কোরআনের ইতিহাসতত্ত্বঃ
আল কোরআনে ইতিহাস সংক্রান্ত অনেক আয়াত বা ভবিষ্যৎবানী আছে যা বর্তমানে সত্য বলে প্রমানিত হয়েছে। আমি লক্ষ করেছি কোরআন ইতিহাস সংক্রান্ত যে ভবিষ্যৎবানী প্রথমে দিয়েছে তা পরবর্তিতে সত্য হয়েছে এবং তা কোরআনে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আমি বলতে চাচ্ছি যে, কোন অসামনজস্যতা পরিলক্ষিত হয় নি। আসুন আমরা এক নজর দেখি কোরআনে দেওয়া বহু ভবিষ্যৎবানীর মধ্যে কয়েকটিতে কি বলা হয়েছে।
প্রথমেই আসাক রোমানদের বিজয় সর্ম্পকেঃ-পবিত্র কোরআনের সূরা রূম এর প্রথম কয়েক আয়াতে ভবিষ্যত সম্পর্কে আরও একটি আশ্চর্যজনক সংবাদ দেওয়া হয়েছে । যেখানে রোমান সম্রাজ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে । এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, রোমান সম্রাট পরাজয় বরণ করেছে, কিন্তু তারা খুব শীঘ্রই আবার বিজয়ী হবে । আলিফ লাম, মীম; রোমানগণ পরাজিত হয়েছে নিকটবর্তী অঞ্চলে; কিন্তু ওরা ওদের এ পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয়ী হবে । কয়েক বছরের মধ্যেই, অগ্র ও পশ্চাতের সিদ্ধান্ত আল্লাহরই । সে দিন বিশ্বাসীরা হর্ষোৎফুল্ল হবে । (সূরা রূম-৩০-১-৪)। এই আয়াত নাজিল হয়েছিল ৬২০ খ্রিষ্টাব্দে, অগ্নীউপাসক পারস্যের হাতে খ্রিষ্টান রোমানদের পরাজয়ের সাত বছর পর। এতদসত্ত্বেও তখন এই আয়াতে বলা হয়েছিল যে, কিছু বছরের মধ্যেই রোমানরা পুনরায় বিজয়ী হবে । প্রকৃত সত্য এই যে, সে সময়ে রোমানরা যুদ্ধে এমন ভাবে বিধ¡স্ত হয়ে ছিল যে তখন তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে । সুতরাং রোমানদের পুনরায় বিজয় লাভ করার বিষয়টি তো ছিল সম্পূর্ন কল্পনাতীত ও হাস্যকর। রোমান সম্রাটদের জন্য হুমকি হিসাবে পারস্য পার্শ্ববর্তী অন্যান্য জাতিরাও সে সময় রোমানদের জন্য দারুন হুমকি সৃষ্টি করেছিল, এমন কি তখনকার রোমানদের কোন কোন শত্রু বাহিনী কনস্টান্টিনোপল এর দেওয়াল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল । সে সময় রোমান সম্রাট হারকিউলিস তার জনগনকে আদেশ দিয়েছিল যে, তাদের কাছে রক্ষিত সমস্ত সোনা এবং রূপা চার্চে জমা দেয়ার জন্য । পরবর্তীতে যা গলিয়ে মুদ্রা তৈরী করা হয় তাদের সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহ করার উদ্দেশ্যে। সে সময় এত কিছু করেও যখন সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহ করা যাচ্ছিল না, তখন হারকিউলিস তার জাতির ব্রোঞ্চ দ্রব্য গুলি পর্যন্ত গলিয়ে মুদ্রা তৈরী করেন । শুধু তাই নয়, সে সময় সম্রাট হারকিউলিস এর সম্রাজ্যের বিভিন্ন গভর্নররা পর্যন্ত বিদ্রোহ ঘোষনা করেছিলেন । ফলে রোমান সম্রাজ্য ধ¡ংস হওয়ার উপক্রম হয়েছিল । মেসপটেমিয়া, সিলিসিয়া, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, মিশর এবং আর্মেনিয়া এই সমস্ত রোমান অন্তর্গত রাজ্য সমূহ পারস্যের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল।সংক্ষেপে বলা যায় যে, সে সময়ে সকলে ধরেই নিয়েছিল খুব শীঘ্রই রোমান সম্রাজ্যের পতন ঘটবে । কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তে পবিত্র কোরআনের সূরা রূম এর প্রথম কয়েক আয়াত নাযিল হয়েছিল এই ঘোষনা দিয়ে যে, কিছু বছরের মধ্যেই রোমান সম্রাজ্য পুনরায় বিজয় লাভ করবে । সে সময় এই ধরনের পরিস্থিতিতে এ ঘোষনা বা তথ্য ছিল সম্পূর্ন বিশ্বাসের অযোগ্য । ফলে তখনকার অনেক অবিশ্বাসীই কোরআনের এই আয়ত নিয়ে ঠাট্রা মশকারা শুরু করে দিয়েছিল। তারা চিন্তা করে ছিল যে, কোরআনে ঘোষিত রোমানদের এই বিজয় বাস্তবে কখনই ঘটবে না । সূরা রূম এর প্রথম এই আয়াত নাযিল হওয়ার সাত বছর পর ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বরে নিনেভে রোমান ও পারস্য সম্রাজ্যের মধ্যে চুড়ান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এই সময়ে রোমান সেনাবাহিনী অবিশ্বাস্য ভাবে পারস্যদের পরাজিত করে । এর কিছু কাল পরে রোমানরা পারস্যদের তাদের সংঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য করে । যার ফলে রোমানরা তাদের হারানো রাজ্য গুলো পুনরায় ফিরে পায় । সর্বশেষে ‘‘রোমানদের বিজয়’’ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ তায়ালা যা ঘোষণা করেছিলেন, সেই অলৌকিক ঘটনার সত্যতা প্রমানিত হয়েছিল । এই আয়াতের আর একটি অলৌকিক বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে । আর সেটা ছিল ভৌগলিক অব¯হান সম্পর্কীয় সত্যতা । তা সে সময় কারও পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না । সূরা রূমের তৃতীয় আয়াতে আমরা অবগত হই যে, রোমানরা পৃথিবীর নিম্নতম অঞ্চলে পরাজিত হয়েছে । আরবিতে ‘‘আদনা আল আরদ্’’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর অর্থ করা হয়েছে ‘‘নিকটতম ভূমি’’ হিসাবে । আয়াতের সার্বিক দিক আমলে আনলে এর প্রকৃত অর্থ এটা উপযুক্ত বলে মনে হয় না । অর্থ্যাৎ এর একটা অন্য অর্থ আছে । আরবি শব্দ ‘‘আদনা’’ উৎপত্তি হয়েছে ‘‘ডেনি’’ শব্দ থেকে যার অর্থ ‘‘নীচু’’ এবং ‘‘আরদ্’’ যার অর্থ ‘‘পৃথিবী’’ । সুতরাং ‘‘আদনা আল আরদ্’’ এর সার্বিক অর্থ হচ্ছে ‘‘পৃথিবীর নীচু ভূমি’’ । আশ্চর্যজনক ভাবে সত্য যে, রোমান ও পারস্যের মধ্যে এই যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সংঘটিত হয়েছিল যখন রোমানরা পরাজিত হয়েছিল এবং জেরুজালেম পারস্যের দ্বারা দখল হয়ে যায় এবং তা ঘটেছিল পৃথিবীর সব থেকে নীচু ভূমিতে। জেরুজালেম মৃত সাগরের কাছে অবস্থিত। আরও সঠিক ভাবে বলতে হয় ¯হানটি ছিল সিরিয়া, প্যালেস্টাইন এবং জর্ডানের সংযোগ ¯হলে । ‘‘মৃত সাগর’’ যা সমুদ্র সমতল (ঈ-লেভেল) থেকে ৩৯৫ মিটার নীচে অবস্থিত এবং এটাই পৃথিবীর সব থেকে নীচু অঞ্চল । সুতরাং প্রকৃতভাবেই রোমানরা পৃথিবীর সব থেকে নীচু অঞ্চলে পরাজিত হয়েছিল, যে ভাবে আয়াতে বর্ণিত হয়েছে । এখানে অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় যে, মৃত সাগরের উচ্চতা শুধুমাত্র বিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলেই জানা শুধু সম্ভব হয়েছে । এর পূর্বে তখন কার মানুষের পক্ষে জানা যা ছিল সম্পূর্ন অসম্ভব যে, মৃত সাগর পৃথিবীর সব থেকে নীচু ভূমি। অথচ সেই সময়ে কোরআনে নাযিলকৃত আয়াতে বলা হয়েছে পৃথিবীর সব থেকে নীচু ভূমি প্রসংগে । সুতরাং এটা আবারও প্রমাণ করে যে, কোরআন আল্লাহর বানী এবং এতেই রয়েছে পৃথিবীর সকল সমস্যার একমাত্র গ্রহণযোগ্য ও সুন্দরতম সমাধান। পক্ষান্তরে পৃথিবীর মধ্যে অন্য সকল ধর্মগ্রন্থ সমুহে এমন কোন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়নি যা বর্তমানের আধুনিক বিজ্ঞার দ্বারা সিকৃত বা প্রমানিত।
কোরআনে উল্লেখিত শব্দ ‘‘হামানঃ- কোরআনে অতীত মিশর সম্পর্কে বেশ কিছু ঐতিহাসিক সত্যতার তথ্য দেয়া হয়েছে। যা কিছু দিন আগ পর্যন্ত ছিল মানুষের অজানা। এই বাস্তবতা আমাদের এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে যে, কোরআনের প্রত্যেকটি শব্দই অত্যন্ত প্রজ্ঞার সঙ্গে নির্বাচন করা হয়েছে । পবিত্র কোরআনে ‘হামান’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে, যা ছিল একজন চরিত্র। কোরআনে ফেরআউনের সঙ্গে ‘হামান’ এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনে ছয়টি বিভিন্ন ¯হানে ‘হামানের’ নাম উল্লেখিত হয়েছে। যে ছিল ফেরআউনের অত্যন্ত কাছের লোক । আশ্চর্যজনক যে, তৌরাত যেখানে মূসা (আঃ) এর জীবন সম্পর্কে বলা হয়েছে সেখানে ‘হামান’ এর নাম কখনও উল্লেখ করা হয় নাই । অথচ ওল্ডটেষ্টামেন্ট এর শেষ স্তবকে ‘হামান’ এর নাম উল্লেখ আছে। যাকে ব্যাবিলিয়নের রাজার একজন নিকট সহচর হিসাবে দেখানো হয়েছে। এই হামান সেই সময় ইসরাইলী জাতির উপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়ে ছিল, যা ঘটেছিল মূসার এক হাজার একশত বছর পর। কোন কোন অমুসলিমরা দাবি করে যে, নবী মোহাম্মদ (সঃ) তৌরাত ও বাইবেল নকল করে কোরআন লিখেছিলেন এবং একই সঙ্গে তারা আরও দাবী করে যে, তিনি এই কাজ করতে গিয়ে এই বই গুলো থেকে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে ভুল ভাবে কোরআনে লিপিবদ্ধ করেছেন । আনুমানিক ২শ বছর আগে মিশরীয় বর্ণমালা সংক্রান্ত অক্ষর সমূহ পাঠোদ্ধারের ফলে এটা প্রমাণিত হয় যে, ‘‘হামান’’ সর্ম্পকে তাদের এই দাবি অযৌক্তিক। কেননা মিশরীয় এই সমস্ত পুরাতন মূল দলিলে ‘‘হামান’’ শব্দটি আবিস্কৃত হয়। এই আবিস্কারের পূর্বে পুরাতন মিশরে এ সমস্ত খোদাইকরা লেখা সমূহ স¤পর্কে কিছুই জানা বা বোঝা যায়নি। প্রাচীন মিশরের ভাষা ছিল চিত্রলিপিতে ব্যবহৃত বর্ণমালা। যা যুগ যুগ ধরে অতিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। কিন্তু সেই সময়ে খ্রিস্টান ধর্মের প্রসারের ফলে এবং অন্যান্য সাং¯কৃতির প্রভাবে যিশুখ্রিস্টের মৃত্যুর পর ২য় এবং ৩য় শতাব্দীতে মিশরীয়রা তাদের প্রাচীন এই চিত্রলিপিতে ব্যবহৃত বর্ণমালা পরিত্যাগ করে। ফলে এই ভাষা কালের অন্তরালে হারিয়ে যায় এবং কারো পক্ষেই এই ধরনের প্রাচীন দলিলের পাঠোদ্ধার