সূদুর প্রাচীন কালে প্রচলিত ছিল I (আই) অর্থাৎ ইনফরমেশন বা তথ্য। মানুষ যখন শিকারে যেত তখন শিকার কীভাবে করতে হবে, কী শিকার করতে হবে এ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে শিকারে যেত। শিকার যুগের পর আসে কৃষি যুগ। এ যুগে তারা তথ্য সংগ্রহ করতো কৃষি বিষয়ক। কীভাবে ফসলের বীজ বপন করতে হয়, কোন সময়টায় ফসল বুনতে হয়। তখন মানুষ কীভাবে ফসল কাটতে হয় ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতো।
পরবর্তী সময়কালে প্রাপ্ত তথ্যকে সংগ্রহ করে রাখার জন্য টেকনোলজি বা প্রযুক্তির সহায়তা নিতে লাগলো। বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্যকে ধরে রাখার জন্য প্রযুক্তির সহায়তায় নানান ধরনের আবিষ্কার হলো। তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করা, সংস্কার করা, সংরক্ষণ করার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়তে লাগলো। এই সময়কালকে আইটি বা তথ্য প্রযুক্তির যুগ বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশেও এক সময় এই আইটি শিক্ষার সোনালী যুগ বিরাজ করে। এর প্রভাবে দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক আইটি শিক্ষালয়। বিশেষ করে আমাদের দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ সৃষ্টি হয় এই আইটি শিক্ষাকে কেন্দ্র করেই। কম্পিউটার শিক্ষার নাম দিয়ে গড়ে উঠে একাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। ফলস্বরূপ কয়েক বছরের মধ্যেই দেশ ভরে যায় কম্পিউটার বিশেষজ্ঞে।
তারা বিশেষজ্ঞ ছিলেন কম্পিউটারে নানান ধরনের সফটওয়্যার নির্মাণে, কিন্তু আমাদের দেশ তখন প্রস্তুত ছিল না তাদের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরিতে। এ কারণে ঐ সব কম্পিউটার বিশেষজ্ঞকে কাজ করতে হয় সাধারণ কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে। যেখানে তাদের কাজ হতো কম্পিউটারে টাইপ করা, কম্পোজ করা, হিসেবনিকেশ রাখা, ছবি সম্পাদনার কাজ করা, বড়জোড় ডেটাবেস ম্যানেজমেন্টের কাজ করা। বস্তুত এই সব কাজের জন্য কম্পিউটারের উপর উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন ছিল কিনা তা আজও প্রশ্নবিদ্ধ।
পরবর্তীতে অর্থাৎ বর্তমান সময়ে আইটির সাথে যুক্ত হয়েছে কমিউনিকেশন অর্থাৎ যোগাযোগ। আইটির সাথে কমিউনিকেশন যুক্ত হয়ে এমন এক প্রত্যয় গড়ে তুললো যা সকলের সামনে খুলে দিল এক নতুন দিগন্তের। তথ্যের সহজপ্রাপ্যতা, অবাধ প্রবেশাধিকার ইত্যাদি প্রত্যয় নিয়ে গড়ে উঠলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। সাধারণত প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদান বা যোগাযোগ করাকেই বলা হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। আর এ কাজের জন্য নিত্যনতুন উদ্ভাবন করা হচ্ছে নানান ধরনের প্রযুক্তি পণ্য। এসব তথ্যকে নিয়ে যাচ্ছে মানুষের হাতের নাগালে, ফলে যোগাযোগ হয়ে যাচ্ছে সহজ থেকে সহজতর।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে আমাদের শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত করা হচ্ছে তখন আমাদের সামনে এসে দাড়াচ্ছে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-
(১) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষা এবং
(২) শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি।
অনেকেই এই বিষয় দুটোকে একসাথে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু বিষয় দুটো সম্পূর্ণ পৃথক। প্রথমটি একটি বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেমন পদার্থ বিজ্ঞান, সাধারণ গণিত ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি পাঠদানের সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করা। আমাদের বর্তমান শিক্ষানীতিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়ে আসা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার ষষ্ঠ শ্রেণীতে বিষয় হিসেবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষা নামে একটি নতুন বিষয় যুক্ত করেছে। এখন দেখা যাক, তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তি বা আইসিটি শিক্ষা এবং শিক্ষায় আইসিটি এর মধ্যে পার্থক্যটা কী?
