somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙালির মধ্যপ্রাচ্য (৯)

১৫ ই অক্টোবর, ২০১১ দুপুর ২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দুবাই সংস্কৃতি
দুবাই শহরের সামাজিক অবস্থা দারুণভাবে ব্যথিত করলো আমাকে। তাদের উঠা-বসা, চাল-চলন দেখলে যে কেউ খুব সহজেই বুঝে যাবে ইউরোপে-আমেরিকার সাথে টেক্কা দিতে চায় তারা। এটা আমার ধারণা।

আমাদের সিলেট শহরের উত্তর সুরমা, দক্ষিণ সুরমার মত দুবাই শহরকেও দুইভাবে ভাগ করা যায়। শহরের ভেতর দিয়েই বয়ে গেছে একটি নদী। নদীর নাম আবরা। নদীর এক প্রান্তে বারডুবাই, অন্য প্রান্তে ডেরাডুবাই। দুবাই শহরে যত বাঙালি কাজ করেন, তাদের অধিকাংশই থাকেন ডেরাডুবাই এরিয়ায়।

এই ফাঁকে পাঠককে একটি সাধারণ তথ্য জানিয়ে রাখি, শুধু দুবাই নয়, পুরো আমিরাত দেশটিকেই গড়েতুলা হয়েছে গোছানো পরিকল্পনায়। দুবাই শহরের বিশাল বিশাল সু-উচ্চ অট্টালিকাগুলো যে কারো নজর কাড়বে। রাস্তাঘাটও পরিকল্পিত। আট লেন বিশিষ্ট রাস্তা। ডানে ৪ লাইন, বামে চার লাইন। মধ্যখানে ১০ ফুট মতন ডিভাইডার। ডিভাইডার এরিয়াতে লাগানো হয়েছে খেজুর গাছ। আছে সোডিয়াম লাইট। শতশত কিলোমিটার রাস্তার পুরোটাই সোডিয়াম লাইট লাগানো। রাতের রাস্তায় বেরুলো দিন-রাতের পার্থক্য বুঝা যায় না। গাড়ীগুলো হেডলাইট ছাড়াই চলতে পারবে। সেদেশে আবার লোডশেডিং এর ঝামেলাও নেই। গত দশবছরে দুবাই শহরে দশ সেকেন্ডের জন্যও বিদ্যুৎ যায় নি! ভাবা যায়?

শারজাহ’র গল্প যথাসময়েই বলা হবে। আপাতত বিদ্যুৎ সংক্রান্ত একটি তথ্য মনে পড়েছে। ভুলে যাওয়ার আগে সেটি জানিয়ে রাখি।

শারজাহ’র খরফাক্কান অঞ্চলে গত বছর একটি ট্রান্সমিটার হঠাৎ করে বিকল হয়ে যাওয়ায় ২৮ মিনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। অবশ্য মাত্র ২৮ মিনিটের মধ্যেই সমস্যাটির সমাধান করে করে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করে তোলা হয়। এটা ইচ্ছাকৃত ক্রুটি ছিল না। এটা ছিল নিছক একটি দুর্ঘটনা। অথচ এজন্য সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ২২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাকি চাকরি চলে গিয়েছিল।

কারণ ব্যাখ্যায় বলা হয়েছিল, “তোমরা এতজন দায়িত্বশীল থাকতে ট্রান্সমিটারটি নষ্ট হল কীভাবে? ক্রটিগুলো আগেই কেন তোমাদের নজরে পড়লো না? কী করছিলে তোমরা? দায়িত্বে অবহেলার জন্য তোমারদেরকে সাসপেন্ড করা হল।” এই তথ্যটি আমাকে জানালো ইয়াহইয়া। ইয়াহইয়াদের কথা শারজাহ’র আলোচনা করার সময় বিস্তারিত ভাবে বলা যাবে।

চকমপ্রদ এই তথ্যটি শুনে আমি ভাবতে লাগলাম আমাদের দেশের বিদ্যুতের কথা। ওরা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। আর আমাদের দেশের বিদ্যুৎ আমাদের ব্যবহার করে। যখন আমাদের কথা মনে পড়ে, তখন কিছু সময়ের জন্য দেখা করতে আসে। কিন্তু ব্যস্ততা থাকায় বেচারা বিদ্যুৎ বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। আবার চলে যায়।

