somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কন্টেইনারে 'ভয়ঙ্কর' ১০ দিন

২৩ শে অক্টোবর, ২০১১ ভোর ৬:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পাশেই পড়ে ছিল আল আমীনের লাশ; সরিয়ে দেয়ারও শক্তি ছিল না শরীরে। হাড় আর চামড়া ছাড়া গায়ে যেন কিছু নেই। মনে হচ্ছিল- মৃত্যুর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি-- 'দুর্ঘটনাক্রমে' সিঙ্গাপুর ঘুরে আসা বন্দর শ্রমিক দ্বীন ইসলাম বলছিলেন তার সেই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা।

বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা পৌঁছানোর পর চট্টগ্রামে ফিরে শুক্রবার দুপুরে পাহাড়তলি এলাকার বিশ্ব কলোনিতে নিজের বাসায় বসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেই অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন তিনি।

গাঁজা সেবনের পর ঘুমানের জন্য সহকর্মী আল আমীনকে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে রাখা একটি খালি কন্টেইনারে ঢুকেছিলেন দ্বীন ইসলাম। গত ১ এপ্রিল তাদের নিয়েই হানসা কালেডো নামের একটি জাহাজ সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করে।

এর পাঁচ দিন পর জাহাজটি সিঙ্গাপুর বন্দরে পৌঁছায়। কন্টেইনারটি আরো পাঁচ দিন ওই বন্দরে পড়ে থাকার পর বন্দরের পাসিং পানজার টার্মিনালের কর্মীরা আল আমীনের লাশ ও দ্বীন ইসলামকে জীবিত উদ্ধার করে।

পরে সিঙ্গাপুরের স্থানীয় বাংলা পত্রিকা 'বাংলার কণ্ঠে'র সম্পাদক এ কে এম মোহসীন ও কিছু প্রবাসী বাঙালি দ্বীন ইসলামকে নিজেদের হেফাজতে নেন। তাদের সহায়তায় বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ঢাকা পৌছান দ্বীন ইসলাম। রাতেই বড় ভাই মো. বেলাল মিয়ার সঙ্গে চট্টগ্রামে ফেরেন তিনি।

দ্বীন ইসলাম জানান, কনটেইনারের সেই ১০ দিনে শুধু একবার খানিকটা বৃষ্টির পানি পেয়েছিলেন, আর কিছুই জোটেনি। দিনের বেলায় কন্টেইনার রোদে উতপ্ত হয়ে উঠলে এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকা যেতো না। কিছুক্ষণ পরপর জায়গা বদলাতে হতো।

"মনে হয়নি শেষ পর্যন্ত বেঁচে ফিরতে পারবো। আল আমীনতো আমার সামনেই মারা গেল। আমি আবার নতুন জীবন পেয়েছি। সবাইকে নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে চাই।"

'কন্টেইনারে ঘুমাতে ঢুকেছিলাম'

চট্টগ্রাম বন্দরে শ্রমিক সরবরাহকারীদের (মাঝি) অধীনে অস্থায়ী ভিত্তিতে খাদ্যশষ্যবাহী জাহাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন দ্বীন ইসলাম। এই কাজ পেয়েছিলেন কন্টেইনারে আটকা পড়ার পাঁচ-ছয় মাস আগে। তবে প্রতিদিন কাজ থাকতো না।

"ওই দিন সকাল ৮ টার দিকে জেটিতে ঢুকি। সাথে আরো পাঁচজন। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ করার পর মজুরির ২৫০ টাকা নিয়ে আল আমীনসহ জেটির ভেতরে ক্যান্টিনে ভাত খাই। এরপর বন্দরের ভেতরে ঘোরাঘুরি করতে করতে দেখি রাত হয়ে গেছে।"

রাত ১২টার দিকে জেটিতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা দুজন। একটি কন্টেইনারটি খালি আর পরিষ্কার দেখে ঢুকে পড়েন ভেতরে।

ওই রাতে মাদক সেবনের বিষটি স্বীকার করে দ্বীন ইসলাম বলেন, "সঙ্গদোষে নেশা করতাম। আর করবো না।"

আল আমীনই ওই রাতে গাঁজা নিয়ে এসেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, "নিমতলা (বন্দর ভবনের পাশের এলাকা) থেকে গাঁজা কিনে এনেছিলো সে। আমি দুই পুরিয়া গাঁজা খেয়ে কন্টেইনারের ভিতর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।"

দ্বীন ইসলাম ও আল আমীন যখন গভীর ঘুমে, তখনই কন্টেইনারটির দরজা বন্ধ করে সিঙ্গাপুরগামী জাহাজে ওঠানো হয়।

