somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মৃত্যুর আগে

০৬ ই অক্টোবর, ২০১১ রাত ২:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[কলেজ সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় আমি এই রাজনীতিক গল্প-টা লিখেছিলাম, এটা আমার জীবনে লেখা প্রথম গল্প; লেখা হয়েছিল কলেজ ম্যাগাজিন-এর জন্য, ১৯ বছর বয়সে; যদিও শেষ পর্যন্ত আমার গল্প-টা ছাপানো হয়নি; তবে আইরিন পারভিন ম্যাম আমাকে বলেছিলেন যে আমার গল্প-টা মানহীন নয়, ছাপানো হয়নি একটি ক্যান্টনমেন্ট কলেজের 'রাজনৈতিক বাস্তবতার' কারণে; তাই তাঁর কথার উপর ভরসা করে গল্প-টা অনলাইনে প্রকাশ করার দুঃসাহস দেখালাম । সামান্যসংশোধিত রূপে গল্প-টা প্রকাশ করা হল]



"কলকেতার রাস্তায় ডেরেন দিয়ে কলকল করে মানুষের রক্ত বয়ে যেছে। মোসলমানের রক্ত, হিঁদুর রক্ত। আলেদা কিছুই লয়, একই রক্ত। ঐ ডেরেনে হিঁদু-মোসলমান এক।" (আগুন্পাখি : হাসান আজিজুল হক)

আবুল বাশারের চোখে পানি আসছিল বারবার। এবং তিনি বিস্মিত হয়ে ভাবছিলেন, "এই প্রায়মৃত অক্ষম শয্যাশায়ী লোকটিকে আমি কি চিনি?" নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেকে নিজেই দিলেন তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে,"আমি চিনি" তারপর একটু দম নিয়ে আবার মনে মনে মনকে বললেন,"মানুষ অন্য কাউকে চিনতে না পারলেও নিজেকে কি করে অচেনা বলবে, সেটা কি সম্ভব? আমি চিনি আমাকে। যতই অপরিচিত মনে হোক, এটা তো সত্য যে আমি আবুল বাশার !"

তিনি শুয়ে ছিলেন শাদা বিছানায়। কিছুক্ষণ আগেও ঘরটা ছিল অন্ধকারের মত নিঃশব্দ। কিন্তু যখন ঘরের বাসিন্দারা বুঝতে পারল আলো আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে আবুল বাশারের জীবনের, তখন নীরবতা ভাঙল। কিছু নারীকণ্ঠের হালকা কান্নার শব্দে ভরে উঠলো ঘরখানি। অবশ্য দুই এক জন ধার্মিক বিড়বিড় করে সূরা পড়ছিলেন। তারা বুঝতে পারছিলেন দ্রুত নিভে আসছে আলো। তাই কান্নাকাটি না করে প্রার্থনামগ্ন হওয়াটাই তারা ভালো মনে করছিলেন।

আবুল বাশারের একটা আজন্ম ইচ্ছা ছিল : মৃত্যু যখন আসবে তখন যেন তা একাই আসে, যাতে সাথে করে না নিয়ে আসে চলে যাওয়া সময়ের স্মৃতি। কিন্তু ইচ্ছেটা পূরণ হলো না ! শেষবারের মতন স্মৃতি হাতড়ানোর সুযোগ পেয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলেন না তিনি, কষ্টে কেঁদে উঠলেন একটু শব্দ করে।

আজরাঈল এসে গেছে ভেবে মহিলার দল জোরে জোরে সূরা পড়তে লাগলেন !

আর আবুল বাশারের মনে পড়তে লাগল টুকরো টু্করো সব স্মৃতি বিগতজীবনের...

