somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হালাল-হারামের দৃষ্টিতে বর্তমান শেয়ারবাজার ঝুঁকিপূর্ণ(সংগৃহীত)

১০ ই অক্টোবর, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ


প্রশ্ন : এখন শেয়ারবাজারে বেশ চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ৯৬ সালের বিপর্যয়ের পর দীর্ঘ দিন পর্যন্ত শেয়ার মার্কেট অনেকটা নিস্তব্ধ ছিল। বিশেষ করে গ্রামীনফোনের শেয়ার বাজারে আসার পর থেকে শেয়ারবাজারে অংশগ্রহণ অনেক বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বর্তমান শেয়ারবাজার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে তাতে অংশগ্রহণের হুকুম সম্পর্কে জানতে চাই।

উত্তর : এই প্রশ্নের উত্তর তো সরাসরিই দেওয়া যায়। তবে প্রশ্নকারীর প্রতি সহানুভূতি থেকেই আমরা আগে পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বলি। একে অনেকটা তুলনা করতে পারেন, কারো স্বজনের মৃত্যুসংবাদ দেওয়ার সাথে। সংবাদটা দিতেই হয়। তবে শ্রোতা যেন বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারে এজন্য কিছুটা হলেও মানসিক প্রস্তুতিরও সুযোগ দিতে হয়। বর্তমান শেয়ারবাজারের ব্যাপারে অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই এমনটি করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, হালাল-হারামের বিষয়ে যাদের মধ্যে উদ্বেগ ও সংবেদনশীলতা আছে তাদের যদি শেয়ারবাজার সম্পর্কেও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে তাদের সংশয় সৃষ্টি হবে যে, সম্ভবত এই কারবারটা সহীহ নয়। এজন্য এখন কোনো কোনো প্রশ্নকারীকে সরাসরিও বলে দেই। শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিও বিষয়টিকে সহজ করে দিয়েছে। তা যদি আপনার সামনে থাকে তাহলে বলাও সহজ, গ্রহণ করাও সহজ। যাই হোক, আপনার প্রশ্নের উত্তর যদি সংক্ষেপে পেতে চান তাহলে বলব, বর্তমানে আমাদের দেশে শেয়ার-মার্কেট যে নিয়মে চলে তাতে সেখান থেকে শেয়ারের ক্রয়-বিক্রয়-তা আইপিও-এর মাধ্যমে বলুন বা সেকেণ্ডারি মার্কেট থেকে বলুন-শরীয়তের লেনদেন ও বেচাকেনা-সংক্রান- শর্ত ও নীতিমালা পূরণ করে না। এজন্য হালাল-হারামের দৃষ্টিতে বর্তমান শেয়ারবাজার ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রশ্ন : শেয়ারবাজারে অংশগ্রহণের বিষয়ে আগে থেকে যেসব মাসআলা আমরা পড়েছি, তার সাথে এই সিদ্ধান্তের আংশিক অমিল আছে বলে মনে হয়। কারণ, শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে উপমহাদেশের আলিমদের বিভিন্ন লেখায় যেমন ইমদাদুল ফাতাওয়া ও পরবর্তী ব্যক্তিত্বদের লিখিত কিতাবপত্রে আমরা দেখি যে, তারা কিছু শর্তের সাথে কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচাকে জায়েয বলেছেন। তো এই দুই সিদ্ধান্তের মাঝে কিছুটা অমিল দেখতে পাচ্ছি।