অনাহারের দিনগুলো

ঘুম ভাঙার পর দ্বীন ইসলাম আবিস্কার করেন, কন্টেইনারের ভেতরেই তারা আটকা পড়েছেন।

"অন্ধকারে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আল আমীনকেও দেখতে পাচ্ছিলাম না। অন্ধকারে কথা বলে বুঝতে পারছিলাম আমীনও আছে। প্রায় আধ ঘণ্টা হাত দিয়ে কন্টেইনারের দেয়ালে ধাক্কাধাক্কি করি দুজনে। কিন্তু কেউ আসেনি।"

আল আমীন তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, তার আর বের হওয়া হবে না। কেন রাতে বাসায় ফিরে যাননি, তাই নিয়ে আফসোসও করেছিলেন।

তাদের কন্টেইনার ছিল জাহাজের ডেকের ওপরে। তার ওপরে আরো তিন সারি কন্টেইনার রাখা ছিল। আটকা পড়ার আনুমানিক তিন দিন পরে মারা যান আল আমীন।

"ও বলছিল, না খেয়ে মানুষ আড়াই দিন বাঁচে। মারা যাওয়ার আগে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। শুধু পানি খেতে চাইছিল, আর মা- বাবাকে ডাকছিল।"

এক সময় নাম ধরে ডেকেও আল আমীনের কোনো সাড়া পেলেন না দ্বীন ইসলাম। হাতড়ে হাতড়ে কাছে গিয়ে নিশ্বাস পরীক্ষা করে বুঝলেন, আল আমীন আর নেই।

"এতো দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম যে লাশটাও দূরে সরিয়ে রাখার শক্তি ছিল না। দুই দিন পর বৃষ্টি হয়। কন্টেইনারের ভেতর চুইয়ে পড়ে বৃষ্টির পানি। শব্দ শুনে শার্ট ভিজিয়ে সেই পানিই শুধু খেতে পেরেছি কয়েক ফোঁটা।"

আল আমীন মারা যাওয়ার পর নখ দিয়ে খুঁচিয়ে কন্টেইনারের দরজার পাশে লাগানো প্লাইউড সামান্য ফাঁক করেন দ্বীন ইসলাম। ওই ফাঁক দিয়েই বাইরে দেখার চেষ্টা করতেন, আর শ্বাস নিতেন জোরে জোরে।

সিঙ্গাপুর বন্দরে কন্টেইনার নামানোর সময় বুঝতে পেরে দুর্বল হাতে দেওয়ালে শব্দ করতে থাকেন দ্বীন। কিন্তু আশেপাশে অন্যান্য কন্টেইনার ওঠানামার শব্দে কেউ তা শুনতে পায়নি।

পাঁচ দিন পর বন্দরে পড়ে থাকা কন্টেইনারে আল আমীনের লাশ আর জীবিত দ্বীন ইসলামকে খুঁজে পান সিঙ্গাপুরের কর্মীরা। পুলিশ দ্বীন ইসলামকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সিঙ্গাপুরেই দাফন করা হয় আল আমীনের লাশ।

হাসপাতালে তিন দিনের মাথায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা দেখা করেন দ্বীন ইসলামের সঙ্গে। পরে স্থানীয় এক আমেরিকান নারীর বাসায় আশ্রয় পান বাংলাদেশি দ্বীন।

"বিশ্রাম নিয়ে আর খাওয়া-দাওয়া করে সুস্থ হতেই পাঁচ মাস কেটে যায়। সেখানকার বাংলাদেশিদের সহায়তায় সবজির দোকানে আর ভবন শ্রমিক হিসেবে কয়েক সপ্তাহ কাজও করেছি। একবার মনে হয়েছিল সিঙ্গাপুর খুব সুন্দর। থেকে গেলে ভালই হয়।"

ছেলেকে দেখতে যাবেন দ্বীন

কোনো স্থায়ী পেশা না থাকায় দুই বছর আগে ছেলে দিদারুলের জন্মের পরপরই দ্বীনকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যান স্ত্রী বিউটি। সেই মার্চ মাসে ছেলেকে দেখেছিলেন। দ্বীনের দেশে ফেরার খবর পেয়েও ফেরেনি স্ত্রী-সন্তান।

দ্বীন ইসলামের বড় ভাই বেলাল বলেন, "আমার ভাই কথা দিয়েছে, সে আর নেশা করবে না। তার সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজন একটা চাকরি।"

লেখাপড়া লাগে না- এমন একটা চাকরি দ্বীন ইসলামকে দিতে সরকারের কাছে আবেদন জানান বেলাল।

ছেলেকে ফিরে পেয়ে খুব খুশি দ্বীন ইসলামের মা শাহেদা বেগম আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবা শামসুল হক।

"আমার ছেলে ফিরে আসবে ভাবিনি। আল্লাহর ইচ্ছায় সে ফিরেছে," বললেন শাহেদা।

শ্বশুরবাড়ি লাকসাম গিয়ে বউ-ছেলের সাথে দেখা করতে চান দ্বীন ইসলামও।

"ওদের নিয়ে আসার চেষ্টা করবো। সবাইকে নিয়ে আমি এখন ভালো থাকতে চাই।" তথ্য সুত্রঃ
৯টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×