somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উল্টো ফলাফল! (আমার মেডিকেল কলেজ জীবন-১২)

০৩ রা নভেম্বর, ২০১১ রাত ১১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মেডিকেলের প্রফ পরীক্ষাগুলোতে লিখিত পরীক্ষার চেয়ে মৌখিক পরীক্ষাগুলোই বেশী ভয়ংকর হয়ে থাকে। বিশেষ করে যদি কোনো ছাত্র বা ছাত্রী কোনো কারণে কোনো শিক্ষকের (যে শিক্ষক প্রফ পরীক্ষার ভাইভা নিবেন) নজরদারিতে থাকে, তাহলে পাস করা একটু কঠিনই হয়ে পড়ে। তাই ভাইভা পরীক্ষা হয়ে পড়ে কোনো ছাত্রের ভাগ্য, মেধা আর শিক্ষককে ম্যানেজ করার পরীক্ষা।

প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষার লিখিত পরীক্ষার পর ভাইভার আগে আমরা জানলাম প্রায় পনের দিনের মতো গ্যাপ আছে। আব্বু তখন থাকতো মুন্সীগঞ্জে, জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে। আমি আর মনোয়ার তিন-চার দিনের জন্য মুন্সীগঞ্জে চলে এলাম। দ্বিতীয় দিন রাতেই মেডিকেল কলেজ থেকে খবর এলো ভাইভা পরীক্ষার শিডিউল পরিবর্তন হয়েছে, ফিজিওলজীর ভাইভা দুইদিন পর শুরু হবে। আমরা যারা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, তাড়াহুড়ো করে কলেজে চলে আসলাম। এসেই শুনলাম আরেকটি দুঃসংবাদ। ফিজিওলজীতে এম এ হাই স্যার পরীক্ষা নিতে আসবেন না, ইন্টারন্যাল হিসেবে থাকবেন নাজনীন ম্যাডাম। ভাইভাতে ইন্টারন্যালের এক বিশাল ভূমিকা থাকে, ইন্টারন্যাল স্যার যদি এক্সটারন্যাল স্যারের চেয়ে সিনিয়র এবং প্রভাবশালী হয়, তাহলে ভাইভা অনেকখানি সহজ হয়। হাই স্যার ছিলেন ফিজিওলজীর দিকপাল, সেখানে নাজনীন ম্যাডাম অনেক জুনিয়র ছিলেন। আমরা ভাইভা নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম।

ফিজিওলজীর পরেই ছিলো বায়োকেমিস্ট্রি ভাইভা, ইন্টারন্যাল ছিলেন জলিল স্যার। ফিজিওলজী ও বায়োকেমিস্ট্রি ভাইভা কেমন দিয়েছিলাম, স্যাররা কি কি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার খুব একটা মনে নেই। শুধু মনে আছে, পরীক্ষা খারাপ হয় নি, আর নাজনীন ম্যাডাম ইন্টারন্যাল হিসেবে ভালোই প্রভাব রাখতে পেরেছিলেন। মজা হয়েছিলো এনাটমি ভাইভার সময়!

বায়োকেমিস্ট্রি ভাইভার পর এনাটমির আগে কয়েকদিন ছুটি ছিলো। আমরা প্রতিদিন ডিসেকশন রুমে গিয়ে ভিসেরা, বডি দেখতে থাকতাম। দুপুর একটা বাজলেই তাড়াতাড়ি হোস্টেলে এসে দুপুরের খাবার খেয়েই আবার ডিসেকশন রুমে দৌড়াতাম। ঐ সময়টাতে আমাদের শয়নে, স্বপনে, চিন্তা চেতনায় সবসময় হার্ট, লাংগস, লিভার, স্টোমাক আরো কত কী থাকতো! বিছানার পাশে ফিমার, হিউমেরাস, স্কাল –সব সময় গড়াগড়ি খেতো। একদিন, দুপুরে ডিসেকসন রুম থেকে এসে ডাইনিং-এ খাবার খাচ্ছিলাম, একটু পরে হাতের আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে দেখি, নখের ভিতরে ভিসেরার মাংশ ঢুকে আছে! হায় রে! পরীক্ষার চিন্তায় খাওয়ার আগে ভালোভাবে হাতও ধোয়া হয় নি!

এনাটমি ভাইভাতে এক বোর্ডে ইন্টারন্যাল ছিলেন হাই ফকির স্যার, অন্য বোর্ডে ইন্টারন্যাল ছিলেন দ্বিজেন স্যার। এক্সটারন্যাল যারা এসেছিলেন, তারা দুইজনেই আমাদের স্যারের ছাত্রতুল্য ছিলেন। পরীক্ষার প্রথমেই আমাদের মাইক্রোস্কোপে স্লাইড আইডেন্টিফিকেশন ছিলো। আমরা যখন স্লাইড দেখবো, তখনই বিদ্যুৎ চলে গেলো। এক্সটারন্যাল বললেন, মাইক্রোস্কোপ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে। আমরা সেটাই যখন করতে যাচ্ছিলাম, হাই ফকির স্যার আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে নিষেধ করলেন। এক্সটারন্যালকে বললেন, বিদ্যুৎ না থাকলে কিভাবে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে স্লাইড দেখবে? আমরা সবাই বুঝতে পারলাম, হাই ফকির স্যার বাসর রাতেই বিড়াল মারলেন। ভাইভার সময় উনিই সব প্রশ্ন করতে লাগলেন। রিয়াদের ভাইভার সময় এক্সটারন্যাল একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, বইতে উত্তর ছিলো ছয়টি। রিয়াদ চারটি বলার পর আর বলতে পারছিলো না, এক্সটারন্যাল বার বার বলতে লাগলেন, ‘আর?আর?’ এবার হাই ফকির স্যার রিয়াদকে চুপ থাকতে বললেন, এক্সটারন্যালের দিকে ঘুরে বললেন, ‘আপনিই বলেন, আর কি কি আছে?’ এক্সটারন্যাল বাকী দুইটা বলার পর হাই ফকির স্যার এক্সটারন্যালের মতো করে বার বার বলতে লাগলেন, ‘আর?আর?’ এবার এক্সটারন্যালের চুপ থাকার পালা। স্যার আরো তিন-চারটা উত্তর বলার পর এক্সটারন্যালকে বললেন, ‘আপনি বোধহয় জানেন না, এম বি বি এস লেভেলে কীভাবে পরীক্ষা নিতে হয়। আপনি এক কাজ করুন, আমি পরীক্ষা নিচ্ছি, আপনি শিখুন। শেখা হয়ে গেলে আগামী বছর থেকে প্রশ্ন করতে পারবেন’। দ্বিতীয় দিনেও যখন এক্সটারন্যাল প্রশ্ন করার সুযোগ পেলেন না, উনি দ্বিজেন স্যারের বোর্ডে গিয়ে স্যারকে সমস্তকিছু খুলে বললেন। সব শুনে দ্বিজেন স্যারের উত্তর ছিলো, ‘হাই ফকির স্যার যখন আপনাকে শিখতেই বলেছেন, তাহলে এই বছর আপনি প্রশ্ন করাই শিখেন! আগামী বছর থেকেই পরীক্ষা নিয়েন’। পরীক্ষার বাকী দিন গুলোতে এক্সটারন্যাল আর কোনো প্রশ্নই করতে পারেন নি।

প্রফ পরীক্ষা শেষ হবার পর রেজাল্টের আগে আমরা প্রায় দুই মাসের মতো সময় পেলাম। এই সময়টাতে আম্মুর প্ররোচনায় আমি এক চিল্লার নিয়তে তাবলীগ জামাতে যোগ দিয়ে সিলেটে চলে গেলাম। সেটা আরেক কাহিনী। চিল্লা পুরোপুরি শেষ করতে পারলাম না, বাসায় চলে এলাম। তারপর থেকে রেজাল্টের জন্য অধীর অপেক্ষা।

রেজাল্টের তিন চার দিন আগে আমরা খবর পেলাম মনোয়ার সবগুলো বিষয়েই খারাপ করেছে, ফয়েজ সবগুলোতেই (শোভার সাথে পরীক্ষার সময় রাত দিন ফোনালাপ করা সত্ত্বেও) পাশ করেছে। আমি, মাসুদ ফয়েজদের বাসায় গিয়ে পাশ করার খাওয়া-দাওয়া করলাম আর মনোয়ারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলাম। দুইদিন পর খবর পেলাম আজ রেজাল্ট দিবে। আমরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু রেজাল্ট আর দিচ্ছে না। এমন সময় আব্বু রেজিস্ট্রি অফিসে আসলো, ফয়েজ যেহেতু ওর রেজাল্ট আগে থেকেই জানতে পেরেছে, তাই আব্বুকে শুধুমাত্র আমার আর মাসুদের রোল নম্বর দিলাম। আব্বু সোজা রেজিস্ট্রারের রুমে ঢুকে একটু পরে বাইরে এসে জানিয়ে দিয়ে গেলো আমরা দুই জনই পাশ করেছি, আর অফিসিয়াল রেজাল্ট আজ দিবে না, তিনদিন পরে দিবে। যারা সেখানে উপস্থিত ছিলো, তাদের সামনে দিয়ে তা তা থৈ থৈ, তা তা থৈ থৈ করতে করতে বাইরে চলে আসলাম।

তিনদিন পর অফিসিয়াল রেজাল্ট দিলো। আমি আর মাসুদ যথারীতি পাশ করে গেলাম। ফয়েজের রেজাল্ট পুরোপুরি উল্টে গেলো, শোভার অবস্থাও ফয়েজের মতো হলো। কার্লি মিতু মনোয়ারকে ফোন করে বললো, ‘মনোয়ার, দুঃখ পাবার কিছু নেই, আগামীবার তুমি পাশ করবে, ইনশাআল্লাহ’। মনোয়ার স্মিত হাস্যে বললো, ‘একটু ভুল হয়ে গেছে মিতু, আগামীবার আমি সেকেন্ড প্রফেশনাল পরীক্ষা দিবো, কারণ এবার ফার্স্ট প্রফ আমি পাশ করে গেছি!’
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×