somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নার্গিসকে লেখা কবি নজরুলের ঐতিহাসিক চিঠি-৪

১৪ ই অক্টোবর, ২০১১ রাত ৩:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হায় আমার অতৃপ্ত হিয়া! কাকে চাস তুই? কে সে তোর প্রিয়তমা? কে সে গরবিনী, কোথায় কোন আঙিনা-তলে তোর তরে মালা-হাতে দাঁড়িয়ে রে?... আমার মনের যে মানসী প্রিয়া, তাকে না পেয়েই তো কাউকে ভালোবাসতে পারলুম না এ জীবনে! কতগুলি কচি বুকই না দলে গেলুম আমার এ জীবনের আরম্ভ হতে না হতেই, তা ভেবে আজ আর আমার কষ্টের অন্ত নেই। তবে আমার এইটুকু সান্ত¡না যে, আমি কখনো কারুর ভালোবাসার অপমান করিনি। কাউকে ভালোবেসেছি বলে প্রলোভন দেখিয়ে শেষে পথে ফেলে চলে যাইনি। উল্টো তাদের কাছে দুহাত জুড়ে ক্ষমাই চেয়েছিল, অমনি করে সুদূর থেকেই। আমায় ভালো না বাসতে অনুরোধ করে, তার পথ থেকে চিরদিনের মতো সরে গিয়েছি। পাছে কোনো দিন কোনো কাজে তার বাধা পড়ে, সেই ভয়ে আর কোনোদিন তার পথের পাশ দিয়েও চলিনি। অনেকে আমায় অভিশাপও দিয়েছে আমার এই নির্মমতার জন্যে, অনেকে আবার অহঙ্কার দর্পী বলে গালও দিয়েছে।

এমন করে বিজয়ী বীরের মতো আপন মনে পথে-বিপথে আমার রথ চালিয়ে বেড়াচ্ছিলুম। এমন সময় একদিন সকালে তোমায় আমায় দেখা। হঠাৎ আমার রথ থেমে গেল। আমার মন কী এক বিপুল সুখে আনন্দ-ধ্বনি করে ওঠল,Ñ পেয়েছি, পেয়েছি! আমার মনের পথিক-বন্ধু হঠাৎ ম্লান মুখে আমার সামনে এসে বললেÑ বন্ধু বিদায়। আর তুমি আমার নও; এখন তুমি তোমার মানসীর। তোমার পথের শেষ হয়েছে। দেখলুম সে পথের শেষে দিগন্তের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

এতদিন আমার শত সাধ্য-সাধনা করেও পথিক-বালারা আমার রথ থামাতে পারেনি, কতজন রথের চাকার সামনে বুক পেতে শুয়ে পড়েছে, আমি হাসতে হাসতে তাদের বুকের ওপর দিয়ে রথ চালিয়ে নিয়ে গিয়েছি, কিন্তু হায়, আজ আমার এ কি হল? রথ যে আর চলে না! তুমি শুধু আমার পানে চোখ তুলে চাইলে মাত্র, একটু সাদলেও না যে, পথিক! আমার দ্বারে একটু থাম!

তবু আমার দুঃখ হল না, মান-অপমান জ্ঞান রইল না, আমি মালা-হাতে রথ থেকে নেমে পড়লুম। তোমার গলায় আমার জন্ম-জন্মের সাধের গাঁথা পরিয়ে দিলুম। তুমি নীরবে মাথা নত ক’রে দাঁড়িয়ে রইলে। তোমার ঐ মৌন বুকের ভাষা বুঝতে পারলুম না। প্রাণ যেন কেমন করে উঠল। তুমি সুখী হলে, না ব্যথা পেলে, কিছুই বোঝা গেল না। অমনি চির-অভিমানী আমার বুকে বড়ই বাজল। ভগবান কেন অন্যের মনটি দেখবার শক্তি দেননি মানুষকে? কিন্তু তোমার প্রতি অভিমান আমার যতই হোক, তোমাকে নালিশ করবার কিছুই ছিল না আমার (আজও নেই)। আমি যে তোমার মনটি না জেনেই তোমায় ভালোবেসেছি। চিরদিন জয় করে ফিরে তোমার গলায় যে হারমানা হার পরিয়েছি-তুমি যে আমার মানসী প্রিয়া! আমার মনে মনে জন্ম-জন্মান্তর ধরে যে ছবি আঁকা ছিল, যাকে খুঁজতে এমন করে আমার এমন চিরন্তন পথিক বেশ, সে-মানসীকে দেখেই, চিনে নিয়েছি। তাই আমি একটুক্ষণের জন্যেও ভেবে দেখিনি, তুমি এ পরাজিত বিদ্রোহীর নৈবেদ্য-মালা হেসে গ্রহণ করবে, না পায়ে ঠেলে চলে যাবে।

