somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভোরের ট্রেন

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ ভোর ৬:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ভোর ছটায় ট্রেন আমার। যেতে হবে বহুদুর। অনেক অনেক দূর। যেতে হবে নিজের আরামদায়ক বিছানা, রাত জেগে বই পড়ার জন্যে শখ করে কেনা টেবিল ল্যাম্প, ঘুলঘুলিতে ঘর বাঁধা চড়ুই দম্পতি আর আমার প্রিয় একাকীত্বকে ছেড়ে। কোথায় যাবো এখনও ঠিক করিনি। কিন্তু কোথাও আমাকে যেতে হবেই। সুদূর থেকে সংকেত আসছে, রাতপ্রহরী হুইসেল বাজাচ্ছে কর্কশ, চড়ুই দম্পতিও কেমন যেন তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আমাকে তারা এখন আর পছন্দ করছেনা হয়তো, বেশ বুঝতে পারছি। ওদের মনের ভেতর ঢুকতে অজস্র গলি ঘুঁপচি আর অন্ধকার সুড়ঙ্গ পেরুতে হয় না, যেমনটা হয় মানুষের ক্ষেত্রে। ওদেরকে আমার খুব বলতে ইচ্ছা করছে, আমার এ্যালার্ম ক্লকটা আজ বন্ধ রাখি, ভোর হলে কিচিরমিচির করে আমাকে ডেকে দিও, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, এ্যালার্ম ক্লকের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙলেও মনে প্রশান্তি আসবেনা তোমাদের টুইটকারে আমার মন ভালো হয়ে যাবে, কফিপট থেকে এক কাপ কফি খেয়ে চলে যাবো সুন্দর শব্দের স্মৃতি নিয়ে। আমাকে ডেকে দিবে প্লিজ? আমি ঘুমোই একটু?

ঘুম আসছে না। এরকম কত প্রস্থানের স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে! শয্যাশূল হয়েছে আমার। শুয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। চড়ুই পাখিরা যদিও নিশাচর না, যদিও তারা নিদ্রামগ্ন ছিলো, কিন্তু আমার নির্ঘুম রাতের ক্লেশ অনুভব করে তারা নেমে এল ঘুলঘুলি থেকে। ওরা দুইজন আমার দু কাঁধে বসল।
-এই বয়সেও তুমি এত হোমসিক! বিরক্তিকর!
তাদের কথায় স্পষ্ট বিরক্তি। আহা হোম! সুইট হোম! কোথায় আমার ঘর? আমি তো ঘরের খোঁজেই ঘুরে ফিরছি। ঘরের খোঁজেই ভোরের ট্রেনের অপেক্ষা করছি। কিন্তু এসব নৈরাশ্যবাদী কথা ছটফটে চড়ুই দম্পতির অভিভাবকসুলভ নৈকট্যকে দূরে সরিয়ে দেবে এই ভয়ে আমি আর কিছু বললাম না। এর চেয়ে ওদের ঘরের প্রশংসা করে খুশি করে দিই, এই নিঃসঙ্গ রাতে, চলে যাবার ঘন্টাকয়েক আগে কেউ এসেছে পাশে থাকতে, কৃতজ্ঞচিত্তে আমি ঋণ শোধ করার কথা ভাবি।
-তোমাদের ঘরটা বেশ সুন্দর বানিয়েছো। তোমাদের মত আমারও যদি একটা ঘর থাকতো!
এইরে! শেষপর্যন্ত প্রকাশ করেই ফেললাম আমার বাসস্থানহীনতার নীরব নৈরাশ্য! ওরা এখন ব্যাপারটা কীভাবে নেয় ভেবে আমি উদ্বিগ্ন বোধ করি।
-ঘর নেই তোমার? আচ্ছা আমরা শিখিয়ে দেব কীভাবে ঘর বাঁধতে হয়।
-কখন শেখাবে? আমার ট্রেনের সময় হয়ে এলো বলে!
-বাকি রাত কি ঘুমোবার পরিকল্পনা করছো? তা নাহলে চল আমাদের সাথে রাস্তায় বেরুই। শিখিয়ে দেবো কীভাবে খরকূটো দিয়ে ছোট্ট সুন্দর ঘর বাঁধতে হয়।