উত্তর : শেয়ারবাজারের লেনদেনের প্রসঙ্গে যে শর্তযুক্ত বৈধতার কথা বলা হয়ে থাকে তা অনেক পুরানো কথা। প্রথম যখন তা বলা হয়েছিল তখন বৃটিশ আমল। তখনকার মুসলমানদের আর্থসামাজিক অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর শেয়ারবাজারে মূল্যের উঠা-নামা ছিল কোম্পানির বাস্তব অবস্থার সাথে অনেকটা সঙ্গতিপূর্ণ। এরপর শেয়ারবাজারে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তিত অবস্থার উপর ওই কথাগুলোর প্রয়োগ আমরা যথার্থ মনে করি না। যে চিন্তার উপর ভিত্তি করে ঐ চার শর্তের কথা বলা হয়েছিল বর্তমান শেয়ারবাজারে তা মোটেই মুখ্য বিষয় নয়। শেয়ারের বেচাকেনাকে কোম্পানির অংশের বেচাকেনা ধরে নিয়ে এই শর্তযুক্ত বৈধতার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু বর্তমান শেয়ারবাজার সম্পর্কে যাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন যে, সেটি এখন নিতান্তই গৌণ। এখন শেয়ারবাজার এমন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে যেখানে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার বেচাকেনা হলেও কোম্পানির লাভ-লোকসান বা বাস্তব অবস্থার সাথে এর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। শেয়ারকে কেন্দ্র করে মানিগেমই হচ্ছে শেয়ারবাজারের মূল ধারা। এটা এখন বেশ পরিষ্কার, সামনে আরও পরিষ্কার হবে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, বর্তমান শেয়ারবাজারের উপর হুকুম প্রয়োগের আগে এই শর্তযুক্ত বৈধতার প্রসঙ্গটি গোড়াতেই কতটা মজবুত তা নিয়েও শান্তভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন ছিল এবং এখনও এ বিষয়ে ভাবার অবকাশ আছে। তৃতীয় কথা হচ্ছে, যারা এখনো এই শর্তযুক্ত বৈধতার কথা বলছেন, বাস্তবতা সম্পর্কে খোঁজ নিলে দেখা যায় যে, তাদের কথা অনুযায়ীও বর্তমান শেয়ারবাজারের লেনদেন বৈধ হয় না। সমপ্রতি পাকিস্তানের মীযান ব্যাংক থেকে একটি পুস্তিকা বের হয়েছে। তাতে শেয়ারের প্রসঙ্গও আছে। কারণ এখনকার ব্যাংকগুলো শেয়ারের কারবারও করে। তাতে বলা হয়েছে যে, কোনো কোম্পানি যদি তার মোট পুঁজির ৪০% বা তারচেয়ে কম সুদী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় তাহলে ওই কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা করা যাবে। মনে হয় যেন অহী আছে! চল্লিশ পার্সেন্ট পর্যন্ত সুদী লোন থাকলে সে কোম্পানির শেয়ার কেনা যাবে! এই কথাগুলো গোড়াতেই সঠিক কি না সে প্রসঙ্গ বাদ দিলেও তাদের কথা অনুযায়ীই তো হালাল হয় না। কারণ এখন কোম্পানিগুলোর ব্যাংক-লোন থাকে ৬০% থেকে ৭০%, ৮০% পর্যন্ত। ৬০% নিজের টাকা দিয়ে কোম্পানি করার দিন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন তো ঘরও করা লাগে না ৬০% নিজের টাকা দিয়ে। ফ্ল্যাট কেনার জন্য ৮০% লোন পাবেন। ১ কোটি টাকার ফ্ল্যাট কিনতে চান তো ব্যাংক আপনাকে ৮০ লক্ষ টাকা লোন দিবে। এজন্য আজকাল এমন কোম্পানি পাওয়া দুষ্কর, যার ব্যাংক-লোন মূল ক্যাপিটালের মাত্র ৪০%। আপনি কোম্পানিগুলোর খোঁজ-খবর নিলে দেখবেন ওদের ৬০-৭০% করে ব্যাংক-লোন আছে। যেসব কোম্পানির শেয়ার মানুষ বেশি কেনে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। কারণ, এতো ওষুধ কোম্পানি! মূল কারবার বৈধ! অথচ কিছুদিন আগেও বেক্সিমকো গ্রুপ ছিল বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপী। এখন অবশ্য তারা আর কাগজে-কলমে ঋণ খেলাপী নেই! যারা এদের সম্পর্কে ঋণখেলাপী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল তাদেরকে তওবা-আসতাগফিরুল্লাহ পড়িয়ে দিয়েছে! যাই হোক, আমার দেখানো উদ্দেশ্য এই পার্সেন্টগুলো। এগুলো শরীয়তের কোনো নসে আছে বলে আমরা দেখিনি। ফকীহরা এ রকম পার্সেন্ট ধরে ধরে কোনো কথা বলেছেন তাও আমাদের জানা নেই। অথচ এখন ৩৩%, ৪০%, ৫০% এগুলো এসে গেছে ছাপানো আকারে! তো গোড়ার প্রসঙ্গটাতেই প্রশ্ন আছে।

প্রশ্ন : আপনি বলেছেন যে, বর্তমান শেয়ারবাজার পূর্বের অবস্থায় নেই। তাতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। শেয়ার বাজারের গতি-প্রকৃতি এবং শেয়ারের দর বাড়া-কমা-এগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় শেয়ারবাজারের নিজস্ব কিছু বিষয় দ্বারা। বিষয়টি একটু সুনির্দিষ্ট করে বলবেন কি?

