somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আরজ আলী মাতুব্বর , বাংলার সক্রেটিস

৩০ শে অক্টোবর, ২০১১ রাত ৮:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আরজ আলী মাতুব্বর(১৯০১ - ১৯৮৬) (১৩০৭-১৩৯২ বাংলা) স্ব-শিক্ষিত দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং লেখক। জগত ও জীবন সম্পর্কে নানামুখী জিজ্ঞাসা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে যা থেকে তাঁর প্রজ্ঞা, মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।
বরিশাল শহর থেকে ৭/৮ কিলোমিটার দূরে লামচরি নামক গ্রামে বাংলা ১৩০৭ সনের ৩রা পৌষ এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে আরজ আলী মাতুব্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম এন্তাজ আলী মাতুব্বর। আরজ আলী মাত্র চার বছর বয়সে তাঁর বাবাকে হারান। এর পরে তাঁদের পরিবারটি দেনার দায়ে বসতবাটি ও জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। আরজ আলী নিজ গ্রামের মুন্সি আবদুল করিমের মক্তবে সীতানাথ বসাকের কাছে 'আদর্শলিপি' পড়তেন। দরিদ্রতার কারণে তাঁকে মক্তব ছাড়তে হয়। এরপর তিনি কৃষিকাজে নিয়োজিত হন। সাথে সাথে তিনি নিজের ঐকান্তিক চেষ্টায় লেখাপড়া শিখতে থাকেন। কৃষিকাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি জমি জরিপ বা আমিনের কাজ শিখে নেন। এরপর জমি জরিপের কাজকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। এক সময় মানুষ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগলে তিনি এই বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নিজস্ব ধরণের চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন।
ঠিক গ্যালিলিওর মতো আরজ আলী মাতুব্বর পেশিশক্তির শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে তার চিন্তা-ভাবনার ফসল লেখাগুলো গ্রন্থিত করে বই আকারে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা বরিশালের বাইরে তার পরিচিতি এবং খ্যাতি এনে দেয়। কুসংস্কার এবং গোঁড়ামির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তিনি যেভাবে মুক্তচিন্তার চর্চা করেছেন এবং স্বাধীনভাবে দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্ম বিষয়ে মতামত রেখেছেন তার সঙ্গে তুলনা চলে মুক্তবুদ্ধির চর্চায় উচ্চশিক্ষিত জ্ঞানী-গুণীদের সাধনার। লেখাপড়ায় এবং সামাজিক অবস্থানে তাদের সঙ্গে আরজ আলী মাতুব্বরের ছিল যোজন যোজন দূরত্ব।
আরজ আলী বলেছেন, ‘বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে, কিন্তু জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই। জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন। সেই অসীম জ্ঞানার্জনের মাধ্যম স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তা হচ্ছে লাইব্রেরী।’ লাইব্রেরি ছিল তাঁর জীবনের প্রধান আনন্দক্ষেত্র। অন্যের নামে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়েছেন। একপর্যায়ে এসে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ওয়ারিশদের বুঝিয়ে দিয়ে কাজ করেছেন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার জন্য। এমনকি নির্মাণের খরচ কমানোর জন্য লাইব্রেরি নির্মাণে শারীরিক অংশগ্রহণ করেছেন। এই লাইব্রেরি যাতে তাঁর মৃত্যুর পরও টিকে থাকে, সে জন্য তাঁর উদ্বেগ ছিল এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও তিনি গ্রহণ করেছেন। লিখিতভাবে তহবিল, লাইব্রেরি ও যাবতীয় অনুষ্ঠানাদির পরিকল্পনা জানিয়ে গেছেন। মৃত্যুর পর নিজের অবশিষ্টাংশ যাতে মানুষের কাজে লাগে, সে ব্যবস্থাও করেছেন। মৃতদেহ বরিশাল মেডিকেল কলেজে দান করেন; চোখ দুটি চক্ষু ব্যাংকে।