এক রাত না ঘুমোলে কিছুই হয় না। একলা বিছানায় ঘুমের জন্যে প্রাণান্তকর চেষ্টা করে ঘন্টা দুয়েকের স্বপ্নহীন অথবা দুঃস্বপ্নময় ঘুমের চেয়ে চড়ুইদের সাথে রাত্রিযাপন অথবা শহর পরিভ্রমণ শ্রেয়তর।

ব্যাপারটা ঠিক অনভিপ্রেত কাকতাল নাকি আমার অবচেতন মনের কুচক্রী সিদ্ধান্ত আমি জানি না, আমি জানতাম চড়ুই দম্পতিকে নিয়ে রাস্তায় বের হবার আরো হাজারটা বিকল্প পথ ছিলো, আমি শহরের মানচিত্র সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান রাখি, আমি ইচ্ছা করলেই পাখি বিক্রেতাদের পণ্যশালা এড়িয়ে সুদৃশ্য বিলবোর্ড সম্বলিত বানিজ্যিক সৌহার্দপূর্ণ পথ দিয়ে যেতে পারতাম। অবশ্য এত রাতেও যে নগরের পাখি বেচাকেনার হাট খোলা থাকবে তা আমার জ্ঞাত ছিলো না। এসবই অবশ্য অচল ওজর। আমার দুই কাঁধে দুই পাখি আর রাস্তার দুই পাশে পাখি কেনাবেচার হাট। দোকানদাররা আমার বন্ধু চড়ুইদের চড়াদামে কিনে নেবার জন্যে প্রলুদ্ধ করছে আমাকে।
-ভাই, একজোড়া পাখি দুই হাজার টাকায় লমু। দিবেন?
আমার উপলদ্ধি হয় যে অনেক দূরে যাবার জন্যে দুই হাজার টাকা দিয়ে ট্রেনের টিকিট কিনেছি। তার খানিকটা উশুল হলে মন্দ হয়না! হায়! কোথায় আমার বাড়ি খুঁজে পাবার পথ চিনিয়ে দেবে তারা, আর তাদেরকেই আমি বিক্রী করে হারিয়ে যাবার টিকিটের দাম পরিশোধ করার কথা ভাবছি! তবে দুই হাজার=দুই হাজার টাকা সমীকরণটা এরকম যে, তাতে একটা সুবিধাবাদী সাম্যাবস্থা সৃষ্টি হবে মাত্র। আমার কোন মুনাফা থাকবে না।
-এক দাম তিন হাজার টাকা , নিবেন?
এই প্রশ্নটি করার পরের কয়েক মুহূর্ত আমার খুব অস্থিরতায় কাটে। তারা যদি রাজী হয় হয়, তাহলে আমি আরো বেশি দূরে যেতে পারবো। জানি না, নিঃসঙ্গতার সূচকের উল্লম্ফন নাকি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঘর খুঁজে নেবার স্বস্তি, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
-না ভাই, তিন হাজার টাকা বেশি হয়া যায়। আপনে রাস্তা মাপেন।
রাস্তা মাপা বিষয়ক যথেষ্ঠ প্রকৌশল জ্ঞান এবং যন্ত্রাদি না থাকলেও আমার কাছে জবাবটি একটা দ্বিধ্বাগ্রস্থ জটিল সময়ের সমাধান হিসেবেই নির্ণিত হয়।
কিন্তু এত সহজেই কি সমাধান হয়?
এত সহজেই কী পাওয়া যায় ঘর?
অথবা,
এত সহজেই কী হারানোর পথ খুঁজে পাওয়া যায়?
পাখিশিকারীরা ওৎ পেতে রয়েছে। দরাদরিতে হেরে যাবার পর যখন আমি বিজয়ীর আনন্দ নিয়ে পার হয়ে যাচ্ছি সে এলাকা, তখনই একজন আমাকে মনোনীত করে মননশীল ক্রেতা হিসেবে।
-দোকান কেবলি খুললাম। বউনির সময় কচলাকচলি করুম না। চার হাজার টেকা দিমু নি। পাখিগুলা দেন।
পাখিরা প্রবল বেগে ডানা ঝাপটায়। ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই। ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। হয়তোবা এখনও অনেক দূরে। তবে আমি তো জানি, এই মোড়টা পার হলেই রেলস্টেশন। ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করার সময় পাখিরা থাকবে কী না, ঘর বাঁধার কৌশল শিখাবে কী না, তাদেরকে আমি বিকিয়ে দেবো কী না, তারা আমার আদৌ আপনজন কী না, অজস্র প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে থাকে।
-আরে ভাইগ্না, তুমি!
চার হাজার টাকা দর হেঁকে বসা দোকানদার পূর্ব পরিচয়ের সুত্রে হৃদ্যতা দেখায়। আমার অবশ্য মনে পড়ে না তার কথা, আমার মনে পড়ে না আমি কবে শেষ এরকম আন্তরিক সম্ভাষণ শুনেছি। আমার মনে নেই এরকম নিকটাত্মীয় কে কবে ছিলো। আমার মনে নেই কাছের মানুষের মধ্যে কতজন পাখি হন্তারক ছিলো। কিন্তু যুক্তিবিদ্যায় পারঙ্গম আমি স্মৃতিভ্রংশের কবলে পড়া সাবেক আত্মীয়তা এবং বর্তমান সাদর সম্বোধনকে পাখিবিষয়ক লেনদেনের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে প্রশ্ন করি,
-কেমন আছেন!
যদিও আর ঘন্টাখানেক পরেই আমাকে ট্রেন ধরতে হবে, যদিও দর কষাকষি এবং আপ্যায়ন যুগপৎ বহাল রেখে পরস্পরের হাল হকিকত জানতে গেলে ট্রেন ধরা কষ্টকর হয়ে যাবে, তবুও ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করতেই হয়!
-আরে চুপ কেলা? বেচন কেননের চিন্তা বাদ দাও। এতদিন পর আইলা এক কাপ চা তো খাইয়া যাও, মাল বেচো বা না বেচো!
চড়ুই পাখিদের মাল বলে অভিহিত করায় তারা ডানা ঝাপটিয়ে প্রবল প্রতিবাদ জানায়। তারা আমার কাঁধে মৃদু ঠোকর দিয়ে আকুতি করে, কিন্তু আত্মীয়তার মোড়কে ঢাকা নৃশংস দর কষাকষির দমকায় ছিটকে পড়ে যায় দোকানের খালি খাঁচাগুলোর কাছে।

