somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পেনিসিলিনের জন্মকথা

১০ ই অক্টোবর, ২০১১ রাত ১০:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



খুব বেশীদিন আগের কথা নয় মানুষ জানতই না যে জীবানু রোগের কারন হতে পারে। তার ও কিছুদিন আগ পর্যন্ত মানুষ জানত না জীবানুর অস্তিত্বের কথা। ১৬৭৬ সালে জীবানুবিদ্যা বা মাইক্রোবাইওলজীর(Microbiology) জনক ডাচ বিজ্ঞানী লিউহেনহুক( Antonie van Leeuwenhoek)লেন্স ঘষে তৈরী করলেন অনুবীক্ষন যন্ত্র আর ধরা পড়ল জীবানুর অস্তিত্ব। তখনও কিন্তু রোগের সাথে জীবানুর সম্পর্ক ছিল অজানা। একটুকরো রুটি বাতাসে ফেলে রাখলে দু এক দিন পর আপনা আপনি তাতে ছাতা গজায়। ঐ সময় প্রচলিত ধারনা ছিল যে রোগ শোক হয়ে থাকে আপনা আপনি যাকে বলা হয়ে থাকে” Spontaneous Generation theory”. ১৮’শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভিয়েনার চিকিৎসক Ignaz Semmelweis যখন বললেন যে প্রসুতি কালে জীবানু সংক্রমন (Puerperial sepsis) , মৃত্যুর কারন এবং রোগীনি পরীক্ষায় চিকিৎসক যদি ক্লোরিন পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নেন তা হলে প্রসুতির ইনফেকশান এবং সেপসিস কমিয়ে আনা সম্ভব। সেদিনকার বিজ্ঞানী সমাজ তাকে একঘরে করে রাখে এবং তিনি তার শেষ দিনগুলো কাটান পাগলা গারদে। ঐ সময় প্রসুতির মৃত্যুর প্রধান কারন ছিল ইনফেকশান(Puerperial sepsis) উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এসে এই তত্ব (Spontaneous Generation theory )ক্রমশই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে লাগল। ফ্রান্সের লুই পাস্তুর (Louis Pasteur) এবং জার্মানীর রবার্ট কখ (Robert Koch) জীবানুবিদ্যার এই দুই দিকপাল বিজ্ঞানী, সন্দেহাতীতভাবে প্রমান করলেন যে জীবানু সংক্রমনই অনেক রোগের কারন। প্রতিষ্ঠা পেল জীবানুর ভুমিকা(Germ theory of Diseases) । ইংল্যান্ডের Joseph Lister কে বলা হয় আধুনিক এন্টীসেপসিসের জনক। লিস্টার দেখালেন কিভাবে শৈল্য চিকিৎসা নিরাপদে সংক্রমনহীনভাবে করা সম্ভব, এল এন্টিসেপ্টিক।এন্টিসেপ্টিক ঔষধ জীবানুধ্বংশকারী হলেও তা কিন্তু বিষাক্ত, শুধুমাত্র শরীরের বাইরে ব্যাবহারের উপযোগী। জীবানু রোগের কারন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও শরীরের ভিতরের জীবানু ধংশের উপায় তখনও অজানা। ১৮৯০ সালে দুজন জার্মান ডাক্তার Rudolf Emmerich এবং Oscar Low ছাতা থেকে তৈরী করেন জীবানু ধ্বংশকারী ঔষধ যার নাম দেন তারা pyocyanase । কিন্তু তাদের ঔষধ ভাল কাজ করত না।