সহজ কথায় বলতে গেলে, যখন আইসিটি নিয়ে আলোচনা করা হবে অর্থাৎ তথ্য কী, যোগাযোগ কীভাবে করতে হয়, কোন কোন যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে যোগাযোগ করা হয়, প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার তবে তা হবে আইসিটি শিক্ষা। আবার শিক্ষায় আইসিটি বলতে বোঝায় আইসিটি শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে কোনো কিছু শেখানো, যেমন- কোনো কার্টুন ছবি দেখিয়ে কোন কিছু সম্পর্কে মেসেজ দেয়া। বর্তমানে আমরা শিক্ষায় আইসিটির আরো কিছু ব্যবহার দেখতে পাই, যেমন- শিক্ষামূলক বিভিন্ন ওয়েবসাইট, স্মার্ট ক্লাশরুম, ই-লাইব্রেরী, মোবাইলের মাধ্যেমে ইংরেজি শেখানো, ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে ক্লাশ নেয়া, স্টুডেন্ট ডেটাবেস ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি।
এই দুটো দিকের পার্থক্য থেকে বোঝা যায় আইসিটি শিক্ষা প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের জন্য আর শিক্ষায় আইসিটি ব্যবহার করবে শিক্ষক, শিক্ষাসম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গ। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে আইসিটি শিক্ষার কারিকুলাম কী হবে, কোন শ্রেণীতে কীভাবে কী শেখানো হবে ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, একটি শ্রেণীর কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয় সেই শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের শেখার সামর্থ্য, বয়স, মেধা ইত্যাদি দিক বিবেচনা করে। সাধারণত আমাদের দেশে শিক্ষার কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয় স্পাইরাল পদ্ধতিতে অর্থাৎ কোন বিষয় শেখাতে তা পর্যায়ক্রমে সকল শ্রেণীতেই ধাপে ধাপে শেখানো হয়। যেমন- পানি সম্পর্কে শেখাতে তৃতীয় শ্রেণীতে পানি কী তা শেখানো হয়। চতুর্থ শ্রেণীতে পানির উৎস বা পানি কোথায় কোথায় পাওয়া যায় তা শেখানো হয়। পঞ্চম শ্রেণীতে পানির উপাদান কী কী তা শেখানো হয়। এভাবে ধাপে ধাপে গভীর থেকে গভীরের দিকে যাওয়া হয়। এতে করে শিক্ষার্থীদের বয়সের কথা ও তাদের ধারণ ক্ষমতার কথা মাথায় রাখা যায়।
আইসিটি শিক্ষার ক্ষেত্রেও আমরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারি। এক্ষেত্রে ষষ্ঠ শ্রেণীতে আইসিটি কী, এর ধারণা,কম্পিউটার পরিচিতি ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা আমরা দিতে পারি। ধাপে ধাপে আমরা আইসিটি শিক্ষাকে আইটির দিকে নিয়ে যেতে পারি। যেমনটা অন্যান্য বিষয়ে হয়ে থাকে। যেমন- তৃতীয় শ্রেণীর সাধারণ বিজ্ঞানের একটি অধ্যায় পানি পরবর্তী শ্রেণীতে পড়ানো পানির উপাদান এক সময়ে একাদশ দ্বাদশ শ্রেণীতে রসায়নের অংশ হিসেবে পড়ানো হয়। তেমনি আমরা মাধ্যমিকে তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তির মৌলিক শিক্ষা দিতে পারি। যা পরবর্তীতে একাদশ দ্বাদশ শ্রেণীতে কম্পিউটার শিক্ষায় রূপ নিতে পারে। এতে করে বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার দিকে পথ চলতে সহায়ক হতে পারে। এতে করে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীরা তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ে মৌলিক শিক্ষাটুকু পাবে। এছাড়া কম্পিউটারে হাতেখড়ি পাবে ও কম্পিউটার বিষয়ক সাক্ষরজ্ঞান হতে পারবে। মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর কম্পিউটার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হওয়ার তেমন কোন প্রয়োজন নেই, বরং কম্পিউটার বিষয়ক সাধারণ দক্ষতা থাকলেই যথেষ্ট। এদিক বিবেচনা করে বলা যেতে পারে যদি নবম-দশম শ্রেণীতে বর্তমানে যে কম্পিউটার শিক্ষা বইটি বিদ্যমান আছে তাতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষা অন্তর্ভূক্ত করা যায় তবে শিক্ষার্থীদের আইসিটি বিষয়ক দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। এসব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষা শুধু কম্পিউটার শিক্ষায় সীমাবদ্ধ না রেখে এর সাথে অন্যান্য বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত করা আশু প্রয়োজন।
(একাধিক ব্লগে প্রকাশিত)
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষা এবং শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes
শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন
রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!
রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।
আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!
এই... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঁচতে হয় নিজের কাছে!
চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু। লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা
২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন
সামুতে আপনার হিট কত?
প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন