somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দু'জন মেয়ের একজন

০৬ ই নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঢাকায় তখন এখানে ওখানে বিক্ষোভ চলছিল। কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।

বাসে করে সাইন্স ল্যাব থেকে মতিঝিল যাচ্ছিলাম। মিনিবাসে। ভিড়। গরম। অনেক মানুষ। নেয়ে ঘেমে অতিষ্ঠ।
বাস যেখানেই থামছে লোক তুলছে। কত লোক তুললে তার বাসে জায়গা থাকবে না এটা ভগবান জানেন। এ নিয়ে কেউ কেউ খেঁকিয়ে উঠলেও
থেমে যাচ্ছেন।

এই অসহ্য আবহাওয়ায় কিছু লোক মোজে থাকেন। একটার পর একটা জোক বলেন। তর্ক করেন।
আমি দেখছি এক লোক রডে হাত দিয়ে ঝুলে দাঁড়িয়ে বিবাহের অপকারিতা নিয়ে একটা কৌতুক বললেন।
তার কথায় একমত হয়ে এক বয়স্ক লোক স্ত্রীর অত্যাচার নিয়ে কথা বললেন।
বলা বাহুল্য মহিলা সীট নীরব থাকল না। একজন তরুণী ঘাড় ঘুরিয়ে বলেই ফেললেন, ভাই, একটা কথা বলি,
ওয়াইফেরা যদি এতই খারাপ তাইলে বিয়ে করেন ক্যান?

এর পর শুরু হল আহ্লাদী ঝগড়া ঝাটি।
বিষয় বস্তু নারী বনাম পুরুষ। বিশ্বকাপ ফুটবল আর নারী পুরুষ তর্ক বাসে ব্যাপক জনপ্রিয়।
মহিলাদের তিনজন যোগ দিল এক দলে। পুরুষেরা। আর এই গরমের ভিতর শ্রোতা হয়ে বাকি লোকজন শুনছিল। আমিও।

আমি ছাত্রজীবনের শেষ প্রান্তে। টিউশনি করে চলি। পয়সা বাঁচাতে বাসে চড়ি। কৌতুক বিতর্ক পচে যাওয়ার মত তবুও হো হো করে হেসে উঠি।
বাসটা হঠাৎ মত বদল করে যাদুঘরের সামনে ডানে ঘুরল।
তারপর সবাইকে অগ্রাহ্য করে টিএসসির দিকে ছুটল।

যাত্রীরা হৈ চৈ করছিল।
-ঐ ডেরাইভার থাম!
-যাস কই ভাড়া লইসস মতিঝিল পর্যন্ত এই দিকে যাইতাসস ক্যান?
-ক্যান দেখতাসেন না পেরকেলাবে ভাঙচুর হইছে। ঘুইরা যাইব, হেলপার বোঝাতে চায়।

আমার সময়ের তাড়া।

ঐ হেলপার, আমি নামুম। দাঁড়িয়ে থেকে নামার জন্য গেটে এগিয়ে গেলাম
ভাবলাম রিক্সা নিয়ে চলে যাব। তবুও একটা জরুরী কাজ মতিঝিলে। একজনের কাছে টাকা ধার পাবো। দেরী হলে আর হবে না।
আমি বাস কন্ডাকটরকে বললাম, এই আমি নামায়ে দিস
ড্রাইভার বলল, সাবধানে থামাইতে ক
চালু কইরা নামেন , কথা কন ক্যা, দোয়েল চত্বরের কাছে এসে বলল হেলপার

তিন নেতায় আমি নামতে যাব ঠিক তখুনি বাস সজোরে টান দিয়েছে।
আর আমার শুধু মনে আছে প্রচণ্ড গতিতে আমি ছ্যা ছ্যা শব্দ করে কনক্রিটের উপর পড়ে গেছি। তারপর কিছু জানি না।

শুনেছি কেউ কেউ চিৎকার শুনেছে। আমি মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করছি। বাসটা চলে গেছে দ্রুত। পিছনে একটা গাড়ি বা ট্রাক থাকলে শেষ খবর হত।
সৌভাগ্য যে আমি ছিটকে গেছি পথের এক পাশে। উপরে তপ্ত সূর্যে। শুধু মনে হল পাশ দিয়ে আইসক্রিমের গাড়ি চলে গেল। একটা স্কুটার হর্ন বাজিয়ে গেল। কেউই থামল না। হাঁটু থেকে রক্ত ঝরছে, প্যান্ট ছিঁড়ে গেছে। বিপদে সবাই তখন চলে যাচ্ছিল ..কেননা সবাই ঝামেলা এড়াতে চায়।