১৯০৮ সালের মেডিসিনে নোবেলজয়ী জার্মান বিজ্ঞানী পল আরলিক(Paul Ehrlich) আবিস্কার করলেন “সালাভারসান” ঔষধ। আর্সেনিক দিয়ে তৈরী তার এই ঔষধ সিফিলিস চিকিৎসায় ছিল ধন্বন্তরী। সালভারসান ঔষধকে বলা হত “ম্যাজিক বুলেট” যা পেনিসিলিন আবিস্কারের আগ পর্যন্ত সিফিলিস চিকিৎসায় ব্যবহৃত হত।
যে যুগান্তকারী আবিস্কার বদলে দিয়েছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানকে , সুচনা করেছিল নতুন অধ্যায়, যে আবিস্কার কোটী কোটী মানুষকে বাচিয়েছিল ব্যাক্টেরিয়ার হাত থেকে তা হল “পেনিসিলিন”
আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ছিলেন স্কটিশ বিজ্ঞানী।১৯২৮ সাল। ফ্লেমিং তখন গবেষনা করছিলেন “স্ট্যাফাইলোকক্কাস”( staphylococci) ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে। ইতিপূর্বেই ফ্লেমিং খ্যাতি অর্জন করেছেন গবেষনা কাজে, আবিস্কার করেছেন কোষের “লাইসোজোম”(Lysosome) । দু সপ্তাহের ছুটি শেষে ৩রা সেপ্টেম্বর ফিরে এসেছেন গবেষনাগারে। ব্যাক্টেরিয়ার উপর পরীক্ষা নীরিক্ষা করার জন্য বিশেষ পাত্র “কালচার মিডিয়াম ট্রে” গুলোতে রাখা ছিল স্ট্যাফাইলোকক্কাস ব্যাক্টেরিয়া। ফ্লেমিং এর গবেষনাগার অনেক সময় থাকত অপরিস্কার। ছুটিতে যাওয়ার সময় ট্রে গুলোকে গাদা করে রেখে গিয়েছিলেন বেঞ্চের উপর। ফিরে এসে ফ্লেমিং লক্ষ করলেন সব ট্রে গুলোতে ব্যাক্টেরিয়া জন্মালেও একটা ট্রে তে ছাতা(fungus) গজিয়েছে ফলে সেই ট্রে তে ছাতার আশেপাশে ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংশ হয়ে গেছে। সম্ভবত ভুলে খুলে রেখে যাওয়া জানালা দিয়ে নীচ তলার ফাঙ্গাসের ল্যাবরেটরী থেকে এসেছে এই ছাতা বা ফাঙ্গাস। লেগে পড়লেন ছাতা নিয়ে। নিশ্চয়ই ছাতাতে এমন কিছু ছিল যা মেরে ফেলেছে আশেপাশের ব্যাক্টেরিয়াদেরকে। কি সেই ছাতা? কি সেই জিনিস যা মেরে ফেলেছে ব্যাক্টেরিয়াদেরকে? অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই “ছাতা” কে সনাক্ত করলেন “পেনিসিলিয়াম নোটেটাম” (Penicillium notatum )আর যে পদার্থ তৈরী করছিল ছাতাগুলো তা হল পেনিসিলিন(Penicillin)। আবিস্কৃত হল পেনিসিলিন, কিন্তু তা যে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করে জীবানুবাহিত রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব তার জন্য অপেক্ষা করতে হল আরো কয়েক বছর।
১৯২৯ সালের “ British Journal of Experimental Pathology” তে ফ্লেমিং য়ের আবিস্কার প্রকাশিত হল। প্রায় এক দশক ফ্লেমিং এর আবিস্কার পড়ে রইল, এমনকি ফ্লেমিং নিজেও ১৯৩২ সালের পর থেকে আর পেনিসিলিন নিয়ে কাজ করেন নি। ১৯৩৯ সালে অক্সফোর্ডের এক দল বিজ্ঞানীর হাতে পড়ল পেনিসিলিন। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন অস্ট্রেলিয়াতে জন্ম নেওয়া বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড ফ্লোরী( Howard Florey), নাজী অত্যাচারের হাত থেকে পালিয়ে আসা জার্মান রসায়ন বিজ্ঞানী আর্নস্ট বরিস চেইন(Ernst Boris Chain)। ফ্লেমিং যা করতে পারেন নি তাই করলেন তারা। রকফেলার ফাউন্ডেশানের আর্থিক সহায়তায় মোল্ড বা ছাতা থেকে বিশূদ্ধ পেনিসিলিন তৈরী করলেন এই দল। ইতিমধ্যেই ১৯৩৫ সালে গেরহার্ড ডোমাক(Gerhard Domagk) আবিস্কার করেছেন সালফোনামাইড ঔষধ “প্রন্টোসিল” যা মানব শরীরে প্রয়োগের উপযোগী এবং স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাক্টেরিয়াকে মেরে ফেলতে সক্ষম। এরপর ফ্লোরীর দল ইন্দুরে পেনিসিলিন প্রয়োগ করে প্রমান করলেন এর অবিশ্বাস্য কার্যকারীতা। তাদের গবেষনার ফল প্রকাশিত হল “ল্যান্সেট” পত্রিকায়। এরপর এল রোগীদের পালা। ফ্লোরীর দল রোগীদের শরীরে পেনিসিলিন প্রয়োগ করে দেখালেন খুব দ্রুত সেরে উঠছে বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগে আক্রান্তরা।
হুমড়ি খেয়ে পড়ল সারা পৃথিবী। এগিয়ে এল ফার্মাসিটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রী। তৈরী হতে শুরু করল যথেস্ট পরিমান পেনিসিলিন। এত দিন নিউমোনিয়া, ডিফথেরিয়া, স্কারলেট ফিভার, পারপিউরাল সেপসিস, ইত্যাদি ব্যাক্টেরিয়াল রোগ কেড়ে নিয়েছে যে লক্ষ/ কোটি জীবন , তারা সেরে উঠল। তখন চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধে আহত সৈন্যদের গ্যাংরীনে পচে মরা ছাড়া যাদের কোন গতি থাকত না তারা বেচে ফিরে এল।
১৯৪৪ সালে নাইট উপাধি পেলেন ফ্লেমিং । ১৯৪৫ সালে ফ্লোরী এবং চেইনের সাথে মেডিসিনে নোবেল প্রাইজ পেলেন ফ্লেমিং। (চলবে)

৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সমাধান দিন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩১




সকালে কন্যা বলল তার কলিগরা ছবি দিচ্ছে রিকশাবিহীন রাস্তায় শিশু আর গার্জেনরা পায়ে হেটে যাচ্ছে । একটু বাদেই আবাসিক মোড় থেকে মিছিলের আওয়াজ । আজ রিকশাযাত্রীদের বেশ দুর্ভোগ পোয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নিছক স্বপ্ন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮



©কাজী ফাতেমা ছবি
তারপর তুমি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব
চোখ খুলে স্মিত হাসি তোমার ঠোঁটে
তুমি ভুলেই যাবে পিছনে ফেলে আসা সব গল্প,
সাদা পথে হেঁটে যাব আমরা কত সভ্যতা পিছনে ফেলে
কত সহজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদম চুপ. দেশে আওয়ামী উন্নয়ন হচ্ছে তো?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৯



টাকার দাম কমবে যতো ততোই এটিএম বুথে গ্রাহকরা বেশি টাকা তোলার লিমিট পাবে।
এরপর দেখা যাবে দু তিন জন গ্রাহক‍কেই চাহিদা মতো টাকা দিতে গেলে এটিএম খালি। সকলেই লাখ টাকা তুলবে।
তখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×