তাকায়। সমুদ্ররস্নান না করতে পারায় নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হয়।
'সমুদ্রের জল ছুঁয়েছ?'
'না। আমি কখনো বাস্তব সমুদ্রের কাছে যাই নি।'
লিন্ডা অবাক হয়। 'তুমি সমুদ্র দেখো নি?'
'না'
আমি আবার সমুদ্র দেখি। কি নীল। কি বিশাল।

লিন্ডার সাথে আমি অনেক সময় কাটাই। আমাদের অনেক কথা হয়। বাস্তব জীবনের গল্প। লিন্ডা আগে গান গাইত। ওর স্বামী ইমমর্টালিটি এইজ রেঞ্জের আগেই রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। ইমমর্টালিটি এইজ রেঞ্জ শুরু হয় পঞ্চান্ন থেকে। অর্থাৎ ফিফটি-ফাইভের পরই সবার মেমরি ম্যাপিং করা হয়। কারন এই বয়সের পর থেকেই মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়। এর আগে দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে অমর হওয়ার সুযোগ পায় না।
লিন্ডার স্বামী মারা যাবার সময় বয়স ছিল তেত্রিশ।

'কি হল চুপ যে?' আমিই নীরবতা ভাঙ্গি।
'এমনি। তুমিও চুপ। আমিও চুপ।'
'মন খারাপ?'
'বেঁচে থাকাটা খুব ক্লান্তিকর না?'
আমি হাসি। 'ক্লান্তিকর হবে কেন? আমরাতো ভালোই আছি।'
'সত্যিই কি ভালো আছি?'

আমি লিন্ডাকে বোঝাই কিভাবে আমরা সত্যিই ভালো আছি। আমাদের জগৎ বিশাল। বিশাল একটি আর্কাইভ আছে আমাদের। সেখানে অসংখ্য উপাদান- সাহিত্য, সঙ্গীত, জ্ঞান- সবকিছুই থরে থরে সাজানো। তাছাড়া আমরাতো পৃথিবী থেকে আলাদা না। পৃথিবীকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান দিয়ে সাহায্য করে চলেছি প্রতিনিয়ত। আমাদের মধ্যে বিজ্ঞানী আছে, লেখক আছে, শিল্পী আছে। আমরা কেউ বসে নেই। দিনের একটা সময় আমরা সবাই কাজ করছি। আধুনিক সভ্যতার বিশাল উন্নতির পেছনে অমর মানুষদের অবদান অনস্বীকার্য। পৃথিবীর মানুষ আমাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
লিন্ডা হাসে। অনুজ্জ্বল হাসি।


****
সারাদিন লিন্ডার কোন শব্দ নেই। আমিই খোঁজ নিতে গেলাম।
'কি ব্যাপার আজ একেবারে চুপ যে। সারাদিনে একবারও খোঁজ নিলে না।'
কোন সাড়া নেই।
'লিন্ডা। ঘুমাচ্ছ নাকি?'
খানিকপর যান্ত্রিক একটা কন্ঠ ভেসে আসে, 'দিস অ্যাকাউন্ট হ্যাজ বিন স্যাক্রিফাইসড'।

পুরো সারফেসে নিজেকে খুব একাকী লাগে। লিন্ডা কিছু না বলে এভাবে হারিয়ে যাবে ভাবি নি কখনো। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। একজন অমর মানুষের খুব কাঁদতে ইচ্ছা করে। কিন্তু একটি প্রোগ্রাম কাঁদে না, কাঁদতে পারে না।
তবু এই অমরত্বের বিনিময়ে হলেও অশ্রু ঝরানোর ইচ্ছা জাগে আমার। অদম্য ইচ্ছা।
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্টে যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×