বাবার হাত ধরে কুমিল্লায় এসেছিলেন কুমিল্লায়। কতই আর বয়স তখন? সাত, বা বড়জোর নয়। এর বেশি নয়।ভয়ে কাঁপছিলেন তিনি। মাত্র এক বছর আগেই দেখছেন মৃত্যুর দিনন্রাত্রি। ছুরি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পরস্পরের উপর হিন্দু মুসলমান, ঘরহীন হয়েছিল লক্ষাধিক লোক, মরে গিয়েছিল চার সহস্রেরও বেশি। "আজও যদি তেমন কিছু হয়" এই ভাবনা আতংকিত করে রেখেছিল সারাক্ষণ। শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। আঠারোই আগস্ট ১৯৪৭-এর ভোরবেলায় তিনি প্রবেশ করেছিলেন স্বপ্নের 'পবিত্রভূমি'-তে। বাবার হাত ধরে। পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা শহরে।

আবুল বাশার-এর চোখের কিনারে একফোঁটা অশ্রু, অনেক কষ্ট হচ্ছে তার মায়ের মুখটা মনে করতে; কিন্তু কিছুতেই পারছেন না। ছয় বছর বয়স তার যখন, হিন্দু-রা বটনি দিয়ে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করছিল তার মাকে ; পার্টিশনের কোনো এক 'ধর্মীয়' মুহূর্তে। বাবার কাছে বড় হয়ে শুনেছেন এই কথা।

পূর্ব পাকিস্তানের ছোট এক জেলা শহরে তার বাবা একমাত্র ছেলেকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন। আজ, এই শেষের সময়ে, আবুল বাশারের চারপাশে যারা আছে তারা প্রায় সবাই তার স্ত্রীর আত্মীয়স্বজন।নিজের অতীত-টা অন্ধকারই ছিল সবসময় আবুল বাশারের কাছে। সেই আঁধার দূর করার চেষ্টা কখনোই করেননি আবুল বাশারের বাবা। তারও অবশ্য আগ্রহ ছিল না কোনোকালেই।



ফুল দিয়া পূজা দাও কোন শিবলিঙ্গ-রে ? মাইয়া নিয়া ঢলাঢলি কর কোন জঙ্গলে ? ( শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াকে কটাক্ষ করে পাকিস্তানের '"তমুদ্দুন-পন্থী"-দের বানানো ছড়া )

কলেজে পড়েন যখন তিনি, তখন তার বাবা লোকান্তরিত হন। মাথায় একটা অদৃশ্য আকাশ আছড়ে পড়ে তার। সেই আকাশকে স্বস্থানে ফেরাবার উদ্যোগ নেন এক ভদ্রলোক, অনেকটা আকস্মিকভাবেই। আবুল বাশার এই ঋণ পরিশোধ করেন ভদ্রলোকটির কালো চামড়ার 'আইবুড়ি' কন্যাকে বিয়ে করার মাধ্যমে। সাবেরীর সাথে বিয়ে হবার সেই অতিনাটকীয় স্মৃতি মনে আসায় মৃদু হাসি ফুটলো আবুল বাশারের মুখে। তার জীবনের শেষ হাসি !

শ্বশুড়ের টাকায় পড়াশোনা ভালোই চলছিল, মেসে থাকতেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে খুব ভাল রেজাল্ট ছিল ম্যাট্রিকুলেশন ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায়। তাই প্রতি মাসে বৃত্তি পেতেন। সেই টাকা টুকিটাকি কাজে ব্যাবহার করতেন, শ্বশুড়ের কাছে মিনিটে মিনিটে যাতে যেতে না হয়।

জীবনের গতি বদলে দেওয়া একটি ঘটনা ঘটে গেল সেই মেসেই।

ইফতেখার ভাই ছিলেন তার রুমমেট। রাজনীতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে যার খ্যাতি ছিল মেসে; আলাদাভাবে। একদিন ইফতে ভাই কাঁধে হাত রেখে বললেন তাকে নরম গলায়, " কি মিয়া ! শুধু পড়াশোনা করলেই চলবে? দেশ নিয়ে চিন্তা ভাবনা কর না কিছু? "

আজ আবুল বাশারের আফসোস হচ্ছে সেই সময়ের সিদ্ধান্তটির জন্য, যা তার জীবন বদলে দিয়েছিল পুরোপুরি। তিনি সেদিন, ও তার পরের কয়েকটি দিন, ইফতে ভাইয়ের কথাবার্তায় প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন, যা তাকে নিয়ে গিয়েছিল এক অদ্ভুত অন্ধকারের দিকে।

তিনি যোগ দেন ইসলামি ছাত্রসংঘে।

তারপর সময়গুলো কেটে গেল খুব দ্রুত, অথচ অত্যন্ত উত্তেজনায়। সেইসময়ে কাঁপতেন তিনি আদর্শের আবেগে। নেতাদের মুখনিঃসৃত প্রতিটি কথা মনে হতো তার কাছে পবিত্র, অজর। পবিত্রভূমি পাকিস্তানে রক্তে মাংসে জিন্দা হচ্ছে ইসলাম, এ আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে সবখানে; এরকম একটা স্বপ্নে মগ্ন থাকতেন তিনি দিবস রজনী।

তাই স্বাভাবিকভাবেই মাথায় কাপড় না দেওয়া মেয়ে সহপাঠীদের দিকে, তার 'সাথী ভাই"-দের মতই, তিনি জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাতেন; ক্রোধে তার মুখ বিকৃত হয়ে যেত; এবং তিনি মাঝেমাঝে বিস্ময়ে বলতেন অন্যদের, "এই হারামজাদীগুলার দুযখের ভয় নাই !!!"

তিনি অবশ্য আদর্শবাদে বিশ্বাস করতেন। তাই তার সর্বোচ্চ নেতা যেদিন বাণী দিলেন : পাকিস্তান হচ্ছে আল্লাহর ঘর ; সেদিন তার সারা গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। তবে নেতার কথার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস হয়নি তার, সহ্য করছিলেন কথাটা (একাত্তরের সেই সাররিয়েলিস্টিক সময়ে অবশ্য অনেককিছুই তিনি সহ্য করেছেন)



নন্দরাণীর রক্তমাখা শাড়ির আঁচল
উড়ছে হাওয়ায়
নেবুবনে বিষন্নতার দোয়েল পাখি
....................
( মুজিবুল হক কবির )


ভাবতেন জিহাদিদের "জোশ" ও "জজবা" বাড়ানোর জন্য হয়তো এমন কিছু কথা বলা লাগে, আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন !

১৯৭১।- চার সংখ্যার এই সমষ্টি-টির কথা মনে পড়তেই দুঃখভারাতুর হয়ে উঠলো আবুল বাশারের মন।সেই "জুলমাত" সময়টাতে; তিনি ও তার সাথী ভাইরা বলতেন "গন্ডগোলের বছর"; যখন তিনি ও তার মতো অনেক তরুনই ছিলেন উদ্ভ্রান্ত, তখন "পাঞ্জেরি" হয়ে পথ দেখিয়েছিল সংঘ। তাকে বোঝানো হয়েছিল পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনির সাথে কখনোই পেরে উঠবে না "মালাউন ও মোনাফেকের জাত" বাঙালিরা। তাকে বলা হয়েছিল মুক্তিবাহিনী যে বাংলাদেশ-এর কথা বলে তা তিনদিনও টিকবে না। তাকে দীক্ষা দেওয়া হয়েছিল এই বলে যে, আল্লাহ ও তার সকল ফারিশতা রয়েছে পাক সার জমিন সাদ বাদ-এর পক্ষে। তখন তার হৃদয়ে মওদুদী, রক্তে সায়ীদ কুতুব আর চেতনায় সংঘ ছাড়া আর কিছু নেই।

তিনি ঈমান এনেছিলেন এইসব "সত্যে" যে, শেখ মুজিব একটা ইন্ডিয়ার দালাল, রুশ-ভল্লুকদের এজেন্ট; বিক্রি করে দেবেন তিনি এই নতুন রাষ্ট্রটিকে ( অবশ্য আদৌ যদি স্বাধীন হয় কখনো, তাহলে ) ভারতের কাছে; পরিণত হবে এটি ভারতের একটি করদ রাজ্যে। তখন আবার গোলামী করতে হবে হিন্দুর।

হিন্দুর ! চমকে উঠেছিলেন তিনি, হয়ে পড়েছিলেন আতংকিত; এই "ডেডাইয়াগুলার" দাসত্ব করা লাগবে... যারা ইসলাম ও মুসলমানের চিরশত্রু; যারা মদ খেয়ে ঢোল বাজায়, যাদের মায়েরা মেয়েরা বেপর্দা বেলেহাজ, যারা মূ্তিপূজা করে ( যেই পৌত্তলিকতা নির্মূল করার জন্যে ইসলামের নবী অনেক কষ্ট করেছেন ), যারা তার মাকে হত্যা করেছে ৪৬-এর দাঙ্গায় ও তার মত বহু মুসলমানের জীবন ও সম্মানের বিনাশ ঘটিয়ছে...... তাদের দাসত্ব করা লাগবে !!!