***
ঠিক তখুনি দৈববাণীর মত একটা রিক্সা থামল আমার পাশে।
দুটো মেয়ে নামল। রিকশাওয়ালাকে বলল, ঐ রিক্সা তুমি দেখতেসো উনি কি অবস্থা । ব্লিডিং হচ্ছে সমানে। পা দুটা ধরো। আর মেয়ে দুটো ঝট করে তাদের কোলে তুলে নিল। আর সেই অবস্থায় রিক্সায় উঠে বসল।
আমি চোখ খুলতেই বয়সে ছোট মেয়েটা বলল, আপা চোখ খুলছে।
এত মায়াময় উদ্বিগ্ন চোখ আমি হয়তো কখনোই দেখি নি।

আল্লার রহমত। তুই ধর শক্ত কইরা। সঙ্গী মহিলাটি বলল, ভাই কেমনে এইডা হইল?
তখুনি মেডিক্যালের গেটে রিক্সা থামল। আমি অর্ধ-চেতন থেকে মাথা তুলে বললাম, আপা, ধন্যবাদ দেওয়ার উপায় নাই। আমি নিজেই হাইটা যাইতে পারব।
বড় মেয়েটি বলল, চুপ থাকেন। মইরা পইড়া থাকতেন। অখন তেজ বাড়ছে আপনের। আমার ঘাড়ে হাত রাখেন।
আমি তাদের ঘাড়ে হাত রেখে চললাম। আর ডাক্তার রক্তাক্ত দেখে দ্রুত ভর্তি করে নিয়েছিল মেডিক্যালে।

আমি শেষ মনে পড়ে ছোট মেয়েটি। বহুদিনের চেনা। তার ঘন কাল চোখ ভুলতেই পারি নি।

ব্যান্ডেজ হল। আমি পাশে তাকিয়ে হঠাৎ খেয়াল হল মেয়ে দুটি চলে গেছে।
আমি দুর্বল পায়ে এদিক ওদিক চেয়ে খুঁজে পাইনি তাদের।

****
এর পর বহু বছর কেটে গেছে। এখন আমি ভাল চাকুরী করি। অফিসের এসিস্টেন্ট ম্যানেজার। হাঁটুতে সামান্য একটা ব্যথা এখনো রয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বাড়ে।

এসব সত্ত্বেও আমি সবচেয়ে বেশী ছুটে বেড়াই। আমার রূঢ় ব্যবস্থাপনার দুর্নাম থাকলেও সবাই বেশ শ্রদ্ধা করে। যেমন আমার অধীনস্থ এক পিয়ন ছিল। ফটোকপি করা ইত্যাদির জন্য ডাকলে সব ডেস্কে যেত।
ঈদের সময়ে সাধারণত ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেতনের অতিরিক্ত টাকা দেই। এবার মনে হয় সেটাতে তার চলছিল না। সে কাঁচুমাচু করে আমাকে বলল
সার, আমারে আইজকে আরও তিন হাজার টাকা দিবার পারবেন? পরের মাসে দিয়া দিমু।
আমি না করি নি। গরীব মানুষ ঈদ করুক তাও।
হাতে ক্যাশ ছিল না বলে একাউন্টসকে ফোন করে বলেছি আমার নামে দিয়ে দিতে।
পিয়নটা বেশ বোকা ছিল। বলল ঈদের পরের দিন আমার বাড়িতে আসবেন। অফিসের কুদ্দুস স্যাররেও বলছি।
আমি বললাম আমি বিকালে পারব না, সকালে ঐ দিকে গেলে যাব একবার।
কথা মত গিয়েছিলাম। টিনের ঘর।
আমাকে চা দিয়ে এসেছিলেন তার স্ত্রী নিজেই।

আমি পিয়নের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছিলাম।
দেখতে পেলাম বহুদিনে আগের সেই মেয়ে। বয়স বেড়েছে সত্যি। কিন্তু মায়া ভরা চোখ আমার ভুল হতেই পারে না।

মেয়েটিও তাকিয়ে ছিল। আমি না চেপে বললাম, আপনে কি দুইজনের একজন আমারে এক্সিডেন্টের পরে মেডিকেলে দিয়া আসছিলেন?
"জি"
উত্তর শোনা মাত্র আমি উঠে দাঁড়িয়ে আবেগ আক্রান্ত গলায় বলেছিলাম, বোন? আপনি এখানে? কত খুঁজেছি.কত খুঁজেছি.পাই নাই।
মেয়েটি প্রায় কেঁদেই দিল।
বলল, ভাই! আমার স্বামী আপনার অধীনে কাজ করে। তার পরেও আপনে আমাকে বোন ডাকলেন। কৃতজ্ঞতার আসল কারণ তার কাছে বোধগম্য হয় নি।

বহু বছর পর হারানো কাউকে পেয়েছি ভেবে আমারও চোখে পানি এসে গেল। আমি বহু কষ্টে নিজেকে সামলালাম।

পিয়ন একটু অবাকই হয়েছিল আমাদের দু'জনের ব্যবহারে। সে না বুঝতে পেরে বলল, আপনে কি মরিয়মরে আগে চিনতেন সার?
---
ড্রাফট ১.০ / লেখার জন্য লেখা
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:১৬
৫৫টি মন্তব্য ৫৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্টে যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×