উত্তর : আগে বিষয়টি এই ছিল যে, কোম্পানির কারবার ভালো হলে শেয়ারের দাম বাড়ত। কোনো কোম্পানি বেশি ডিভিডেন্ড দিবে, তা আগে থেকে জানাজানি হলে তার শেয়ারের দাম বাড়ত। ওই বাড়ারও একটা মাত্রা ছিল। জানা গেল যে, কোম্পানি ৩০% ডিভিডেন্ড দিবে তাহলে ২০%, ২৫% বেশি দামেও মানুষ শেয়ার কিনে ফেলত। তদ্রূপ কোম্পানি কোনো সম্ভাবনাময় প্রজেক্ট হাতে নিচ্ছে তাহলে শেয়ারের দাম বাড়ত। এটা এখনও আছে। কিছু দিন আগে গ্রামীনফোন ঘোষণা দিয়েছে যে, টেকনোলজি সংক্রান্ত ওদের একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি আসছে। এই ঘোষণার পরও গ্রামীনফোনের শেয়ারের দাম বেড়েছে। এগুলো হচ্ছে দাম বাড়ার যৌক্তিক বা অর্ধ-যৌক্তিক কয়েকটি কারণ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এ বিষয়গুলো গৌণ। এখন মুখ্য বিষয় হচ্ছে চাহিদা ও যোগান। কাঁচাবাজারে যেমন চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে দাম বাড়ে-কমে, শেয়ারবাজারেও তেমনি। শেয়ারের যোগান কিন্তু নির্ধারিত। কারণ কতগুলো কোম্পানির শেয়ার বাজারে আছে এবং কত শেয়ার আছে তা অজানা নয়। সামান্য কিছু নিরীহ লোক, যারা ঠেকায় না পড়লে স্টক এক্সচেঞ্জে যায় না তাদের শেয়ার ছাড়া অবশিষ্ট শেয়ার নিয়মিত বেচাকেনা হয়। তাই যোগান নির্ধারিত। তবে চাহিদা বিভিন্ন হওয়ার কারণে দাম বাড়ে এবং কমে। চাহিদা বাড়া বা কমার একটি প্রকাশ্য কারণ হচ্ছে মার্চেন্ট ব্যাংক। মার্চেন্ট ব্যাংক যে শেয়ারের জন্য লোন বেশি দিবে তার দাম বাড়বে, যে শেয়ারের জন্য লোন কম দিবে তার দাম কমবে। আগে মার্চেন্ট ব্যাংক বলতে কিছু ছিল না। তবে লোন নিতে চাইলে শেয়ার বন্ধক রেখে সাধারণ ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া যেত। এখন শুধু শেয়ারে বিনিয়োগকারীদেরকে লোন দেওয়ার জন্য মার্চেন্ট ব্যাংক হয়েছে। এই লোন-ব্যবসার কারণে বিনিয়োগকারীকে বেশি টাকা বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। কারণ এতে একদিকে শেয়ারের দাম বাড়ে এবং বর্ধিত মূল্যে শেয়ার খরিদ করতে হয়। অন্যদিকে মার্চেন্ট ব্যাংককে তার লোনের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে হয়! এরপরও চাহিদার কমতি নেই। কারণ মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার কারণে আরো দশজনের ক্রয়-ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে। তারাও কিনবে। ফলে চাহিদা বেশি থাকার কারণে শেয়ারের দাম বাড়ে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, মার্চেন্ট ব্যাংক পুরা ১০০% লোন দেয় না। ওরা ওদের স্বার্থ-রক্ষা করে তারপর লোন দেয়। ৭০%, ৮০% এ রকম দেয় এবং অবস্থা বুঝে দেয়। শেয়ারের দাম কমে গেলেও ক্ষতি নেই। শেয়ারগুলো তাদের কাছে মর্গেজ থাকে। এদের মাধ্যম হয়ে রিলিজ হয়। অনেকটা গ্রামদেশের ফড়িয়াদের দাদনের মতো। মাছের প্রজেক্টে যদি দাদন-লোন দেয় তাহলে মাছ বিক্রির সময় সে উপস্থিত। তদ্রূপ আড়তদার থেকে বাকিতে মাছের খাবার নিয়েছেন তো আড়ৎদারকে সামনে রেখে মাছ বিক্রি করতে হবে। ওদের প্রতিনিধিরা খোঁজ খবর রাখে, কোথায় মাছ বিক্রি হচ্ছে, কোন খামারী মাছ বিক্রি করছে। মার্চেন্ট ব্যাংকের বিষয়টাও এ রকম। পুঁজিপতিরা কীভাবে শেয়ারবাজারকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে এটা তার একটি ছোট দৃষ্টান্ত। শেয়ারের দাম যদি ১০%, ২০%ও কমে যায় মার্চেন্ট ব্যাংক তারটা পেয়ে যাবে। কখনো শেয়ারের দাম অনেক বেশি কমে গেলে মার্চেন্ট ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়ে। তো বলছিলাম যে, মার্চেন্ট ব্যাংক হচ্ছে কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টির একটি উপায়। এই কারণটাকে আগে বললাম এজন্য যে, এটাই এখন বড় কারণ হয়ে গেছে। শেয়ারবাজারের গতি নির্ধারণে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে। এই তো কিছুদিন আগে গ্রামীন ফোনের শেয়ারের দাম যেভাবে বাড়ছিল তাতে অনেক আগেই হয়ত ৫০০/- পার হয়ে যেত, যদি এসইসি আইন করে গ্রামীনের শেয়ারের জন্য মার্চেন্ট ব্যাংকের লোন দেওয়া নিষিদ্ধ না করত। এই আইন করার পর রাতারাতি শেয়ারের দাম কমে গেল। দেখুন, গ্রামীন ফোনের ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে তার শেয়ারের দাম কমেনি। এটা সবাই বোঝে। এজন্য দরপতনের পর বিক্ষোভ হয় এসইসির বিরুদ্ধে। গ্রামীনফোনের বিরুদ্ধে নয়। এমন কথা কেউ বলে না যে, কোম্পানির ডাইরেক্টররা কোম্পানি থেকে মোটা অঙ্কের বেতন নেয় আর বসে বসে মাক্ষি মারে! ফলে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং শেয়ারের দাম কমেছে! আসলে এখনকার শেয়ারবাজার তার নিজস্ব গতিতে চলে। কোম্পানির সম্পদ, ব্যবসায়িক সফলতা-ব্যর্থতা ইত্যাদির সঙ্গে শেয়ারের দাম বাড়া-কমার বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুক্ত নয়। এটা নিয়ন্ত্রিত হয় শেয়ারবাজারের নিজস্ব কিছু বিষয় দ্বারা। একটু নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলেই তা বোঝা যায়। শেয়ারের দাম বাড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে গুজব। কিছু লোক আছে যারা গুজব ছড়ানোর কাজ করে। গুজবটা কাজে লেগে যায়। এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। সৌদী যুবরাজ রূপালী ব্যাংক কিনবে এই সংবাদ আসার পর রূপালী ব্যাংকের শেয়ারের দাম বেড়ে গেল। অথচ সে কয়েক বছর ধরে ডিভিডেন্ট দিতে পারে না, এজিএম করতে পারে না। তার ১০০/- টাকার শেয়ার তিন হাজার টাকার উপরে চলে গিয়েছিল। বছর বছর থেকে লোকসান গুনতে থাকা একটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার তার ফেসভ্যালুর কয়েক হাজার পার্সেন্ট বেশি দামে লেনদেন হল। পরে যুবরাজ যখন আর কিনল না তখন আবার আগের অবস্থায় ফিরে এল। মাঝে প্রায় দু’বছর পর্যন্ত এই শেয়ারের লেনদেন হল অত্যন্ত চড়া মূল্যে। বলাবাহুল্য, যারা আরো বেশি দামে এই শেয়ার বিক্রি করতে পারবে মনে করে সর্বোচ্চ দামে তা কিনেছিল তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তদ্রূপ আগেও বলেছি যে, একটি দু’টি বড় কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়া-কমার কারণেও অন্যান্য কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়ে যায়, কমে যায়। এটা হচ্ছে হুজুগ। বাজারে রব উঠল, বেড়েছে, বেড়েছে, বেড়েছে! কী বেড়েছে, কোনটা বেড়েছে? সবই বেড়েছে!! আবার রব উঠল, কমেছে, কমেছে, কমেছে! দেখা গেল সবই কমে গেছে!!! এছাড়া আইনগত কারণেও বাড়ে কমে। যেমন কোনো সময় এসইসি হুকুম করে যে, অমুক অমুক কোম্পানির শেয়ার স্পটসেল হতে হবে। অর্থাৎ নগদ টাকায় তৎক্ষণাৎ বিক্রি হতে হবে। স্পটসেলের নির্দেশ জারি করলে ওই শেয়ারের দাম কমবে। কারণ অনেকে তা করতে পারে না। আইনগত কারণে শেয়ারের মূল্য বাড়া-কমার আরেকটি দৃষ্টান্ত ‘মিউচুয়াল ফাণ্ড’। মিউচুয়াল ফাণ্ডের শেয়ারের দাম শুধু বাড়তির দিকে যাচ্ছিল। এসইসি আইন করল যে, মিউচুয়াল ফান্ড রাইট শেয়ার, বোনাস শেয়ার দিতে পারবে না। অর্থাৎ শেয়ার-হোল্ডারদেরকে লভ্যাংশ দিতে হলে নগদ টাকায় দিতে হবে, বোনাস শেয়ারের মাধ্যমে দেওয়া যাবে না। অর্থনীতিবিদদের মতে, এসইসির এই আইন যৌক্তিক ছিল। কারণ মিউচুয়াল ফাণ্ডের তো অন্য কোথাও কোনো ব্যবসা নেই। অন্য কোথাও টাকা খাটানো হলে এই যুক্তি চলে যে, কোম্পানি অমুক প্রকল্পে টাকা খাটিয়ে ফেলেছে, অতএব এই মুহূর্তে তা তুলে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। প্রকল্পটি লাভজনক, তবে এই মুহূর্তে লভ্যাংশ নগদ টাকায় দেওয়া যাচ্ছে না। এই যুক্তিতে বোনাস শেয়ার দেওয়া যায়, কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ডের বিষয়টা তো এমন নয়। সে তো ব্যবসাই করে শেয়ারের। বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারই তার এ্যাসেট। আর তা হচ্ছে লিকুইড মানির মতো। যে কোনো সময় তা মার্কেটে বিক্রি করে দিয়ে নগদ টাকা পেতে পারেন, কম পাবেন বা বেশি পাবেন। তাহলে আপনি বোনাস শেয়ার দিবেন কেন? যদি বলেন যে, এখন দাম কম আছে, ভবিষ্যতে দাম বাড়বে, তাহলে এথন এত লাভ দিচ্ছেন কেন? আপনি তো আজকের অবস্থা অনুযায়ী লাভ দিচ্ছেন ভবিষ্যতে দাম বাড়বে, বাড়ুক, কিন্তু আজকেই যখন এত পার্সেন্ট লভ্যাংশ দিবেন তো আপনার কাছ থেকে ওই টাকা বের হয়ে যাবে। এটা আপনি শেয়ার আকারে আটকে রাখতে চাচ্ছেন কেন? যাই হোক, ওই ঘোষণার পরই মিউচুয়াল ফাণ্ডের শেয়ারের দাম কমে গেছে। এরপরে মিউচুয়াল ফাণ্ডওয়ালারা হাইকোর্টে রিট করেছে। বড় বড় উকীল নিয়োগ করেছে। ওই মামলায় এসইসি জয়লাভ করতে পারেনি। এখানে অনেক কথা আছে। সে কথাগুলো এখন থাক। এসইসির একটিই সুযোগ ছিল আপিল করার। তারা আপিলের ঘোষণা দিয়েছে। সে সময় আবার শেয়ারের দাম কমেছে। পরে মিউচুয়াল ফাণ্ডওয়ালারা উচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতাশালীদের সাথে বসেছে। শেষ পর্যন্ত এসইসিকে আপিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হয়েছে। এই দীর্ঘ আলোচনার উদ্দেশ্য একটিমাত্র প্রশ্ন। তা এই যে, এসইসির একটিমাত্র সিদ্ধান্তে হাজার হাজার মিউচুয়াল ফাণ্ডের শেয়ারের দাম কমে যায় কেন? তদ্রূপ এসইসি আপিল করবে না বলে ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথে দাম বাড়ে কেন? উপরন্তু মিউচুয়াল ফাণ্ড তো এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, যার নিজস্ব কোনো ব্যবসা আছে। অন্যান্য কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচাই তার কাজ। অথচ সেও বোনাস শেয়ার দিতে পারে, রাইট শেয়ার দিতে পারে, তার শেয়ারের দামও বাড়ে এবং কমে। এই সকল বাস্তবতা যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নির্দেশ করে তা এই যে, শেয়ারবাজার নিজেই একটি ভিন্ন সত্তা। ইতিপূর্বে কোম্পানিকে আইনগত ব্যক্তি-সত্ত্বা বলা হয়েছে, এখন শেয়ার-বাজার নিজে একটি সত্তা হয়ে গিয়েছে। এটি স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি মার্কেট এবং এখানে লেনদেনের ক্ষেত্রে কোম্পানির নামটাই শুধু ব্যবহৃত হয়। কোম্পানির ব্যবসায়িক উন্নতি-অবনতি, ব্যবসার ভালো-মন্দ ইত্যাদির সঙ্গে এর উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পর্ক এখন আর অবশিষ্ট নেই। একটি উদাহরণ দ্বারা বিষয়টি পরিষ্কার করছি। বর্তমানে প্রতি ৬ মাস অন্তর কোম্পানিগুলোকে তাদের আর্থিক বিবরণী প্রকশ করতে হয়। সেখানে কোম্পানির নেট এসেট ভ্যালু, শেয়ার প্রতি আয় ইত্যাদি তথ্য থাকে। তো সদ্য প্রকাশিত গ্রামীনফোনের আর্থিক বিবরণীতে তারা বলেছে তাদের আর্নিং পার শেয়ার তথা শেয়ার প্রতি আয় ১২/-টাকার কিছু বেশি। অথচ শেয়ারবাজারে তখন গ্রামীনফোনের শেয়ার বিক্রি হচ্ছিল ৩০০/- টাকার অধিক মূল্যে। চিন্তা করুন, যেখানে কোম্পানি নিজেই তার শেয়ার প্রতি আয় ঘোষণা করছে ১২/-টাকা কয়েক পয়সা, সেখানে ১০/-টাকা ফেসভ্যালুর ঐ শেয়ার মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে হাজার পার্সেন্ট বেশি মূল্যে। শেয়ারবাজারের লেনদেনগুলো যে মানি-গেমের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে তা বুঝার জন্য উপরোক্ত উদাহরণই মনে হয় যথেষ্ট।