চোখের কিনারে অশ্রু জমলো তার।মনে পড়লো পরিতোষ স্যরের ছোট্ট মেয়েটার কথা... নীলার কথা

জিলা স্কুলে ক্যাম্প বসিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেই দলটি। মেজর আনোয়ার আহমেদ অত্যন্ত পছন্দ করেছিলেন সংঘের এই ত্রিশ বছর বয়সী সুদর্শন যুবকটিকে। মুক্তিবাহিনির বিরুদ্ধে একটি অপারেশন সফল হওয়ায় মেজর সাহেব ভাবলেন একটু আনন্দ ফূ্র্তি করলে কেমন হয় !!! ক্যাম্পেরই একটা অংশে তৈরি করা হয়েছিল "হারেম" । সৈন্যদের ও অফিসারদের "শারীরিক চাহিদা" মেটানোর জন্য মেয়ে ধরে আনা হতো; আনতো রাজাকাররা। আবুল বাশার অবশ্য এসব করতেন না, তিনি তো আর রাজাকার ছিলেন না; ছিলেন সংঘের শিক্ষিত ও দীক্ষিত সদস্য। এলাকার উৎসাহী পাকিস্তানপন্থী তরুন ও যুবকদের খুঁজে বের করা এবং তাদের পবিত্রভূমির অখন্ডতার প্রতি আস্থাবান করে তোলা, কুমিল্লার ঘরে ঘরে লিফলেট বিলানো যাতে পাকিস্তানের "দেশপ্রেমিক জনগন"-কে "বিচ্ছিন্নতাবাদী দুঃস্কতিকারী"-দের অপপ্রচারে "বিভ্রান্ত না হবার" আহবান জানানো হতো...... এসবই তার কাজ ছিল।

কিন্তু সেদিন তার কাজে কিছুটা বৈচিত্র্য এলো। সন্ধ্যার একটু আগে মেজর সাহেব তাকে নিজের রুমে ডেকে পাঠালেন। কি ব্যাপার? না, তেমন কিছু নয়। শুধু সেপাইদের ( এবং তারও কিছুটা ) খায়েশ হয়েছে একটা কচি মালাউন মেয়ের সাথে "সহবত" করার। মেজর সাহেব রাজাকারগুলোর উপর খুবই বিরক্ত।তার ধারণা, ওই গাধাগুলোর কোনো taste নাই। তাই তেমন কোনো "ভালো" মেয়ে আনতে পারে না। তাই, 'শিক্ষিত' সংঘকর্মী-টির উপরেই তিনি এবারের দায়িত্ব-টা দিতে চান। তার খায়েশ, ভালো দেখে, বেছে বেছে যাতে একটা মেয়ে আনে আবুল বাশার।

তো এই "হারেম"-এর ব্যাপারটায় তার আপত্তি ছিল কিছুটা। ক্যাম্পে মেয়ে ধরে আনা যখন আরম্ভ হয়েছিল, তখন তিনি সামান্য প্রতিবাদের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু নেতা, যিনি ছিলেন প্রথম ও প্রধান, ফতোয়া দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের পূর্বাংশের "মালাউন ও মোনাফেকদের মা-বোন-স্ত্রী-কন্যা-রা " হচ্ছে "মাল -ই-গানিমাহ" , আর ইসলামে "জিনা" হারাম হলেও "জিহাদ"-এর সময় প্রতিপক্ষের মা-বোন-স্ত্রী-কন্যা-দের সাথে "সহবত" করা জায়েজ। আবুল বাশারে "নূরানী" অন্তর মেনে নিয়েছিল এই ব্যাখ্যা-টি।

তাই তিনি সেই রাতে ক্যাম্পে তুলে আনেন; যে কলেজে পড়াশোনা করেছেন সেই কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক পরিতোষ চক্রবর্তীর একমাত্র কন্যা; এগারো বছর বয়সী; নীলাকে।

