somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৈষ্ণব দর্শনঃ আবহমান বাংলার এক ভাববাদী মতবাদ।

২৪ শে মার্চ, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তিন কাঠের এই নৌকা খানি
গাঙ্গে গাঙ্গে চোঁয়ায় পানি
আমি কি দিয়া সেচিব নৌকার পানি রে
তুই সে আমার মন।।


জ্ঞান, কর্ম ও প্রেম এই তিনটি উপাদানকে বৈষ্ণব মতাবলম্বীগণ মানব সত্ত্বার মৌলিক উপাদান হিসেবে ধরে নিয়েছেন। অভাব বা প্রয়োজন বোধ থেকে আসে মানুষের কর্ম কিন্তু ঈশ্বর বা পরম সত্ত্বা অভাব বোধ থেকে মুক্ত তাই কর্ম দিয়ে পরম সত্ত্বার সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা ফলহীন। জ্ঞানের পথেও মানুষের রয়েছে ভিন্নতা। সীমাবদ্ধ ভাবনা থেকে যে জ্ঞান আসে তা দিয়ে পরম জ্ঞানের সন্ধান সম্ভব নয়। বাকী থাকে যে প্রেম তা মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে গোত্রে গোত্রে তার অনুভূতি অভিন্ন। যার কারণে প্রেমভক্তিই হতে পারে পরম সত্ত্বা অনুসন্ধানের উপযোগী ক্ষেত্র। আর এমন একটি ভিত্তিমূল থেকেই মূলত বৈষ্ণব দর্শনের উৎপত্তি।

ঋগ্বেদ থেকে নিঃসৃত এই মতাবাদ আবহমান বাংলায় সুপ্রাচীন একটি ধারা হলেও রামানুজের হাত ধরেই বৈষ্ণব দর্শন মূলত আধুনিক রূপ পেয়েছে এবং শ্রী চৈতন্যের হাত ধরে এটি পুর্ণ রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। বিগত দুইশত বছর ধরে অদ্যবধি বাঙ্গালীর ভাবনা মানসপটে চলে আসছে ভাবরসের এক প্লাবন দার্শনিক তর্ক বিতর্ক আলোচনা। আজ যেন তা গভীর ভাবে বাঙ্গালীর প্রাণের সাথে মিশ্রিত।

জাতি, কুল, শ্রেণী, জ্ঞান, কর্ম নয় প্রেমভক্তিই পারে আমাদের পরম সত্ত্বার সান্নিধ্য দিতে। পরম সত্ত্বা কোন খন্ড জ্ঞান নয়। পরম সত্ত্বা অভাব বোধ থেকে মুক্ত। তাই বলে পরম সত্ত্বা নির্গুণ নয় বরং সকল গুনের আধার। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে পরম সত্ত্বার জীব সত্ত্বা তৈরীর হেতু কি বা সৃষ্টির উৎস কি? নারী যেমন আপন গর্ভে নিজের দেহের নির্যাস দিয়ে সন্তান তৈরী করে তাকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে বাৎসল্য সুখ অনুভব করে তেমনি পরম সত্ত্বা আপন সত্ত্বা দিয়ে জীব সত্ত্বা তৈরী করে প্রেম সুখ অনুভব করেন। আর লৌকিক বর্ণনায় এখানেই রাধা হচ্ছে জীব সত্ত্বা বা সৃষ্টির প্রতীক এবং কৃষ্ণ হচ্ছে পরম সত্ত্বা বা স্রষ্টা।

শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। বৈষ্ণব মতে ভালোবাসার এই পাঁচ ভাগ। সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসা বা বন্ধুর জন্য বন্ধুর ভালোবাসা বা সেবকের মালিকের প্রতি ভালোবাসা এর সবই ভালোবাসা তবে মধুর ভাবের ভালোবাসার হচ্ছে সব কিছু সংমিশ্রণের উচ্চতর ভালোবাসা।

তাহলে স্রষ্টা ও সৃষ্টি কি দু'টি ভিন্ন সত্ত্বা? এখানে বৈষ্ণববাদীরা বলেন, এ এক ভেদের সাথে অভেদের সম্পর্ক। আগুন ও আগুনের উত্তাপ দুটো সম্পুর্ণ ভিন্ন জিনিষ হয়েও একই সাথে বিদ্যামান ঠিক তেমনই স্রষ্টা থেকে সৃষ্টি ভিন্ন হয়েও একই সাথে বিদ্যমান। আর এটাই হচ্ছে বৈষ্ণব মতের "অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্ব"