প্রশ্ন : শেয়ারবাজারে কৃত্রিমভাবে দরবৃদ্ধির একটি বিষয় আছে, এ প্রসঙ্গে কিছু বলুন।

উত্তর : শেয়ারবাজারের একটি গতি আছে, যা অনেকটা জুয়ার মতো। জুয়াতে মানুষ সর্বস্ব হারায় কীভাবে? দু’এক বার যখন টাকা পায় তখন সে ভাবে যে, আরো পাব। তাই উঠে আসে না। বার বার টাকা বিনিয়োগ করে। এরপর যখন হারতে থাকে তখন ভাবে যে, এই বার ঘুরে আসবে। কিন্তু ঘোরে না। শেষে নিঃস্ব হয়ে বের হয়ে আসে। এটা জুয়ার ধারা। এভাবেই জুযা মানুষকে শেষ করে দেয়। অর্থনীতিবিদরা বলেন যে, শেয়ার বাজারেরও এমন একটি গতি আছে। শেয়ারের দাম যখন বাড়তে থাকে তখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হাতের শেয়ার বিক্রি করে না। খালি কিনে। তারা ভাবে যে, দাম তো বাড়ছে, আরো বাড়বে, দেখি না কোন পর্যন্ত যায়। দেখতে দেখতে একসময় দাম কমতে থাকে। সে তখন ভাবে যে, এখন বেচলে তো লস হবে তাই পুনরায় দাম বাড়ার অপেক্ষা করে। কিন্তু পিছনে কোনো কারসাজি থাকলে দাম আর বাড়ে না, কমতেই থাকে। ৯৬ সালে এমন একটি মহা কেলেঙ্কারি হয়েছিল। প্রথমদিকে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বেড়েছে। দু’ সপ্তাহের মাঝে একেকটি শেয়ারের দাম ২০০%, ৩০০%, ২০-৩০ গুণ বেড়েছে। তখন প্রথম সাড়ির কোম্পানিগুলোর সাথে সাথে প্রায় সকল কোম্পানির শেয়ার এমনকি জেড গ্রুপের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামও বেড়েছে। যাদের অনেকের সেভাবে অফিসও নেই, কারবার তো নেইই। কয়েক বছর থেকে এজিএম করে না, ডিভিডেন্ট দেয় না। একপর্যায়ে শেয়ার বাজারে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। তখন সব কাজ স্টক এক্সচেঞ্জে গিয়ে করতে হত। এখনকার মতো বিভিন্ন জায়গায় ব্রোকারেজ হাউস ছিল না। যখন শেয়ারের দাম বাড়ছিল তখন ইচ্ছামতো সবাই কিনেছে। আজকে কিনলেই কালকে লাভ। অসংখ্য মানুষ জমি-জমা বিক্রি করে, হালের গরু বিক্রি করে, এমনকি ভিটেবাড়ি বিক্রি করে শেয়ার কিনেছে। হঠাৎ করে শোনা গেল যে, সব শেয়ারের দাম আজকে কমে গেছে। যে শেয়ারের দাম উঠেছিল ৩০০০/- টাকা আজকে তা ২৮০০/- টাকা হয়ে গেছে। এর পরের দিন ২৫০০/-টাকা, পরের দিন ২২০০/- টাকা। এভাবে আবার ওই ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে ১৫০/- টাকার নিচে নেমে আসে। তখন মানুষের হাহাকার, মিছিল, কান্নকাটি! তো সে সময় কী ঘটেছিল? এখন আর তা অনুমান করে বলতে হবে না। ওই সময়ই অনেকে বলেছিলেন, পরে এটা নিয়ে মামলা হয়েছে, তদন্ত হয়েছে, তদন্ত-কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাতে সব ঘটনা বের হয়ে এসেছে। একদল দেশি-বিদেশি কুচক্রী কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল। একপর্যায়ে তারা তাদের সব শেয়ার বিক্রি করে মার্কেট থেকে বের হয়ে যায়। ফলে অস্বাভাবিক দামে শেয়ার ক্রয়কারী চক্রের অনুপস্থিতির কারণে শেয়ারের দাম আগের জায়গায় ফিরে আসে। মাঝে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যায়। এখনকার মার্কেট যদি হত তাহলে সেটা হত বাংলাদেশের জন্য মহা বিপর্যয়। কারণ এখনকার মার্কেট তখনকার মার্কেটের চেয়ে অনেক বড়। শেয়ার অনেক বেশি, ইউজারের সংখ্যাও অনেক বেশি।

প্রশ্ন : এখনকার বাজারেও কি এ ধরনের কারসাজি করা সম্ভব? এখন বাজার যেমন বড় তেমনি সিকিউরিটির জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠানও তো আছে?

