একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। আজ বৃহস্পতিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় ঘোষণা করেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার এটি চতুর্থ রায়।
২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২ অক্টোবর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়। ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ৪ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ গঠন করেন।
২ জুলাই ২০১২ সালে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৮ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন এবং আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন মোট পাঁচজন। উভয় পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ৩১ মার্চ ২০১৩। আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় ২ এপ্রিল ২০১৩ আর তা শেষ হয় ১৫ এপ্রিল ২০১৩। যুক্তি উপস্থাপন শেষে ১৬ এপ্রিল ২০১৩ সালে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষাধীন রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
আজ বৃহস্পতিবার ৯ মে ২০১৩ তারিখে এই মামলার রায়। আজ সকাল ১১টা ১০ মিনিটে এজলাসে আসেন বিচারপতিরা। ১১টা ৫ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় কামারুজ্জামানকে তোলা হয়। ১১টা ১৮ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সূচনা বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আজকের এ রায়টি ২১৫ পৃষ্ঠার। এতে ৬৫১টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এ রায়ের ৬২ পৃষ্ঠার সারাংশ পড়া হবে। ৬২ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত এ রায়ের প্রথম অংশ পড়বেন বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। দ্বিতীয় অংশটি পড়বেন বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও রায়ের তৃতীয় অংশটি পড়বেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নিজে।
কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা সাত অভিযোগ:
১. একাত্তরের ২৯ জুন তাঁর নেতৃত্বে আলবদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতি থানার রামনগর গ্রামের বদিউজ্জামানকে অপহরণ ও নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে।
২. কামারুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করেন।
৩. ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই কামারুজ্জামানের পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে আলবদর ও রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায় ও নারীদের ধর্ষণ করে।
৪. কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গুলি করে শেরপুরের গোলাম মোস্তফাকে হত্যা ও আবুল কাসেমকে আহত করে।
৫. মুক্তিযুদ্ধকালে কামারুজ্জামান ও সহযোগীরা শেরপুরের লিয়াকত আলী ও মুজিবুর রহমান পানুকে অপহরণ ও নির্যাতন করে।
৬. একাত্তরের নভেম্বরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদররা টুনু ও জাহাঙ্গীরকে আটকের পর নির্যাতন করে এবং টুনুকে হত্যা করা হয়।
৭. কামারুজ্জামান ও আলবদরের সদস্যরা ছয়জনকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
মামলার পাঁচ অভিযোগ প্রমাণিত:
এই মামলার রায় পড়া শেষে আদালত জানায়, আদালত জানান, কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণের অভিযোগের মধ্যে ১, ২, ৩, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
মামলার চূড়ান্ত রায়:
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা ও নির্যাতনের পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মাননীয় বিজ্ঞ আদালত মোহাম্মদ কামরুজ্জানকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে।
চূড়ান্ত রায়ে আদালত ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে সোহাগপুরের গণহত্যা এবং গোলাম মোস্তফা তালুকদার নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনায় ফাঁসির আদেশ দিয়ে বিচারক বলেন, “সে যেভাবে এসব অপরাধ ঘটিয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি না দিলে সুবিচার হবে না।” তাই ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার আদেশ দেওয়া হল।
এছাড়া ১ ও ৭ নম্বর অভিযোগে বদিউজ্জামানকে হত্যা এবং টেপা মিয়ার ছেলেসহ ৫ জনকে হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত।
আর ২ নম্বর অভিযোগে শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের ঘটনায় তাঁকে আদালত দশ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন।
এছাড়া রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয় যে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরাই আল বদর, আল শামস নামের বিভিন্ন সশস্ত্র দলে যোগ দিয়ে সারা দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৫:১৩