আরজ আলী মাতুব্বরকে আজীবন বিশেষভাবে ভাবিত করেছে মানুষের দৈনন্দিন দুর্ভোগ এবং সে সম্পর্কে মানুষের নিজস্ব ব্যাখ্যা, সমাজে অধিপতি-চিন্তায় সেসব দুর্ভোগ আর অপমান যুক্তিযুক্ত করবার চেষ্টা। এসব বিষয় অনুসন্ধান করতে গিয়েই তিনি ক্রমেই আরও গভীর দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। নারীর অবস্থান, নারীর অধিকার, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের ‘বৈধতা’, সন্তানের ওপর অধিকার সম্পর্কে সব ধর্মেই কড়া বিধিবিধান আছে। এসব বিশ্বাস ও প্রথা, অন্য আরও অনেক আইনের মতো কত নারীর জীবনকে বিষময় ও বিপর্যস্ত করেছে, কত নারীকে ভয়াবহ অপমানের মধ্যে ছুড়ে ফেলেছে—তার পরিসংখ্যান বের করা অসম্ভব। আরজ আলী এসব বিশ্বাস বিধিবিধানের নানা অসংগতি নিয়েও অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। সে জন্য এই নিপীড়িত নারী-পুরুষেরাই ছিল তাঁর প্রধান আশ্রয়।
কিন্তু শহুরে মধ্যবিত্ত কিংবা গ্রামীণ ক্ষমতাবান কারও কাছেই আরজ আলী মাতুব্বর গ্রহণযোগ্যতা পাননি। কারণ, এ দেশে মধ্যবিত্ত কিংবা বিদ্বৎসমাজ যেভাবে গড়ে উঠেছে, সেখানে ভক্তি দিয়ে জগৎসংসার দেখাতেই তাঁর স্বস্তি, তাতেই তাঁর আসক্তি। এই ভক্তি যেমন সৃষ্টিকর্তা কিংবা ধর্মের প্রচলিত বয়ানের প্রতি, তেমনি এই ভক্তি প্রচলিত বিশ্বব্যাংকীয় উন্নয়ন দর্শনের প্রতিও। দুটোই তাঁর আশ্রয়। এই আশ্রয়ের খোলসে নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য তাঁর কাতরতা সমাজ স্থবিরতার প্রধান কারণ। প্রশ্ন তাই তাঁর জন্য বিপদের কারণ, অস্বস্তির কারণ। আরজ আলী মাতুব্বর তাই তাঁদের কাছে ভীতিকর। আরজ আলী মাতুব্বরের প্রশ্নের যে শক্তি, তা নিজে নিজে তৈরি হয়নি, হয়েছিল ‘পা ভাঁজ করে শোয়ার অবস্থা’ নিয়েও মহাবিশ্ব, মানুষ ও জগতকে মুক্তভাবে দেখার সক্ষমতা থেকে, সামাজিক কর্তৃত্ব এবং মতাদর্শিক আধিপত্যকে অস্বীকার করবার অব্যাহত লড়াই থেকে।
প্রকাশিত গ্রন্থ

ম্যাকগ্লেসান চুলা (১৯৫০)
সত্যের সন্ধান (১৯৭৩)
সৃষ্টি-রহস্য (১৯৭৮)
স্মরণিকা (১৯৮২)
অনুমান (১৯৮৩)
মুক্তমন (১৯৮৮)
সম্মাননা

বাংলা একাডেমী কর্তৃক আজীবন সদস্য পদ প্রদান এবং বাংলা ১৩৯২ সালের ১লা বৈশাখ নববর্ষ সংবর্ধনা জ্ঞাপন।
হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৩৮৫ ব.)
উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী কর্তৃক বরণীয় মনীষী হিসেবে সম্মাননা (১৩৯২ ব.)
তথ্যসূত্র :
আরজ আলী মাতুব্বর ,আনু মুহাম্মদ
আরজ আলী মাতুব্বর - উইকিপিডিয়া
কেন আরজ আলী প্রাসঙ্গিক? :: হাসনাত আব্দুল হাই
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পুরোনো ধর্মের সমালোচনা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেই নতুন ধর্মের জন্ম

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:১৫

ইসলামের নবী মুহাম্মদকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে এক বছরের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে প্রবেশনে পাঠানোর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×