somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবুর বাড়ি: কালের সাক্ষী প্রাচীন এক জমিদার বাড়ি

২৮ শে অক্টোবর, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২৭ অক্টোবর, ২০১১। বৃহস্পতিবার।

সকাল এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট।

ছোট্ট একটি বাঁশের পুল পার হয়ে ছবির মতো যে সুন্দর যে গ্রামটিতে পা রাখলাম, তার নাম ’পাইলগাঁও’। শান্ত স্নিগ্ধ গ্রামটির আঁকা-বাঁকা মেঠো পথ ধরে কিছুদূর এগুতেই হাতের বামে একটি টং দোকান পড়লো। সেখানে বিশ্রাম নেবার সময় মেঠো রাস্তার অপর পাশে দূরে একটি প্রাচীন বাড়ি চোখে পড়লো। দোকানীকে জিজ্ঞেস করাতে সে বললো, ওটা '’বাবুর বাড়ি’'। ’'বাবুর বাড়ি'?’ প্রশ্নবিদ্ধচোখে তার দিকে তাকাতেই সে জানালো এই বাড়িটি তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার জমিদার ’রাজেন্দ্রবাবুর জমিদারবাড়ি’।

বাবুর বাড়ি

জমিদার ’রাজেন্দ্রবাবুর জমিদারবাড়ি’

সিলেট থেকে সকাল ৮ টায় রওনা হয়ে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার পাইলগাঁও ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত 'পাইলগাঁও' এই গ্রামটিতে এসেছি কিছু কাজ হাতে নিয়ে। আমার ধারণাই ছিলনা যে, এখানে এরকম একটি বিশাল ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি রয়েছে। তাই দেরি না করে হাতের কাজগুলো দ্রুত শেষ করে রওনা হলাম বাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।

বাবুর বাড়িতে ঢোকার মুখে বৈঠকখানার বাড়িটি

বাবুর বাড়ির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
স্থানীয় লোকমুখে শোনা বাবুর বাড়ির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায় এই বাড়িটির বয়স আনুমানিক ৩০০ বছরেরও বেশি। তৎকালীন প্রতাপশালী জমিদার ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী এ বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে বাড়িটি '’রাজেন্দ্রবাবুর বাড়ি’ নামে'ই পরিচিতি লাভ করে এবং সংক্ষিপ্তভাবে '’বাবুর বাড়ি’' নামেই এখন এটি স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক পরিচিত।

বৈঠকখানার ঘর

ধূলো আর জংলায় ভরা এই ঘরগুলো শত বছর আগে মানুষের পদচারণায় মুখর ছিল

বৈঠকখানার একাংশ

বৈঠকখানার শ্যাওলা পড়া স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল
কথিত আছে, জমিদার ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর পূর্বপুরুষগণ বানিয়াচং-এর আলিরাজ জমিদারের ওখানে কাজ করতেন এবং পরবর্তীতে তাঁরা পাইলগাঁওতে এসে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। ব্রজেন্দ্রবাবুর পূর্বপুরুষদের যাদের নাম পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে রয়েছেন দুই ভাই - রসময় চৌধুরী এবং সুকুমার চৌধুরী। সুকুমার চৌধুরীর একটি মাত্র ছেলে ধীরেন্দ্র চৌধুরী। রসময় চৌধুরীর তিন ছেলে এবং এক মেয়ে:
১. ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী
২. রাজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী
৩. হরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী
৪. গৌরী চৌধুরী

বৃহত্তর সিলেট বিভাগের হলদিপুর, পাইলগাঁও, জগন্নাথপুর এবং বানিয়াচং এলাকা নিয়ে রাজেন্দ্রবাবুর বিশাল জমিদারী ছিল। এই বাড়ি থেকেই তিনি জমিদারী পরিচালনা করতেন। এই বাড়িটি তৈরি করতে ১৩ বছর সময় লেগেছিল। এখানে মোট বাড়ির সংখ্যা আসলে তিনটি। প্রথমটি বৈঠকখানা, তারপরেই কাচারীঘর এবং একদম ভিতরে অন্দরমহল। অন্দরমহলের পাশেই একটি জেলখানা রয়েছে। পুকুর রয়েছে দু’টি। একটি বৈঠকখানার বড়বাড়িটির সামনেই। আরেকটি ভিতরে অন্দরমহলের পিছনদিকে। অন্দরমহলের পাশেই রয়েছে রান্না করার জন্যে সুবিশাল এক রান্নাঘর। বৈঠকখানার বড়বাড়িটির সামনে রয়েছে একটি মন্দির। অযত্ন আর অবহেলায় মন্দিরটি ঘন গাছপালায় ঢেকে গিয়েছে। এখানে এখন বড় বড় সাপ এবং অন্যান্য সরীসৃপের বসবাস। সাহস করে তাই আর মন্দিরের ভেতরটায় ঢুকলামনা।

জঙ্গলে ঢাকা মন্দির

ধূলার আস্তরণে ঢাকা এ ঘরগুলো এখন কেবলই স্মৃতি

গাছের শেকড় আর লতাপাতা এভাবেই আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বাবুর বাড়িটিকে