উত্তর : জ্বী, এখনও সম্ভব। ছোটখাটো কিছু দৃষ্টান্ত তো চোখে পড়ে। এই তো কিছুদিন আগে গ্রামীন ফোনের শেয়ারের দাম শুধু বাড়ছিল। সম্ভবত ঘটনাটা এমন হয়েছে যে, কিছু বেনামী বিও একাউন্টধারী সিণ্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছিল। অর্থাৎ তারা বিভিন্ন বিও একাউন্ট থেকে একযোগে গ্রামীনের শেয়ার বেশি দামে কিনছিল। এক পর্যায়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও বেশি দামে শেয়ার কিনতে আরম্ভ করে। যে দামে প্রস্তাব হয় সে দামেই কেনে। এসইসি চিন্তা করেছে যে, তার সমস্যা হবে। ১০/-টাকার শেয়ার ৪০০-৫০০/- টাকার কাছাকাছি হয়ে গেছে, এভাবে দাম বাড়তে থাকলে ৭০০-৮০০/-টাকাও হয়ে যেতে পারে। যে সিণ্ডিকেট দাম বাড়িয়েছে তারা যদি ইতিমধ্যে তাদের শেয়ার ছাড়া শুরু করে থাকে তাহলে তাদের শেয়ারগুলি ছাড়া শেষ হলেই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিপদে পড়বে। তো এসইসি ঘোষণা করেছে যে, গ্রামীন ফোনের সকল শেয়ার স্পট সেল হতে হবে। অর্থাৎ নগদ-নগদে জায়গাতে বিক্রি হতে হবে। এটার জন্য কোনো লোন নেওয়া যাবে না। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে বলে দেওয়া হয়েছে যে, গ্রামীন ফোনের শেয়ারের জন্য কোনো লোন দেওয়া যাবে না। এসইসির এই হস্তক্ষেপের কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাদের শেয়ারের দরপতন হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই যে এসইসি সফল হবে বা তাকে সফল হতে দেওয়া হবে এটা অপরিহার্য নয়। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি চিটাগাং ভেজিটেবল এর কথাই ধরুন। গত এক মাসে এর শেয়ারের দর বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬০%। বর্তমানে ১০০/-টাকার শেয়ার বিক্রি হচ্ছে ১০০০/- টাকার উপরে। অথচ বিগত ৬ বছরে কোম্পানিটি কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি শেয়ারহোল্ডারদেরকে। এর মূলধনের বিশাল ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি এ শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে পারছে না।

প্রশ্ন : সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা এবং বাজারকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য এই সংস্থার কার্যক্রমকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

উত্তর : এটা ঠিক যে, এসইসি বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এজন্য সময় সময় আইন কানুন করে। কিন্তু একদিকে আইন তৈরি হয়, তো বাজার অন্য দিকে ঘুরে যায়। বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে বাজারকে রক্ষা করার চেষ্টা এসইসির থাকে। কারণ সরকার বোঝে যে, বর্তমান অবস্থায় যদি বাজারকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে আমাদের এসব দেশে বিশাল সংখ্যক মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে, যা সরকারের জন্যও বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। তবে এরপরেও কথা আছে। চিন্তা করলেই বুঝবেন। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা যদি বলেন তো এটা মুখ্য বিষয় নয়, শেয়ারবাজারের মুখ্য বিষয়ই হল পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা। এর সাথে যদি কখনো সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরও কিছু লাভ হয় ভালো। পুঁজিপতিদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাধ্য এসইসির আছে বলে মনে হয় না। এসইসির কোনো চেয়ারম্যান যদি ভদ্রলোক হয়ে কোনো কিছু করতে চান তাহলে কয়েকদিন পরেই তাকে সেখান থেকে সরে যেতে হবে, অথবা ম্যানেজ্ড হতে হবে। আসলে পেছনের শক্তিগুলো অনেক বড়। এজন্য প্রথমে দু’ একজন চাইলেও পরে বুঝতে পারেন যে, নেপথ্যের শক্তির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তাদের কাজ নয়।

প্রশ্ন : কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের আলোচনায় দেখা যায়, তারা শেয়ারবাজারের কারবারকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জুয়া বলে থাকেন। শরীয়তের দৃষ্টিতে কি এটাকে জুয়া বলা যায়?

উত্তর : আমরা বলতে চাই যে, কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের মধ্যে কোম্পানির অংশীদারিত্ব, লাভ-লোকসানের দায় গ্রহণ ইত্যাদি কোনো কিছুই যদি মূল উদ্দেশ্য না হয় তাহলে বলতে হবে যে, কোম্পানির শুধু নামটিই ব্যবহৃত হচ্ছে। খুব ক্ষীণ যে সূত্রটি এখনো আছে, অর্থাৎ আপনার হাতে যদি কোম্পানির শেয়ার থাকে তাহলে এ মুহূর্তে ডিভিডেন্ড ঘোষণা করলে আপনি তা পাবেন-শুধু এর কারণে গোটা কারবারকে কোম্পানির অংশের লেনদেন বলা যায় কি না-এটা চিন্তা করা দরকার। তাছাড়া ডিভিডেন্ট তো ঘোষণা হয় বছরে একবার, আর কোম্পানির শেয়ার বিক্রি হয় প্রতিদিন। অনেক শেয়ার দৈনিক কয়েকবার পর্যন্ত লেনদেন হয়। আগে তা হতে পারত না, এখন স্পটে তা হয়। এরপরও যেহেতু অতি ক্ষীণ হলেও একটি যোগসূত্র আছে সেজন্য এবং এ ধরনের কিছু বিষয়ের কারণে আমরা একে সরাসরি ফিকহের পরিভাষার কিমার বা জুয়া বলি না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এর গন্তব্য ওইদিকেই। ধীরে ধীরে তা সম্পূর্ণ টাকার খেলায় পরিণত হচ্ছে। এজন্য যে ফিকহের কথা বলবে তার দায়িত্ব হল এখন থেকেই বাধা সৃষ্টি করা। ছাদ্দুল বাব তথা আগে থেকেই সতর্কতামূলক দরজা বন্ধ করা ইসলামী ফিকহের একটি বড় মূলনীতি। বর্তমান অবস্থাতেই তো এটি বহু কারণে বৈধ নয়। এমনকি আপনি যদি পাকিস্তানের ইমরান আশরাফ সাহেবের মতকেও গ্রহণ করেন তবুও বৈধ নয়। কারণ আগেই বলা হয়েছে যে, এখন অধিকাংশ কোম্পানিরই ব্যাংক-লোন চল্লিশ পার্সেন্টের বেশি। এমন কোনো উৎপাদনকারী কোম্পানি খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে, যার ৪০ পার্সেন্ট ব্যাংক-লোন নেই। লোনটাই কোম্পানির জন্য সহজ এবং সেটাই তারা নেয়। তদ্রূপ ব্যাংকগুলোও চলে কর্পোরেট লোনের আয় দিয়ে। যাই হোক, একে সরাসরি ফিকহি পরিভাষার জুয়া হয়তো অনেকে বলবে না, কিন্তু বিষয়টি জুয়ার মতো এবং ধীরে ধীরে তা সেদিকেই যাচ্ছে।