অন্য খাঁচাগুলোতে চড়ুই পাখির মত নিরীহ কোন পাখি ছিলো না। ছিলো ধারালো নখের চিল, ছিলো উদ্ধত গ্রীবার ঈগল। আমার চড়ুইগুলো ভয় পায়। কিন্তু তারা উড়ে যাবার কোন চেষ্টা করে না!

ভালোই হল এক দিক দিয়ে! কষ্টেসৃষ্টে উদ্ধারকৃত সময়ের মধ্যবিন্দুতে বসে আমরা অতীতচাড়ণার সুযোগ পাই।
-আপনি এই ব্যবসা ধরলেন কবে থিকা? আর আমার পাখিগুলা নিতে চাইতেসেন কোন আক্বেলে? আপনার এইখানে তো দেখি সব ঠোক্কর মারা হিংস্র পাখি। এরা কী ট্রেনের ঠিকানা জানে? আর এদেরকে ভোরের ট্রেনে লৈতে পারবেন? এ্যালাউ করব? কোনরকমে ট্রেনে নিতে পারলেও তো সমস্যা। টিকেট চেকাররে ঠোকরাইয়া ফালাফালা কৈরা ফালাইবো।
-ধীরে বৎস! তুমি কি ভাবসো যে আমি এরকম শান্ত নীরিহ পক্ষী নেয়ার টেরাই করিনাই? যারা ঘুলঘুলিতে ঘর বানবো, যারা ঠোক্ক্বর মারবো না। যারা সুমিষ্ট স্বরে গান গাইয়া ভোরের তন্দ্রা ভাঙাইবো? যারা পোকামাকড় খাইয়াই সন্তুষ্ট থাকবো, যাগোরে পোকামাকড় খাইবো না, যাগো একটা ঘর থাকবো; যতই ছোড হোক, আমারে মাঝে মধ্যে নিমন্ত্রণ করতে পারবো, আমি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারুম কী না সেইডা পরের ব্যাপার। কিন্তু কেউ কি ডাকবো আমারে! যেমুন তোমার চড়ুইরা তোমারে ডাকসে?
-আপনি খালি পক্ষীগোরের কথা কইতাসেন কেন? আর কেউ নাই আপনারে নিমন্ত্রণ করার?
-তোমার কী কেউ আছে?
-না নাই।
কথোপকথনের মধ্যে দূর থেকে ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। আমি ব্যস্ততা দেখাই,
-আজাইরা প্যাচাল করার টাইম নাই। আমারে এক্ষণ যাইতে হৈবো। ট্রেন আইসা পড়ছে।
-ভোরের ট্রেন?
-হ
-হাহাহা! এরম কত দেখলাম! ভোরের ট্রেইন কুয়াশার পর্দা ভেদ কইরা কখনও যাইতে পারে না। সেই আধো আলো ছায়ায় পইড়া থাকে। যায়োনা, থাকো।
- নাহ! আমি যামুই!
-মুরুব্বীর কথা শুনলা না তো! ঠিকাছে আমিও যাইতাছি তোমার লগে। টাইম আর কত বাকি?
-আধা ঘন্টা।
-তয় একটা নিয়ম তো জানোই, তোমার লগে পূর্ব সুখী জীবনের স্মারক হিসাবে দুইটা সুখী পাখি লইয়া যাইতে হইবো। তাইলে টিকেট না হইলেও চলবো। চড়ুইগুলারে কান্ধে লও আবার।
আমরা এখন হেঁটে চলেছি রেইলস্টেশনের দিকে। আমার দু কাঁধে দুইটা