করা বা বোঝা সম্ভবপর হয় নাই । এ ধরনের পরিস্থিতি চলে আসছিল ২শ’ বছর আগ পর্যন্ত । প্রাচীন মিশরের চিত্রলিপিতে ব্যবহৃত বর্ণমালা সমূহের রহস্য সমস্যা সমাধান হয় ১৭৯৯ সালে একটি ক্ষুদ্র ফলক আবিস্কারের মাধ্যমে। যেটা ছিল যিশুখ্রিস্টের জন্মের ১৯৬ বছর পূর্বে এবং যার নাম ‘‘রোসেটা স্টোন’’। এ ফলকটা গুরুত্ব পায় এই জন্য যে, এটা তিন ধরনের ভাষায় লেখা ছিলঃ- প্রচীন মিশরীয় চিত্রলিপিতে ব্যবহৃত বর্ণমালা, তৎকালীন মিশরীয় সাধারণ জনগণের বোঝার জন্য সহজভাবে চিত্রলিপির দ্বারা এবং গ্রীক ভাষায়। এই গ্রীক ভাষার সাহায্যে প্রাচীন মিশরীয় লেখার বিষয়বস্তু সর্ম্পকে পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়। জ্বীন ফ্রাঙ্কোয়াইস চেম্পলিয়ন নামে একজন ফরাসী ব্যক্তি এই খোদাইকরা বিষয় বস্তুর অনুবাদ করেন। যার মাধ্যমে একটা হারানো ভাষা এবং সেই সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা সমুহ দীর্ঘকাল পর আবার আলোর মুখ দেখতে পায়। এইভাবে প্রাচীন মিশরের সেই সময়ের সভ্যতা, ধর্ম এবং সামাজিক জীবন স¤পর্কে জ্ঞান অর্জন করা পুনরায় সম্ভব হয়। এই প্রাচীন মিশরীয় চিত্রলিপিতে ব্যবহৃত বর্ণমালা পাঠোদ্ধার করে একটা গুরুত্বপূর্ন বিষয় সম্পর্কে জানা যায়, দেখা যায় প্রাচীন মিশরের খোদাইকরা দলিলে ‘‘হামান’’ শব্দটি উল্লেখ আছে। এই নামটি ভিয়েনার হফ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত একটি স্মৃতি ফলকেও উল্লেখ আছে। সমস্ত সংগৃহিত খোদাইকরা দলিল সমূহের উপর ভিত্তি করে ‘‘পিপল ইন দ্য নিউ কিংডম’’ নামে একটা অভিধান তৈরী করা হয়। এখানে ‘‘হামান’’ কে বলা হয়েছে যে, সে ছিল সে সময়ে অট্রালিকাদ্বি নির্মাণে ব্যবহৃত পাথরের খনির পাথর সংগ্রহকারীদের প্রধান। এই ফলাফল একটা গুরুত্বপূর্ন সত্যতা প্রকাশ করে। আর তা হচ্ছে যে, হামান ছিল একজন ব্যক্তি যে মূসা (আঃ) এর সময়ে মিশরে বাস করতো এবং যে ছিল ফেরাউনের খুব কাছের লোক। সে নির্মাণ কাজে জড়িত ছিল। কুরআনে হামান সর্ম্পকে একই ধরনের তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়। যা দ্বারা যারা কুরআনের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালিয়ে ছিল তার বিপরীত সত্যতা প্রমাণিত হয়। শুধু তাই নয় কুরআনে বলা হয়েছে যে, ফেরাউন হামানকে একটি সুউচ্চ স্তম্ভ নির্মাণ করতে বলে, প্রত্মতাত্ত্বিক আবিস্কারে যার প্রমাণ মেলে। ফেরাউন বলল, ‘হে পরিষদবর্গ। আমি ছাড়া তোমাদের জন্য কোন উপাস্য আছে বলে জানিনা! হে হামান! তুমি আমার জন্য ইট পোড়াও এবং এক সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ কর; যেন আমি মূসার উপাস্যকে দেখতে পারি। তবে, আমি মনে করি সে মিথ্যাবাদী। (সূরা কাসাস-২৮- ৩৮)। প্রাচীন মিশরের খোদাইকরা দলিলে ‘হামান’ নামের উপস্থিতি অমুসলিমদের কুরআনের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকে খন্ডন করে। এভাবে কুরআন অনেক ঐতিহাসিক সত্য তথ্য বর্ণনা করেছে যা নবী হযরত মোহাম্মাদ (সঃ) এর সময়েও হয়তো বোঝা সম্ভবপর হয়নি।