তাহলে এটা কি দ্বৈতবাদী নাকি অদ্বৈতবাদী মতবাদ? বৈষ্ণব মতবাদ একই সাথে দ্বৈতবাদী আবার অদ্বৈতবাদী। কম্পিটারের হার্ডওয়্যার এবং সফওয়্যার দুটো সম্পুর্ণ ভিন্ন জিনিষ হয়েও যেমন দুয়ে মিলে সম্পুর্ণ সেটআপ ঠিক তেমন স্রষ্টা এবং সৃষ্টি এ দুইয়ে মিলে সম্পুর্ণ। সন্তান ভিন্ন যেমন মায়ের বাৎসল্য হয়না তেমনি সৃষ্টি ভিন্ন স্রষ্টার প্রেম থাকে অতৃপ্ত। সৃষ্টি নিয়েই স্রষ্টার পুর্ণতা।

এই মধুর ভাব অন্মেষনের নিমিত্তে আসে পরকীয়া। জৈবিক লীলার উর্ধে এক মহাপ্রেম। আপন দেহ আপন ঘরে সার্বিক সংসার ধর্মের উর্ধে যে প্রেম। জীবনের তাগিদে আপন দেহ আপন ঘরই প্রথম কিন্তু তারপর যা এর সবকিছুর উর্ধে যার সৃষ্টির ছন্দে বিশ্বজগত জাগ্রত। কেউ বা পতি সেবায় কেউ বা সন্তান ধারণে আবার কেউ বা বেঁচে থাকার ফসল ফলাতে। জাগতিক এই সব প্রেম যেখানে ঐক্যবদ্ধ হয় সেই ঐক্যবদ্ধ মহাপ্রেমেই পরকীয়া। আর সৃষ্টির ছন্দই বৈষ্ণব প্রতীক "কৃষ্ণের বাঁশী" যার ইশারায় বিশ্ব জগত সদা চঞ্চল। তাইতো চন্ডীদাস বলেন, দিক নেহারিতে সব শ্যামময় দেখি।

তাহলে কি পরমেশ্বর সৃষ্টির সাথে মহাপ্রেমের মিলনের আশায় এ জগত সৃষ্টি করেছেন? না, মায়ের বাৎসল্য যেমন সন্তানের থেকে প্রাপ্তির আশায় আসেনা ঠিক তেমন পরমেশ্বরের সৃষ্টি প্রেমে কোন প্রাপ্তির আশা নেই। সন্তানের যেমন কর্তব্য মাতৃ বাৎসল্যকে অনুভব করা তেমনি সৃষ্টির কর্তব্য স্রস্টার প্রেমকে অনুধাবন করা। সন্তান যেমন মা'কে ঋণী করতে পারেনা সৃষ্টি তেমন স্রষ্টাকে ঋণী করতে পারেনা। রবি ঠাকুরের ভাষায়, হৃদয় অঞ্জলি হতে মম / ওগো তুমি নিরুপম / হে ঐশর্য্যবান / তোমারে যা দিয়াছুন সে তোমারই দান / গ্রহন করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।।

উল্লেখ্য, একটি নিরেট পাথর খন্ডকে যেমন বছর ধরে রসে ডুবিয়ে রাখলেও তা থাকবে রস আস্বাদনে অক্ষম তেমননি মানস পটের নিরেট অবস্থা ভরপুর রসের মাঝেও থাকবে রসহীন। ঠিক যেমন নিরেট মাটিকে কর্ষণ করে ফসল বপনের উপযোগী করতে হয় তেমনি জাগতিক জৈবিক প্রেমকে কর্ষণ করে উপযোগী করে নিতে হয় পরকীয়ার পথে। আর সেখানেই স্রষ্টার মহা মিলন।

বৈষ্ণব দর্শন আবহমান বাংলার এক অমুল্য ভাববাদী নিদর্শন। যার রঙ রূপ বেড়ে উঠার প্রায় সবই এই বাংলার রূপ রসের ভেতর। মধুর ভাবের বিচ্ছেদ ছাড়া বাঙ্গালীর দর্শন চর্চার ইতিহাস অপুর্ণ।



সব শেষে প্রিয় কণ্ঠশিল্পী মাকসুদের কন্ঠে একটি গান-

ও রাই জাগো গো, , , , ,



সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৪
২৯টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×