চড়ুই। আমার সহযাত্রী হার্দিক অনাত্মীয় বা তুখোড় ব্যবসায়ী আত্মীয়ও সাথে দুটো পাখি নিয়েছে। সেও ভোরের ট্রেনে উঠতে চায়। পাখিগুলোর নাম আমি জানি না, যারা ঘর বাঁধতে পারে কী না আমি জানি না, ঘর বাঁধার প্রশিক্ষণ দেয় কী না জানি না, তবে ঠোকনকার্যে তারা অতীব পারদর্শী। কিছুক্ষণ পরপর আমার সহযাত্রীর প্রাণপনে চেপে রাখা ব্যথাতুর ধ্বণিতে যা সুস্পষ্ট! আর আমার চড়ুই পাখিরাও উশখুশ করছে,
-কোথায় তোমাকে ঘর বাঁধার নিয়মকানুন শিখিয়ে ঘুমোতে যাবো, তা না, আজকে সারারাত জেগে তোমার পথপ্রদর্শক হতে হল!
-আরেকটু অপেক্ষা কর প্লিজ! আমিও তো সারারাত জেগে ছিলাম শুধু তোমাদের জন্যেই। তোমরা আমাকে পথ চিনিয়ে দিবে, দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি উপশম করবে, এই তো আর কিছুক্ষণ! ট্রেন এসে যাবে!

-তোমার কি ক্ষিধা লাগসে?
আমার আত্মীয় অথবা অনাত্মীয় অথবা সহচর অথবা সহযাত্রী আমাকে সুধোয়।
-হ্যাঁ তা কিছুটা লেগেছে। তবে ট্রেন চলে আসলে ফার্স্ট ক্লাশ কেবিনে বসে ইচ্ছেমত মুরগীর রান সাঁটিয়ে নিতে পারবো।
-তুমি কি নিশ্চিত যে ট্রেন ঠিক সময়মতন আইবো?
নাহ আমি নিশ্চিত না। দ্বিধাণ্বিত। তাই আমার জবাব দিতে সময় প্রয়োজন হয়।
-তোমার মনে আছে, যেদিন তোমার মায়েরে ট্রেনে কৈরা দুর পশ্চিমের পথে নিয়া যাবার কথা আছিলো উন্নত চিকিৎসার্থে?
-প্লিজ আর বইলেননা এইসব!
-কেন! কেন কমু না? দু কাঁধে দুই চড়ুই নিয়া নিজেরে খুব আশাবাদী ভাবতাছো? তাদের মেলোডিতে নিজেরে সমর্পণ কইরা উন্নত জীবনের পণ করতাছো?
-স্টপ ইট!
-হোয়াই শুড আই! তোমার বাবার যখন ওপেন হার্ট সার্জারি হইল, তোমার বোন যখন এ্যবোরশোন এর যন্ত্রণা সইতে না পাইরা এক পাতা ই-পাম খাইলো, সেগুলো অস্বীকার করতে পারো? তখন কোথায় ছিলো তোমার সুশ্রাব্য পাখিদ্বয়? এই দেখো না তারা এখন তোমার আস্তিনের তলায় মুখ লুকাইতাছে।

ট্রেন আসার সময় হয়ে এসেছে। ঠিক এসময় আমার চড়ুই দম্পতির আমাকে জাগিয়ে দেবার কথা ছিলো কিচিরমিচির রবে। কিন্তু আমি সংবিত ফিরে পাই এ্যালার্ম ক্লকের কর্কশ আর চড়ুই দম্পতির সান্দ্র ব্যথাতুর চিৎকারের যুগপৎ শব্দে।

এখন আমি কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দিবো?