পরিতোষ সেই সময়ের অন্যান্য হিন্দুর চেয়ে একটু আলাদা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।তাঁর সম্প্রদায়ের সবাই যখন জান ও মান নিয়ে পালাচ্ছে ভারতে, তখন তিনিই ছিলেন একমাত্র সাহসী, যিনি মাটি কামড়ে পড়েছিলেন মাতৃভূমিতে। শেষ পর্যন্ত পারলেনও থাকতে, তবে তার জন্য মূল্য দিতে হল। নিজের মেয়ের জীবন ও সম্মানের বিনিময়ে তিনি নতুন রাষ্ট্র-টির নাগরিক হবার অধিকার পেলেন।

নীলাকে ক্যাম্পে নিয়ে যাবার সময় সমস্ত রাস্তাটুকুতে সে চিৎকার করে কাঁদল। তবে তাঁকে বাঁচাতে কেঊ এলো না, না দেবতা না মানুষ।

আর সেটা তো খুব অদ্ভূত একটা সময় ছিল। কুমিল্লার মানুষজন মাঝেমাঝেই রাতবিরেতে রাস্তাঘাট থেকে ভেসে আসে নারীকন্ঠের কান্নার শব্দে চমকে উঠত। মায়েরা বাচ্চার কানে আঙুল দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন, বাবারা জানলা দিয়ে আকাশ দেখতেন অসহায়। তবে সেই "হারিয়ে যাওয়া" মেয়েদের জন্য কোথাও কেউ ছিল না। আর ডিসেম্বরের ১৬ তারিখের পরেই তারা ফিরে আসতে চাইবে-কেউ কেউ, যারা বেঁচে থাকবে; কারণ পাকিস্তানি কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে তাঁদের বিবস্ত্র অবস্থায় রাখা হয়, যাতে দিনের পর দিন চলতে থাকা ধর্ষণ আর অনন্ত অবমাননার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য গলায় ফাঁস দেবার সুযোগটুকুও না পায়-কিন্তু ফেরার জন্য কোনো ঘর থাকবে না, কারণ নীতিপ্রিয় বাঙালি তার পাক পবিত্র সমাজে "নষ্টা মেয়ে"-দের জন্য জায়গা রাখে না কোনো।

কিন্তু আবুল বাশারের জীবনে একটা অলৌকিক ঘটনা কিন্তু ঘটেছিল। ১৯৭১-এর বহু বছর পর, একদিন, এক সন্ধ্যায়-যে সন্ধ্যাটা তার কাছে কেন জানি খুব চেনা লাগছিল, কিন্তু তিনি এর কারণটা বুঝতে পারছিলেন না, আর বুঝতে পারছিলেন না বিধায় তার খুব অস্বস্তি লাগছিল-তিনি তাঁর বারো বছরের নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন, অবিকল নীলা যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে! এরপর সন্ধ্যার রহস্য তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল...



"পশু আর মানুষের সহাবস্থানে পশুর সুবিধা, মানুষের বড়ই বিপদ" (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী)

ডিসেম্বর ১৬ ১৯৭১। আবুল বাশার ও তাঁর মতো অনেকের মন খারাপ করে দিয়ে পাকিস্তান দুই টুকরো হয়ে গেল। বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধী ন রাষ্ট্র পেল পৃথিবীর মানচিত্র। সবাই উল্লাসে উঠল মেতে, নীলা বা তাঁর মত মেয়েদের কথা কেউ মনে রাখলো না।

আবুল বাশারের রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। চার বছরের মাথায় সপরিবারে নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হলেন শেখ মুজিব। কিছু সময় অতিক্রান্ত হলেই দৃশ্যপটে এলেন জিয়াউর রহমান। এই 'মুক্তিযোদ্ধা' ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন। একাত্তরে যারা ছিল বাংলাদেশের অস্তিস্ত্বশীল হবার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক, তাদের তিনি বাংলাদেশের মাটিতে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিলেন।

৯০'এর আগ পর্যন্ত আবুল বাশারের রাজনৈতিক দলটিছিল খুব সন্তুষ্ট। স্কুল কলেজের ইতিহাসে একাত্তরের ''গন্ডগোল" সম্পর্কে একটু আকটু কথাবার্তা থাকলেও স্বযত্নে সেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে তার রাজনৈতিক দলটির ভূমিকার কথা।

