somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক বাংলাদেশী তরুণের কাহিনী- পর্ব-১

১২ ই জুলাই, ২০১৩ দুপুর ২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই লেখার একটি ভূমিকা থাকা দরকার। তরুণটির সঙ্গে আমার পরিচয় ফেসবুকে। অন্য আরো অনেকের মতো এই তরুণ একদিন আমাকে একটি মেসেজ পাঠালো। লিখেছিল, ‘সালাম নেবেন। অনেকদিন থেকেই আপনার কাছে লিখবো লিখবো ভাবছি কিন্তু লেখা হয়ে ওঠছে না। কি লিখবো আমি? লিখেতে গেলেই সব ব্যাক্তিগত বিষয় চলে আসে, গুছিয়ে লিখতে পারিনা। অযথা বাক্য ব্যয় হয়। দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাই, লেখা ঠিক হবে কিনা।’

মানুষের কথা শোনার আগ্রহ আমার বরাবরের। তারপর তার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়। এখানে কিছুটা তুলে দিলাম। দেখুন তো, ছেলেটি বর্তমান তরুণ সমাজের প্রতিনিধি কিনা?

‘ক্লাশে আমি ছিলাম ফার্স্টবয়। গ্রামের স্কুল। নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় বাড়িতে আমাকে সহায়তা করার মতো কেউ ছিল না। শিক্ষকের সহায়তাও খুব পেতাম না। নিজের চেষ্টাতেই লেখাপড়া করতে হতো। আমার মনে আছে স্কুলে পরে যাওয়ার মতো আমার ভালো কোন জামা ছিলনা। দ্বিতীয় শ্রেণীতে যেদিন ফলাফল ঘোষণা অনুষ্ঠান হবে সেদিন আমি আমার সমবয়সী মামাতো ভাইয়ের শার্ট ধার করে পড়ে স্কুলে গিয়েছিলাম। আমাদের স্থানীয় এমপি সেদিনের সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। ফলাফল ঘোষণার সময় সবার আগে আমার নাম ঘোষণা করলেন স্যার। এমপি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি হয়েছো? এতো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে, চট করে উত্তর দিতে পারিনি।

২০০২ সালে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে জিপিএ ৪ পেয়ে এসএসসি পাস করি। ওই বছরই আমাদের গ্রামের কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলো। কলেজ কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার কাছে নিজের ইচ্ছা বিসর্জন দিতে হলো। আমাকে ভর্তি করা হলো বিজ্ঞান বিভাগে। আমার ইচ্ছা ছিলো ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়ার। আমার বয়সী অনেকের মতো আমিও ভুল করলাম। পড়াশোনার সাথে তাল মেলাতে না পারায় প্রথমবারে তো এইচএসসি পাসই করতে পারলাম না। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে পাস করলেও ভালো কোথাও ভর্তি হওয়ার মতো যোগাত্য থাকলো না। শেষে এক বন্ধুর দেখাদেখি সরকারি বাঙলা কলেজে ভর্তি হলাম ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। ছোটবেলা থেকে ইংরেজির প্রতি ঝোঁক ছিল। যাই হোক, তিন বছরের কোর্স শেষ করতে জীবনের সাতটি বছর হারিয়ে গেলো। শুরুটা কিন্তু ভালোই করেছিলাম। কিন্তু তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় এক মানসিক চাপে পড়ে যাই।

আমার বাবা বাড়িতে গরু পালতেন। ২০০৬ সালের দিকে বাবা হাটে গরু কিনতে গিয়ে অজ্ঞান পার্টির খপ্পড়ে পড়েন। বাবাকে পাঁচ দিন হাসপাতালে রেখে সুস্থ করতে হয়। কিন্তু তখনো আমরা জানি না বাবার শরীরের মধ্যে কেমিকেলের বিষক্রিয়ায় কতো বড় ক্ষতি হয়েছে। ঘটনাটি ধরা পড়ল ২০০৮ সালে। অজ্ঞান হওয়ার ওই ঘটনার পর বাবা পেটে একটু একটু ব্যথা অনুভব করতেন। কিন্তু বিষয়টিকে তিনি গুরুত্ব দেননি। ২০০৮ সালে মাঝামাঝি তিনি গুরুতর অসুস্থ হলে এলাকার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কোন রোগ ধরা পড়েনি। কিন্তু ডাক্তারদের সন্দেহ হলো। তারা বায়োপসি টেস্ট করানোর জন্য ঢাকায় রেফার করলেন। এখানে এসে বাবার অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার ধরা পড়লো। অ্যাডভান্স স্টেজ। তখন মিরপুর থেকে বাড়িতে ফিরলাম। কারণ বড় দুই ভাই তখন মধ্যপ্রাচ্যে দক্ষ শ্রমিকের কাজ করেন। অসুস্থ বাবাকে দেখার মতো কেউ নেই। আমিই তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই।

অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার হলো ক্যান্সারের মধ্যে ভয়াবহতম ক্যান্সার। এধরণের রোগীকে চিকিৎসা না করালে রোগী ভয়ংকর যন্ত্রণা পেয়ে থাকেন। বাবাকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে নিয়ে দৌড়ানো শুরু করলাম । অনেক অভিজ্ঞতা হলো আমার। অসহায় রোগীদের নিয়ে ডাক্তার ও ক্লিনিককের মালিকরা কিরকম ব্যবসা করে তাও দেখলাম। দেখলাম জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালে রোগীদের কিরকম সেবা দেয়া হয়। বাবাকে আমি সেখানে একবারই নিয়েছিলাম। আমার বড় দুই ভাই-ই তখন মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশে ভালো অবস্থানে কাজ করেন। ওনাদের পাঠানো টাকায় বাবার চিকিৎসা হয়েছে। তারপর ধারও করতে হয়েছে। এমনও হয়েছে বাবাকে হাসপাতালে রেখে আমি তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিতে গিয়েছি। তার শরীরের অন্যকোন রোগ ছিলনা। ক্যান্সারটাও হতো না যদি তাকে অজ্ঞান পার্টি তাকে ক্যামিকেল না খাওয়াতো। বাবাকে হারালাম। ৬৫ বছর বয়সে আমার বাবা মারা যান ২০০৯ সালের মার্চে।

আমার তৃতীয় বর্ষের ফলাফল খারাপ হলো । সেকেন্ড ক্লাশ থেকে অনেক মার্কস পিছিয়ে ছিলাম। মানোন্নয়ন দিলাম, তাতেও ব্যবধান কিছু রয়েই গেলো। এরপর আর শহরে ফিরে যেতে পারিনি। শহরে আমি যে অবস্থান তৈরি করেছিলাম তা আর অবশিষ্ট ছিলনা। শহরে থাকা-খাওয়ার যে খরচ তা পরিবার থেকে বহন করার সামর্থ্য আর অবশিষ্ট ছিল না। কারণ ততোদিনে অনেক টাকা ঋণ জমে গেছে। পরবর্তী দুই বছর গ্রামেই থেকে গেলাম।

ফাইনাল পরীক্ষার ৬/৭ মাস আগে চলে এলাম সাভারে, অনেকটা নিজের খরচ নিজে চালানো তাগিদে। এখন মনেহয় সিদ্ধান্তটা বোধহয় ভুলই ছিল। এখানে এসে নতুন চ্যালেঞ্জ। তিনটা প্রাইভেট টিউশন করতে হতো আমার সব খরচ জোগানোর জন্য। এদের সব কটিই ছিল বাচ্চা। এদেরকে সপ্তাহে ছয় দিনেই পড়াতে হতো। এদের পড়িয়ে, এবং সাভার হতে কলেজে গিয়ে ফাইনাল ইয়ারের ক্লাশ করে এবং নিউ মার্কেটে স্যারের বাসায় সহায়ক পড়া পড়তে গিয়ে আমার নিজের পড়ার সময় থাকতো না। যে ব্যাচেলর হাউজে থাকতাম সেটা ছিল ব্যবসায়ীক ভিত্তিতে মালিকানায় পরিচালিত মেস। ওখানে হোটেলের মতো খাবার অর্ডার দিয়ে খেতে হতো। ওখানকার খাবারের মান এতোই খারাপ ছিল যে প্রথম দুই মাসের মধ্যেই আমি শুকিয়ে গিয়েছিলাম, টাকার অভাবে না খেয়েও থেকেছি অনেক রাতে। তারপর অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পরীক্ষা দিতে পারলাম। কিন্তু পরীক্ষার রুটিন ছিল অভূতপূর্ব! সবাই বলাবলি করছিল এমন রুটিন নাকি কখনো অনার্স পরীক্ষার হয়নি। যাই হোক রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে প্রায় ২ ঘন্টা বাসে বাদুর ঝোলা হয়ে অনেক জ্যাম পেরিয়ে সাভার হতে তিতুমীর কলেজে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার কাজটি সারলাম। এটা যে কতো কঠিন ব্যাপার ছিল তা কেবল মাত্র ভুক্তভোগীই জানবে, আর কেউ বুঝবে না।

আমার রেজাল্ট এখনো হয়নি। আমি আশাবাদী সেকেন্ড ক্লাশ হয়ে যাবে। বাকিটা উপরওয়ালা জানেন। এখন জীবনটাকে খুব অর্থহীন মনে হয়।’ (চলবে)
Click This Link
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×