somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি ?

১২ ই অক্টোবর, ২০১১ রাত ১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত ৩রা অক্টোবর বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী দৈনিক দি নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ করেছে। ‘দেশ ভাগের আগে দেশভাগ’ শীর্ষক নিবন্ধে তারা দাবি করেন ‘আমার সোনার বাংলা’ মানে অবিভক্ত বাংলা। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বাংলা কোন বাংলা? বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন আসলে কোন বাংলার গান গাইছে?

১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বাংলা আনুষ্ঠানিকভাবে ভাগ হলো। এই দেশভাগ বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে নাড়া দিয়েছিল। এর আগে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তিনি লিখেছিলেন, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল এবং ‘আমার সোনার বাংলা’। তখনও বাংলা ভাগের ঘোষণা আসেনি। পত্রিকাটির ‘দেশ ভাগের আগে দেশভাগ’ শীর্ষক নিবন্ধে লেখক দাবি করেন, কলকাতা শহরে প্রথম বাংলা ভাগের প্রতিবাদ হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাওয়া হয়েছিল। ১৯১১ সালে দুই বাংলা পুনরায় একত্রিত হয়েছিল তবে তা ১৯৪৭ সালে আবার ভাগ হওয়ার জন্য। নিউ ইয়র্ক টাইমসের ওই নিবন্ধের শেষ অংশে বলা হয়, ইতিহাসের অনেক পরিহাস। তবে বঙ্গের (বাংলাদেশের) অন্যতম পরিহাস হলো- ১৯৭১ সালে ইস্ট বেঙ্গল স্বাধীনতা পেল আর তারা কিনা তাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নিলো ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম দশ লাইন। যেটি ছিল রবীন্দ্রনাথের এমন একটি কবিতা, যা অবিভক্ত বাংলার চেতনায় অনুপ্রাণিত।

আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত হয়েছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। ১৯০৩ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবসমূহ বিবেচনা করা হয়। তখন বঙ্গ হতে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাদ্বয়কে আসাম প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রস্তাবও ছিল। তেমনিভাবে ছোট নাগপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে আত্তিকরণেরও একটি প্রস্তাব ছিল। ১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে সরকারীভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয় এবং ফেব্রুয়ারিতে লর্ড কার্জন বঙ্গের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এক সরকারী সফরের মাধ্যমে এই বিভক্তির ব্যাপারে জনমত যাচাইয়ের চেষ্টা করেন। তিনি বিভিন্ন জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে এই বিভক্তির বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা দেন। পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী (দার্জিলিং বাদে) বিভাগ এবং মালদা জেলা, আসাম প্রদেশের সঙ্গে একীভূত হয়ে এই নতুন প্রদেশ গঠন করবে। এর ফলে বঙ্গ শুধু তার বৃহৎ পূর্বাঞ্চলই হারাবে না, তাকে হিন্দীভাষী পাঁচটি রাজ্য ও মধ্যপ্রদেশকে ছেড়ে দিতে হবে। অন্যদিকে পশ্চিমে সম্বলপুর এবং মধ্যপ্রদেশের পাঁচটি ওড়িয়া-ভাষী রাজ্যের সামান্য অংশ বঙ্গকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। ফলে বঙ্গের আয়তন দাঁড়ায় ১,৪১,৫৮০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ৫৪ মিলিয়ন যার মধ্যে ৪২ মিলিয়ন হিন্দু ও ৯ মিলিয়ন মুসলিম। নতুন প্রদেশটির নামকরণ করা হয় “পূর্ব বঙ্গ ও আসাম” যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুষঙ্গী সদর দফতর হবে চট্টগ্রাম। এর আয়তন হবে ১,০৬,৫৪০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা হবে ৩১ মিলিয়ন যাদের মধ্যে ১৮ মিলিয়ন মুসলিম ও ১২ মিলিয়ন হিন্দু। এর প্রশাসন একটি আইন পরিষদ ও দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি রাজস্ব বোর্ড নিয়ে গঠিত হবে এবং কলকাতা হাইকোর্টের এখতিয়ার বজায় থাকবে। সরকার নির্দেশ দেয় যে পূর্ব বঙ্গ ও আসামের পশ্চিম সীমানা স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট থাকবে সাথেসাথে এর ভৌগোলিক, জাতিক, ভাষিক ও সামাজিক বৈশিষ্টাবলিও নির্দিষ্ট থাকবে। সরকার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ১৯০৫ সালের ১৯শে জুলাই। এবং বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় একই বছরের ১৬ই অক্টোবর। এই ঘটনা এক প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদের এমন ধারণা হয় যে নতুন প্রদেশের ফলে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ বেড়ে যাবে। এদিকে পশ্চিম বঙ্গের জনগণ এই বিভক্তি মেনে নিতে না পেরে প্রচুর পরিমাণে জাতীয়তাবাদী লেখা প্রকাশ করতে থাকে। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ করার প্রস্তাবকদের জন্য এক মর্মস্পর্শী গান "আমার সোনার বাংলা" লেখেন। সত্যেন রায়ের রচনা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের ৭ অগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সভায় এই গানটি প্রথম পরিবেশিত হয়েছিল। এই বছরই ৭ সেপ্টেম্বর (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র) সঞ্জীবনী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সাক্ষরে গানটি মুদ্রিত হয়েছিল। একই বছর বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও গানটি পুনঃমুদ্রিত হয়েছিল। আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত হয়েছিল শিলাইদহের ডাক-পিয়ন গগন হরকরা রচিত "আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে" গানটির সুরের অনুষঙ্গে। সরলা দেবী চৌধুরানী ইতিপূর্বে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে তাঁর শতগান সংকলনে গগন হরকরা রচিত গানটির স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ-সমসাময়িক অনেক স্বদেশী গানের সুরই এই স্বরলিপি গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছিল। যদিও পূর্ববঙ্গের বাউল ও ভাটিয়ালি সুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি ইতিপূর্বেই হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৮৮৯-১৯০১ সময়কালে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারির কাজে ভ্রমণ ও বসবাসের সময় বাংলার লোকজ সুরের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা ঘটে। তারই অভিপ্রকাশ রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী আন্দোলনের সমসাময়িক গানগুলি। বিশেষত "আমার সোনার বাংলা"। অতঃপর ১৯৭১ সালের ১ মার্চ গঠিত হয় স্বাধীন বাংলার কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ঘোষিত ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হয়। গানটির প্রথম দশ লাইনকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করা হয় ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি । পরে সংগীতজ্ঞ সমর দাসের (প্রয়াত) তত্ত্বাবধানে ব্রিটেনের বিবিসি স্টুডিও থেকে জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রেশন তৈরি করে আনা হয়। বর্তমানে এই সুরই বাজানো হয়ে থাকে আমাদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে।

১৯৭২ সালে যখন "আমার সোনার বাংলা" স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয় তখন তেমন কোনো প্রতিবাদ হয়নি পশ্চিমবঙ্গে। গানটি ত্রুটিপূর্ণ সুরে গাওয়া হচ্ছে বলে আপত্তি তুলেছিল একটি মহল। আরেকটি মহল আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বাঙালি পরিচয় সঙ্কটে পড়বে বলে। নতুন করে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী দৈনিক দি নিউ ইয়র্ক টাইমস এবিষয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করায় বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের মনে ভিন্ন কোন আন্দোলন সৃষ্টি হবে কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। আমাদের অধিকাংশ অর্জনই কোন না কোন ভাবে বিতর্কিত। সেই বিতর্কের মিছিলে এবার সামিল হলো আমাদের জাতীয় সংগীত। বর্তমান প্রজন্মের কেউ যদি হঠাৎ মুখ ফসকে প্রশ্ন করে ফেলে, যে গান লেখা হলো আমাদের স্বাধীনতা ভোগের বিপক্ষে সে গানই কেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হলো । তাহলে আমরা তাকে কি উত্তর দেব? নাকি ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেব? আসলে দ্বিধাহীন চিত্তে গলা ছেড়ে আমরা কেউ কি বলতে পারবো "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি " এই লাইন দুটিতে স্বাধীন ও সার্বভৌম, লাল সবুজের এই সোনার বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে ? যদি না পারি তাহলে আমদের কি করা উচিত? আর যদি খুব দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, হ্যা ! কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লাইন দুটিতে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের কথা বলেছেন। তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে দি নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রকাশিত নিবন্ধের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করা উচিত।
[email protected]
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×