ইরাম শহরঃ-
কোরআনে উল্লেখিত মিশরীয় শাসকবর্গের নাম সমূহ
প্রাচীন মিশরে মুসা (আঃ)-ই একমাত্র নবী ছিলেন না যিনি মিশরে বাস করতেন। মূসা (আঃ) এর বহু পূর্বে ইউসুফ (আঃ) মিশরে বাস করতেন। আমরা মূসা এবং ইউসুফ (আঃ) এর ইতিহাস পড়ে তারই নিশ্চিত সামঞ্জস্য পাই। ইউসুফ (আঃ) এর সময়ে মিশরের শাসককে বর্ণনা করতে গিয়ে কুরআনে ‘‘প্রভু’’ (রাজা) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। রাজা বলল, ‘তাকে আমার কাছে আন, আমার বিশ্বস্ত সহচর নিযুক্ত করব’। পরে রাজা তার সাথে আলাপকালে বলল, আজ তুমি আমাদের কাছে মর্যাদাশালী ও বিশ্বাসী। (সূরা ইউসুফ-১২- ৫৩)। অন্যদিকে মূসা (আঃ) এর সময়ে শাসকদের বিষয়ে উল্লেখ করতে গিয়ে বৈসাদৃশ্য ভাবে ‘ফেরাউন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তুমি বনি-ইস্রাঈলকে জিজ্ঞাসা করে দেখ, আমি মূসাকে নয়টি ¯পষ্ট নিদর্শন দিয়ে ছিলাম, যখন সে তাদের নিকট এসেছিল ফেরাউন তাকে বলেছিল, ‘হে মূসা! নিশ্চয়ই আমি মনেকরি তুমি যাদুগ্রস্ত’। (সূরা বনি-ইসরাঈল-১৭-১০১)। বর্তমানে ঐতিহাসিক নথিপত্র আমাদেরকে অবগত করে, কেন মিশরের বিভিন্ন সময়ের শাসকদের নাম ভিন্ন ভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীন মিশরে ‘ফেরাউন’ শব্দটি ব্যবহার করা হত রাজকীয় প্রাসাদের জন্য। কিন্তু তারও আগের ‘‘ওল্ড কিংডম’’ এর শাসকরা এই নাম ব্যবহার করে নাই। মিশরীয় ইতিহাসে ‘ফেরাউন’ শব্দ নাম হিসাবে ব্যবহার শুরু হয় ‘‘নিউ কিংডম’’ যুগ শুরু হওয়ার পরে। এই যুগ শুরু হয় ১৮তম রাজত্বকালে (যিশুখ্রিস্টের জন্মের পূর্বে ১৫৩৯ ১২৯২) এবং ২০তম রাজত্বকাল (যিশুখ্রিস্টের জন্মের পূর্বে ৯৪৫-৭৩০) পর্যন্ত। যখন ‘ফেরাউন’ শব্দকে শাসক বর্গের জন্য সম্মানজনক নাম হিসাবে ব্যবহার করা হতো। সুতরাং এর মাধ্যমে আবার কুরআনের অলৌকিকতার সত্যতা প্রমাণিত হলো ইউসুফ (আঃ) বাস করতেন একেবারে ‘‘ওল্ড কিংডম’’ প্রাচীন মিশরীয় রাজত্বকালে, যার জন্য সে সময় তার মিশরীয় শাসকদের নাম ‘ফেরাউনের’ পরিবর্তে ‘রাজা’ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে মূসা (আঃ) ‘নিউ কিংডমের’ সময় বসবাস করতেন। যে সময় মিশরীয় শাসকদের ‘ফেরাউন’ হিসেবে সম্বোধন করা হতো। এ কথা সত্য যে, এই ধরনের পার্থক্য বের করতে হলে বা বুঝতে হলে নিঃসন্দেহে যে কোন ব্যক্তির মিশরের ইতিহাস স¤পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান থাকা আবশ্যক। অথচ ৪র্থ শতকে মিশরের প্রাচীন ইতিহাস হারিয়ে যায়। যেহেতু সেই সময়ে প্রাচীন মিশরে চিত্রে লিখিত ব্যবহৃত মিশরীয় বর্ণমালা তথা ভাষা বিভিন্ন কারনে কালের অতল তলে বিস্মৃত হয়ে যায়। যা ১৯শতকে পুনঃ আবিস্কারের পূর্ব পর্যন্ত পাঠোদ্ধার করা ছিল অসম্ভব। কুরআন যে সময়ে নাযিল হয় সে সময়ের মানুষের কাছে বিস্তারিত মিশরীয় ইতিহাস সর্ম্পকে তথ্যদি ছিল একেবারেই অপ্রতুল। ফলে মোটামুটি তারা সে সময়ে মিশরের ইতিহাস সর্ম্পকে ছিল অজ্ঞ। এই সত্যতা, অসংখ্য সত্যতার মধ্যে একটি।