তুমি যদি আমায় ভালো না বাসতে পার, তার জন্যে তো তোমায় দোষ দিতে পারিনে। আমি জানি, খুব জানি প্রিয়, যে কোনো মানুষেরই মন তার অধীন নয়। সে যাকে ভালোবাসতে চায়, যাকে ভালোবাসা কর্তব্য মনে করে, মন তাকে কিছুতেই ভালোবাসবে না। মন তার মনের মানুষের জন্যে নিরন্তর কেঁদে মরছে, সে অন্যকে ভালোবাসতে পারে না। কত জন্ম ধরে তোমায় খুঁজে বেড়িয়েছি এমনি করে, তুমি কিন্তু ধরা দাওনি, এবারেও ধরা দিলে না। কখন কোন জন্মে কোন নাম-হারা গাঁয়ের পাশে তোমার আমার ঘর বাঁধব, কখন তুমি আমায় ভালোবাসবে জানি না। তবু আমি তোমায় ভালোবাসি, তাই আমার এত বিপুল অভিমান তোমার ওপর।

ধরো আমার এ অভিমান যদি মিথ্যে হয়, যদি সত্যিই তুমি আমায় ভালোবাস, তা হলে হয়তো মনে করবে যে, আমি কেন তোমায় ভুল বুঝে এমন করে কষ্ট পাচ্ছি। কেন তোমাকে এমন করে ব্যথা দিচ্ছি। সেই কথাটি জানবার জন্যেই কাল সারা রাত্তির ধরে তোমার দয়ার দান চিঠি কটি নিয়ে হাজার বার করে পড়েছি, কিন্তু হায়, তাতেও এমন কিছু পেলুম না, যাতে করে আমার এই এই নির্মম ধারণা, কঠোর বিশ্বাস দূর হয়ে যেতে পারে। আমার দুঃখে, আমার বেদনায় করুণা বিগলিত হৃদয়ে অনেক সান্ত¡না দিয়েছ, অনেক কিছু লিখেছ, অনেক জায়গায় পড়তে পড়তে চোখের জলও বাধা মানে না, কিন্তু 'তোমায় আমি ভালোবাসি এই কথাটি কোথায় লেখনিÑ ভুলেও না। এ কথাটি ঢাকবার জন্যে যে সলজ্জ কুণ্ঠা বা আকুলতা, তাও নেই কোনো চিঠির কোনোখানটিতেই। হায় রে অন্ধ বিশ্বাস আমার! তবু এত দিন কত অধিকার নিয়ে কত অভিমান করেই না তোমায় চিঠি দিয়ে এসেছি। সেই লজ্জায় সেই অপমানে আজ আমার বুকের বেদনা শতগুণে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে, তবু কিন্তু তোমায় ছেড়ে দূরে যেতে পারছি নে। এবার যে আমি আগে ভালোবেসেছি। যে আগে ভালোবাসে, প্রায়ই তার এই দুর্দশা, এই লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়। তাই বড় দুঃখে আজ অবিশ্বাসী নাস্তিকের মতো এই বলে মরতে যাচ্ছি যে, পৃথিবীতে ভালোবাসা বলে কোনো জিনিস নেই। ভালোবেসে ভালোবাসা পাওয়া যায় না এই অবহেলার মাটির ধরায়। মানুষ যে কত বড় ঘা খেয়ে অবিশ্বাসী নাস্তিক হয়, তা যে নাস্তিক হয়, সেই বোঝে। জানি ভালোবেসে আত্মদানেই তৃপ্তি! বিশ্বাসও করি, যে, সত্যিকার ভালোবাসা যায়, সে অপমান আঘাত করলে হাজার ব্যথা দিলেও তাকে ভোলা যায় না। প্রিয়ের দেওয়া সেই ব্যথাও যেন সুখের মতোই প্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু তাই বলে এত প্রাণ-ঢালা ভালোবাসার বিনিময়ে একটু ভালোবাসা পাবার জন্যে প্রাণটা হা-হা করে কেঁদে ওঠে না, এ যে বলে, সে সত্যি কথা বলে না।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×