কিন্তু হঠাৎ করেই গলা শোনা গেল এক মহিলার। কী নাম? জাহানারা। জাহানারা ইমাম। এই মহিলা একাই অভিমন্যুর মত ১৯৭১এ যারা হিংস্র প্রতিপক্ষ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করলেন। "৭১'এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি" সারা দেশে নতুন প্রজন্মের কাছে একটু একটু ধরে উন্মোচন করলো সেইসব শ্বাপদদের আসল চেহারা।

তাই সু্দূর আমেরিকায় যেদিন মহিলা মারা গেলেন থ্রোট ক্যান্সারে; সংবাদটা শোনার সাথে সাথে "আলহামদুলিল্লাহ" বলেছিলেন আবুল বাশার। অবশ্য তখন তার নেতারাও আলহামদুলিল্লাহ বলেছিলেন। চট্টগ্রামে এক জনসভায় অতিজনপ্রিয় এক নেতা বলেছিলেন, "এক হারামজাদি, জিহবা লম্বা করছিল, শালী গলায় ক্যান্সার হয়া মারা গেছে.....কিসের বিচার? কোনোদিন হবে না বিচার।"

কিন্তু দুই হাজার দশ সালে হঠাৎ একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের জন্য বিচারের ব্যবস্থা করা হল। তিন বছর পর প্রধান অপরাধীদের ফাঁসির আদেশ দিল ট্রাইবুন্যাল। অবশেষে আবুল বাশার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না, যখন দেখলেন তার নেতাদের ফাঁসি হয়ে গেল দুই হাজার চৌদ্দ সালের ষোলই ডিসেম্বর!

প্রবল শব্দে ভেঙ্গে পড়ল বিশ্বাসের বাড়িঘর যা এতকাল ধরে তিলতিল করে গড়ে তুলছিলেন তিনি নিজের মাঝারে। ভুল ভুল ভুল !!! এতকাল ধরে যা যা বিশ্বাস করেছেন সব ভুল? ১৯৭১ গন্ডগোলের বছর ছিল না? সেটা স্বাধীনতা সংগ্রামের কাল ছিল? আল্লাহ তবে কি তার নাতনির চেহারার নীলার সাথে সাদৃশ্যের ঘটনাটি দিয়ে তাকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন? তবে কি.....

আবুল বাশারের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন তার সময় ফুরিয়ে আসছে!

শয্যাশায়ী আবুল বাশার হঠাৎ দেখতে পেলেন তার সামনে সব কিছু কেমন আঁধার হয়ে আসছে। ক্ষীণ হয়ে আসছে সূরা কিরাতের শব্দ। তিনি আর শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না, আলো আর স্পর্শ করছে না ইন্দ্রিয় তার।

তিনি চোখ বুঝলেন। তার হঠাৎ মনে হল সব স্মৃতি তার মাথা থেকে একটা একটা করে মুছে যাচ্ছে। আল্লাহ তাহলে তার আজন্ম ইচ্ছেটা পূরণ করেছেন!

আত্মীয়রা দেখতে পেল আবুল বাশারের ঠোঁট নড়ছে। তারা অবশ্য তার কোনো কথা শুনতে পাচ্ছিল না। তিনি একটা বাক্য বলছিলেনঃ

"আমাকে ক্ষমা কোরো, আমাকে ক্ষমা কোরো....."

তিনি কার কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন? নীলা বা তাঁর মত মেয়েদের কাছে? বাংলাদেশের কাছে? আমরা জানি না...



"And the rest is silence" (William Shakespear)

একটু পরে নারীকন্ঠের আর্তনাদে মুখরিত হল বাড়িটা। রাস্তার পাশে অবস্থিত হওয়ায় পথচারীরা বুঝল, এইমাত্র একজন কেউ মারা গেল। তাঁরা পথে যেতে যেতে মনে মনে বলল,

"ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন।"

(কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ গল্পের শিরোনাম ধার করা। জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা "মৃত্যুর আগে" , ধূসর পান্ডুলিপি কাব্যগ্রন্থের)
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪

বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×