বৈঠকখানার দোতলায় যাবার সিঁড়ি

লোকমুখে শোনা যায়, রাজেন্দ্রবাবুর একটি মাত্র মেয়ে ছিল যিনি অজানা রোগে ভুগে মারা যান। তারপর দেশবিভাগের সময় বাবু এই জমিদারী ছেড়ে দিয়ে একেবারের জন্যে ভারতে চলে যান। বর্তমানে সিলেটপ্রবাসী জনাব আজমল হোসেন এই বাড়ি এবং বাড়ি সংলগ্ন জমি-জমা সরকার থেকে লীজ নিয়েছেন। অন্দরমহলের বাড়িটিতে বর্তমানে তিনটি পরিবার বাস করছে যাদের নিজস্ব কোন বাড়িঘর নেই।

অন্দরমহল

অন্দরমহলের বাইরের অংশ

অন্দরমহলের পিছনের অংশ

অন্দরমহলের ছাদ

অন্দরমহলের পাশে পরিত্যাক্ত রান্নাঘর

পাইলগাঁও গ্রামে জমিদার রাজেন্দ্রবাবু '’পাইলগাঁও ব্রজনাথ উচ্চবিদ্যালয়'’ নামে নিজের নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। শোনা যায়, তাঁর স্ত্রী রাণীর নামে রাণীগঞ্জ বাজারের নামকরণ হয়েছে। বর্ষায় হাওড় এ অঞ্চলে চলাচলের জন্য তাঁর নিজস্ব পানশী নৌকা ছিল। আর শুকনার সময় তিনি ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করতেন।

কাচারী বাড়ি

কাচারীর ভিতরের অংশ

দেবীকে ভোগ দেওয়া হতো এ স্থানটিতে

জেলখানায় প্রবেশপথ

জেলখানার অন্ধকার কুঠুরী

জেলখানার কুঠুরী

কিভাবে বাবুর বাড়িতে যাওয়া যাবে?
ঢাকা থেকে গ্রীনলাইনের এসি বাসে রাত সোয়া বারোটায় উঠলে ভোর ৬ টায় সিলেটের হুমায়ূনরশিদ চত্ত্বরে নামিয়ে দেবে। সিলেটের কীন ব্রিজের (পুলের মুখ) ওপার থেকে জগন্নাথপুরগামী সিএনজিতে ৫ জনের শেয়ারে জনপ্রতি ৮০ টাকা করে সরাসরি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার পৌরপয়েন্টে পৌঁছতে প্রায় ২ ঘন্টা লাগবে। আর রিজার্ভ সিএনজি ৪০০ টাকার কমে যাবেনা। জগন্নাথপুর বাসকাউন্টার থেকেও জনপ্রতি ৪৫ টাকা করে জগন্নাথপুর উপজেলায় যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে প্রায় আড়াইঘন্টা সময় লাগবে। জগন্নাথপুর পৌঁছানোর পর রিক্সাযোগে পৌরপয়েন্টে পৌঁছাতে হবে।

পৌর পয়েন্ট থেকে রানীগঞ্জের রাস্তায় রিজার্ভ (১২৫ টাকা) বা শেয়ার সিএনজিতে (২০ টাকা জনপ্রতি) হাবিবপুর ফেরিঘাট পার হয়ে শিবগঞ্জ বাজারে পৌঁছাতে প্রায় ৪০ মিনিট লাগবে। সেখান থেকে ডিঙ্গি নৌকায় ইটাখোলা নদীতে ঘন্টাখানেক যাবার পর একটা ঘাটে মাঝি নামিয়ে দেবে যেখান থেকে আরও প্রায় ৪০ মিনিট পথ হেঁটে তারপর পাইলগাঁও গ্রামে পৌঁছাতে হবে। ফেরার সময়ও একই রাস্তা। হাতের ডানপাশে পড়বে কুশিয়ারা নদী। তবে এবার ঘাটে ডিঙ্গি নৌকা না পাওয়া গেলে প্রায় একঘন্টার মতো হেঁটে শিবগঞ্জ বাজারে আসতে হবে। সেখান থেকে শেয়ার অথবা রিজার্ভ সিএনজিতে জগন্নাথপুর।


শেষকথা:
বাবুর বাড়িতে বর্তমানে অবস্থানরত পরিবারদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, মাঝে মাঝে এ বাড়িতে নাটক কিংবা সিনেমার শ্যুটিং এর জন্যে লোকজন ঢাকা থেকে আসে। কিন্তু প্রায় পরিত্যাক্ত এ বাড়িটিকে রক্ষায় কোন উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। ধুলো-ময়লা আর জংলায় ভরে যাওয়া ইতিহাসের সাক্ষী বাবুর বাড়িটিকে রক্ষায় তাই আমাদের মাননীয় সরকার দৃষ্টি দেবেন এবং প্রত্মতাত্ত্বিক এ সম্পদটিকে রক্ষায় তারা এগিয়ে আসবেন - এই আশাবাদ ব্যাক্ত করছি।

মাটির মানুষের তৈরি মাটির বাড়ি: স্থাপত্য শিল্পের এক অবিশ্বাস্য নিদর্শন
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০১১ রাত ৯:১৭
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪

বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×