এ প্রসঙ্গে মজাদার একটি চুটকি মনে পড়ছে।

দু'বন্ধু কথা বলছে বিদ্যুৎ নিয়ে। দুজন দু'অঞ্চলের বাসিন্দা।
একজন বললো; আর বলিসনা দোস্ত। লোদ শেডিং এর জ্বালায় আর বাঁচি না।
দ্বিতীয় বন্ধুঃ কেনো! কী হয়েছে? খুব কারেন্ট যায় বুঝি?
প্রথম বন্ধুঃ যায় মানে। ঘন্টায় তিনবার যায়। কেনো! তোর এলাকায় যায় না?
দ্বিতীয় বন্ধুঃ নাহ। আমার এলাকায় কারেন্ট যায় না। মাঝেমধ্যে আসে!!

ফিরে যাই দুবাই।
অদেশের রাস্তার মুড়ে মুড়ে আছে পথ নির্দেশিকা। গাড়ীগুলোও সব দামি। ফিটনেস টেষ্ট ছাড়াই চোখের দেখায় সবগুলো গাড়ীর ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়া যাবে। তবে গাড়ীগুলোর ফিটিংস এবং চলার ধরণ ভিন্ন। আমাদের দেশের গাড়ীগুলোর ড্রাইভিং সিট এবং স্টিয়ারিং থাকে ডানে, গাড়ী চলে রাস্তার বামে। আর দুবাইসহ সারা আমিরাতের গাড়ীগুলোর স্টিয়ারিং হল বামে, গাড়ীগুলো চলে রাস্তার ডানে।

হাদীস শরীফে রাস্তার ডানে চলতে বলা হয়েছে। তাই ডানে চলা সুন্নত। আমিরাতের গাড়ী চলার এই নিয়মটি আমাকে প্রভাবিত করলো। সুন্নতের উপর তাদের আমল দেখে ভাবলাম সবকিছুর পরেও আরব দেশতো! আরবের নবী বিশ্বনবী (সাঃ) এর পদস্পর্শে ধন্য আরবের মাটিতে সুন্নতের অনুসরণ হবে, এতে আর অবাক হবার কী? এটাই তো স্বাভাবিক।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমাকে জানাতে হচ্ছে যে, খুব বেশিক্ষণ আমি আমার এই অনুভূতিকে ধরে রাখতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করে জানলাম তারা ডানে চলার সুন্নতের উপর আমল করতে যেয়ে এ কাজ করছে না। তারা বিশ্বনবীর সুন্নতের কারণে ডানে চলে না, তারা ডানে চলে আমেরিকার সুন্নতের উপর আমল করার জন্য। আমেরিকায় রাস্তার ডানদিকে গাড়ী চলে।

আমার ভেতর থেকে অনুভব করলাম একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মনে মনে বললাম, হায়রে মুসলমান!

রাস্তা ফাঁকা অথচ লাল বাতি জ্বলে আছে দেখে আমাদের ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে গেল। আমি ড্রাইভারকে বললাম, রাস্তা তো ফাঁকা, পুলিশও নেই। তাহলে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

ইন্ডিয়ান ড্রাইভার আমাকে হাত ইশারায় লাল বাতি দেখালো।

আমি বললাম, সমস্যা কী? রাস্তাতো ফাঁকাই আছে। আপনার চলে যেতে অসুবিধা কী? আপনি তো চলে যেতে পারেন।

সে আমাকে বললো, “না, পারি না। রাস্তায় পুলিশ না থাকলেও প্রতিটি পয়েন্টে ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা বসানো আছে। আমি যদি সিগনাল অমান্য করি, রং পার্কিং করি, নির্ধারিত রোডের নির্দিষ্ট গতির আইন লংঘন করি, তাহলে ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ হবে। গাড়িশুদ্ধ ছবি উঠে যাবে। পুলিশ হয়ত আমাকে দৌড়ে এসে ধরবে না, কিন্তু ফাইন লিখে রাখা হবে ঠিকই।