প্রশ্ন : কেউ যদি শেয়ার বাজারের উপরোক্ত বেচাকেনায় অংশগ্রহণ না করে; বরং বাস্তবেই কোনো কোম্পানির ডিভিডেন্ট গ্রহণ করার জন্য শেয়ার কিনে রেখে দেয় তাহলে কি এটা জায়েয হবে? যে চার শর্তে কোম্পানির শেয়ার কেনার বৈধতা কোনো কোনো কিতাবে পাওয়া যায় তা কি এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলে ধরে নেওয়া যায় না?

উত্তর : এখন তো এসব শর্ত-শরায়েত শেয়ার বেচাকেনার ক্ষেত্রেই বলা হয়। যারা এসব শর্তের কথা বলেন তারা তো শুধু প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখেন না। আপনারা যদি গোড়ার কথাটা বুঝে নেন তাহলে এই প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে যাবেন। আমি আপনাদের প্রশ্ন করি, কোনো ব্যবসায়ী যদি জিজ্ঞাসা করে যে, আমার ব্যবসার মূলধন এক লক্ষ টাকা। ব্যবসা চলছে, কিন্তু আরো দশ হাজার টাকা যোগ করলে ব্যবসাটা একটু ভালো চলবে। আমি এই অংশটা কি সুদের ভিত্তিতে নিতে পারি? কোনো মুফতী কি বলবে, আপনি সুদী লোন নিতে পারেন? ব্যক্তিগত পর্যায়েও কাউকে ফাতোয়া দিবে? দিবে না। যদিও অংকটা মূলধনের ১০ ভাগের এক ভাগমাত্র। অথচ একই জিনিসকে কোম্পানিতে গেলে জায়েয মনে করা হয়। অন্যভাবে বলা যায় যে, একটি দোকান দশ জনে মিলে শুরু করেছে। প্রত্যেকে ১০ হাজার টাকা করে ১ লক্ষ টাকা পুঁজি সংগ্রহ করেছে। আরো ২ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। তো ৬০ হাজার টাকা ব্যাংক-লোন নেওয়া হল। অবশিষ্ট টাকা সংগ্রহের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, আরো ১৪ জন অংশীদার নেওয়া হবে। তাহলে অবশিষ্ট ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা যোগার হয়ে যাবে। তাহলে দেখছেন যে, ব্যবসার মূলধন ৩ লক্ষ টাকা। অংশীদার ২৪ জন। ব্যাংক-লোন আছে ৬০ হাজার টাকা, যার সুদ আনুপাতিক হারে সকল শেয়ার-হোল্ডারের উপরই আসবে। অংশীদার নেওয়ার সময়ও বলে দেওয়া হয়েছে যে, আমাদের পুঁজিতে এই পরিমাণ ব্যাংকলোন আছে। এখন এই ব্যবসায় অংশীদার হতে ইচ্ছুক কোনো ব্যক্তি যদি জিজ্ঞাসা করেন যে, আমি এই ব্যবসায় শরীক হতে পারি কি না? কোনো মুফতী কি উত্তরে বলবে, শরীক হতে পারেন তবে শর্ত হচ্ছে আপনাকে একটি প্রতিবাদ করে দিতে হবে। এরপরও যদি অন্য শরীকরা সুদী লোন অব্যাহত রাখে তাতে আপনার অসুবিধা নেই। নিশ্চয় শরীকানা কারবারের ক্ষেত্রে এমন কথা কেউ বলবে না। কারণ সুদ দেওয়া-নেওয়া এককভাবে যেমন নিষেধ, তেমনি শরীকানাভাবেও নিষেধ।

প্রশ্ন : অনেকে যুক্তি দেন যে, কোম্পানিতে আইনগত সত্তা সৃষ্টি হয়। ফলে ডাইরেক্টর ও শেয়ার-হোল্ডারদের সম্পর্ক উকীল-মুয়াককিলের হয়ে যায়। সকল সিদ্ধান্ত ডাইরেক্টররাই নিয়ে থাকে, সাধারণ শেয়ার হোল্ডাররা কোম্পানির বাইরে থাকে। তাদের তেমন ক্ষমতাও থাকে না। তাই ডাইরেক্টরদের গৃহীত সকল সিদ্ধান্তকে শেয়ার-হোল্ডারদের দিকে নিসবত করে দেওয়া ঠিক না?