দেখা যাবে, বছরান্তে আমি যখন ট্যাক্স দিতে যাবো, তখন আমার হাতে ধরিয়ে দেয়া হবে জরিমানার চার্ট। আমি কোন্ জায়গায় কোন পয়েন্টে কী অন্যায় করেছি, ডিটেইল বর্ণনাসহ জরিমানার পরিমাণ লেখা থাকবে সেখানে। হয়ত দেখা যাবে, গাড়ীর মূল্য ৪৫ হাজার দেরহাম, কিন্তু সারা বছরে ফাইন হয়ে বসে আছে ২০ হাজার দেরহাম। গাড়ীর দামের প্রায় অর্ধেক! আর একবার ফাইন লেখা হয়ে গেলে তার আর ক্ষমা নেই। পরিশোধ করতেই হবে। আবার সেখানে ছয়-নয় করারও সুযোগ নেই।”

ড্রাইভারের কাছ থেকে আমি জানলাম, আরব আমিরাতের পুলিশ প্রশাসন ও সরকারী অফিস আদালতের ছোট বড় কর্মকর্তারা অনেক ভালমন্দ খাবার খান। কিন্তু যে অখাদ্যটি জীবনে চেঁকে দেখারও ইচ্ছা করেন নি, সেটা হচ্ছে ঘুষ।
তারা ঘুষ খান না।
আমি মনে মনে বললাম, সালাম আমিরাতের পুলিশ।

ড্রাইভারের কথা শুনে আমার স্মৃতিতে বারবার ভেসে উঠতে লাগলো আমার প্রিয় বাংলাদেশের চেহারা। মনে পড়ে গেল আমার নিজ দেশের পুলিশ প্রশাসনের কথা। সেদেশের পুলিশ ঘুষ খায় না। আর আমার দেশের পুলিশের প্রধান খাদ্যই হল ঘুষ।

অবশ্য কিছু ভাল অফিসারও আছেন যারা পূর্ণ সততা ও ঈমানদারীর সাথে দেশসেবা করেন। গোবরেও পদ্মফুল ফুটে। অবশ্য এই পদ্মগুলোকে আমরা অন্তর থেকে শ্রদ্ধা জানাই।

তো আমিরাতের পুলিশ ঘুষ খায় না, এর অনেক পজেটিভ কারণ রয়েছে। প্রথমতঃ তাদের বেতন/ভাতা সন্তোষজনক। সুযোগ-সুবিধাও ভাল। তাদের সরকার তাদের সকল চাহিদা ফুলফিল করে থাকে। তবে আমি যেটাকে মূল কারণ হিসেবে মনে করি, তা হল, তাদের দেশের সংস্কৃতিই সেভাবে গড়ে উঠেছে। তাদের দেশের শাসনতান্ত্রিক অবকাঠামো, আইনের শাসনের সঠিক প্রয়োগ এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি তাদেরকে স্বচ্ছ ও ঘুষমুক্ত থেকে কাজ করতে শিখিয়েছে।

আর আমাদের দেশের পুলিশ প্রথমে অভাবের কারণে বা বিলাসিতা করার জন্য ঘুষ খায়। আর পরে ঘুষ খাওয়া তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। আমি জানি আমাদের দেশের পুলিশের বেতন/ভাতা যথেষ্ট নয়, সুযোগ-সুবিধাও অপর্যাপ্ত। কিন্তু সততার মাপকাঠিতে এর কোনোটিই ঘুষ খাওয়ার পক্ষে অজুহাত হতে পারে না।

একই সঙ্গে আমার মনে পড়লো আমাদের ‘বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি’ বা বিআরটিএ’র কথা। সেখানে অসম্ভব বলে কোনো কাজ নেই। গাড়ীগুলো চাকার উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারলেই ফিটনেস সার্টিফিকেট হাসিল করা যায়। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া যায়। জরিমানা কমিয়ে আনা যায়। আর এই কাজগুলো সহজে করে দেয়ার জন্য ঘুষ একটি অপেন সিক্রেট বিষয়।

চলুন প্রবেশ করি দুবাই সংস্কৃতিতে-----------

ক্রমশ----------
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্টে যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×