উত্তর : এই ধরনের কথা খুচরা-খাচরি মাকরূহ পর্যায়ের বিষয়ে চলতে পারে, সুদের মতো অকাট্য হারামকে বৈধ করার জন্য চলতে পারে না। দেখুন, কোনো কোনো কিতাবে মালে মাখলূতের প্রসঙ্গ আছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারবার নাজায়েয হলেও কামাই বৈধ হওয়ার প্রসঙ্গ আছে। এসব বিষয়ের বিশ্লেষণে এই মুহূর্তে যেতে চাই না, আমি শুধু বলতে চাই যে, ওইসব কথাও এই ক্ষেত্রে বলার যোগ্য বিষয় নয়। এগুলো যদি বলেন, তাহলে আপনি সুদের রাস্তা খুলে দিলেন। মানুষ সরাসরি সুদ নিবে না, সোনালী, রূপালী, অগ্রণীতে যাবে না; বরং শেয়ারবাজারে ঢুকেই সুদের বাজারকে গরম রাখবে। সুদকে এত কঠিনভাবে হারাম করা হয়েছে কি আপনার এইসব কাজ করার জন্য? এখানে একটি মৌলিক বিষয় আছে, যা বিবেচনায় রাখা খুবই জরুরি। তা হচ্ছে, আপনি নতুন করে শেয়ার বাজারে ঢুকবেন। আগে থেকেই আপনার জানা আছে যে, এই কোম্পানির কারবারে এই এই হারাম আছে, কারবার করার সময় এরা হালাল-হারাম বাছাই করে না, লোন নেওয়ার সময় হালাল তরীকা-হারাম তরীকা বাছাই করে না, তবে কোম্পানির মূল কাজ হালাল। যেমন বেক্সিমকো ফার্মা, স্কয়ার ফার্মা, অল্প কিছুদিন হল গ্রামীনফোন এসেছে। এটা এক প্রসঙ্গ। পক্ষান্তরে আরেকজন ব্যক্তি আগে থেকেই শেয়ার বাজারে আছে, শেয়ার যখন কিনেছে তখন জিজ্ঞাসা করেনি বা জিজ্ঞাসা করলেও নফসের ধোকায় আমল করেনি। এখন তার বুঝ হয়েছে, এখন তার করণীয় কী-এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এটা হচ্ছে তাফাসসী আনিল হারাম তথা হারাম থেকে নিস্তার পাওয়ার বিষয়। এর অবস্থা হচ্ছে ওই ব্যক্তির মতো যে ব্যাংকে টাকা জমা রেখেছে এবং তার একাউন্টে সুদ এসে গেছে। পার্থক্য শুধু এই যে, শেয়ার কিনলে হয়ত পুরো টাকাটা হারাম হবে না, পক্ষান্তরে ব্যাংকে সুদী একাউন্ট হলে প্রাপ্ত সুদ পুরোটাই হারাম, তবে ওখানে যা বলবেন এখানেও তাই বলবেন যে, আপনি উপার্জনের এত ভাগ সদকা করে দিন। কিন্তু যে ব্যক্তি শেয়ারবাজারে নতুন ঢুকতে চাচ্ছে, তাকেও কি আপনি ওই কথাই বলবেন? কোম্পানি সুদী কারবারের সাথে জড়িত থাকলেও আপনি ঢুকতে পারেন-যদি তার মূলধনের ৪০% এর বেশি সুদী না হয়? তাহলে তো একজন মুসলমানকে সুদী কারবারের সাথে যুক্ত করলেন! এ ধরনের ক্ষেত্রে আমি বলি, ভাই! আমরা আখেরী যমানায় আছি। সময়টা কঠিন। এই বাস্তবতা আপনাকে স্বীকার করতে হবে এবং এজন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। কষ্ট করে হলেও আমাদেরকে হালাল পথেই চলতে হবে এবং এখনো দুনিয়াতে হালাল মোতাবেক চলা অসম্ভব হয়ে যায়নি। এখন তো শেয়ারবাজার অনেক বড়, কিন্তু বলুন তো বাংলাদেশের কত পার্সেন্ট লোক শেয়ারবাজারে আছে? যারা বাইরে আছে তাদের রিযিকের ব্যবস্থা কীভাবে হচ্ছে? আপনি একে ইযতিরার ও নিরুপায় অবস্থার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন কেন? মানুষ কীভাবে যে ইযতিরার তৈরি করে তা আমি ছাত্রদেরকে অনেক সময় বলি। বড় বড় কোটিপতিদের ইযতিরারের হাকীকত বলেছি। সুদী লোন নিতে চায়, সুদী কারবার করতে চায়, এসে ইযতিরারের অবস্থা শোনায়, এমনভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে যে, তার এখন নিরুপায় অবস্থা! আমরা যারা মাসআলা বলি তাদের সাবধান থাকা উচিত, মানুষ কিন্তু আপনার উপর সওয়ার হয়ে সুদ খাবে। আপনি কেন দায় নিবেন? আমরাও কোনো কোনো প্রশ্নকারীকে বলতে বাধ্য হই যে, দেখুন ভাই, আপনি সুদ খাবেন তো এতে আমাকে জড়াচ্ছেন কেন? আপনি নিজে নিজে করলে আল্লাহর কাছে আপনি জবাব দিবেন, আমি অনুমতি দিলে এর দায় আমার উপর আসে। আমাকে জড়াবেন না। তখন বলে, হুজুর! অনেকে তো জায়েয বলে। আমরা বলি যে, যারা জায়েয বলে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন। আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে আপনার সমস্যা হবে, আমরা যা বুঝি তাই আপনাকে বলব। যাই হোক, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইযতিরারের দাবি ঠিক নয়। দুনিয়াতে হালাল উপার্জনের সব রাস্তা এখনো বন্ধ হয়নি।


[চলবে]
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:০৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪

বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×