ট্রেনের ড্রাইভারের কাছে গেলে সে বলল যে ট্রেন আরো আধাঘন্টা দেরীতে ছাড়বে। মুফতে পাওয়া এই সময়টাকে সোল্লাসে বরণ করে নিয়ে আমার সহযাত্রী আত্মীয় প্রস্তাব দেয় ভালো কিছু খেয়ে নিয়ে সারাদিনের জন্য শক্তি সঞ্চয় করে নিতে।
-চলো, কোন একটা ভালো রেস্টুরেন্টে যায়া ব্রেক্ফার্স্ট সাইরা নেই।
-কিন্তু টাকা নাই যে আমার!
-আরে চলো না! ব্যবস্থা একটা কইরা দিমু নে।

একটা মোটামুটি চলনসই রেস্টুরেন্ট পাওয়া গেলো যেটাতে কেবল আলো জ্বালাচ্ছে, উনুন এখনও প্রস্তুত হয়নি, পাচক কেবলামত্র হাই তুলে প্রাতঃরাশ সারছে। আমাদের দেখে সে খুশি তো হলই না, উল্টো বিরক্তমাখা কন্ঠে জানালো যে আপাতত গতরাতের বাসি হয়ে যাওয়া তেহারী ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না। ইচ্ছে হলে আমরা খেতে পারি, কিন্তু দুর্গন্ধজনিত কোন অভিযোগ করতে পারবো না। ব্যাপারটা আমাকে দোনোমনায় ফেলে দিলেও আমার সঙ্গী উৎসাহ যোগায়,
'আরে মাম্মা, থোউ ঐসব তেহারি ফেহারি, তোমগো লিগা জটিল জিনিস লৈয়া আনছি। চটপট রান্না কইরা দিবা।'
আমার ভয় হয়, সে কীসের ইঙ্গিত করছে? আমার কাঁধের দুটো চড়ুই পাখি? তাদের মাংসের ফ্রাই? তাদের ডানা দিয়ে তৈরী সুস্বাদু এ্যাপাটাইজার?
-আরে ভয় পাও ক্যান ভাইগ্না! আমার কান্ধের দুইডারেও দিয়া দিমু। তেহারি, নেহারি, মগজের ভুনা যেইডা চাও পাইবা!
-ডাবল বিল লাগবো।
নিস্পৃহ কন্ঠে জানায় মেসিয়ার। আমাদের রাজি না হয়ে উপায় ছিলো না। ট্রেন আসতে খুব বেশি সময় বাকি নেই। যেতে হবে বহুদূর। খালি পেটে এতটা সময় কাটালে পাকস্থলীর অম্লীয় পদার্থগুলো জেঁকে বসতে পারে। অভুক্ত অবস্থায় আলসারের ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে ভ্রমণ করাটা নিশ্চয়ই সাচ্ছ্যন্দময় হবে না!

চড়ুই পাখির মগজ এত সুস্বাদু, আমার জানা ছিলো না। তাদের টুইটকারের চেয়েও মিষ্টি! আমার মন, মগজ এবং পাকস্থলীতে নাস্তার অধিগ্রহণ চলতে থাকে স্বৈরাচারী প্রক্রিয়ায়।

আমি ভুলে যাই কিচিরমিচির।
আমি ভুলে যাই টুইটকার।
আমি ভুলে যাই রাত্রি অভিযানের উদ্দেশ্য।
শুধু মনে থাকে কিছু সুস্বাদু আমিষভোজ। ট্রেন এখনও আসতে কত দেরী আমি জানি না। তাতে কিছু এসেই যায় না। আমার পাকস্থলীর সন্তুষ্টির কাছে পরাজয়বরণ করে রেস্টুরেন্টে ইতস্তত পড়ে থাকা চড়ুই পাখির পালক এবং ডানা।

রক্তাক্ত!

-ট্রেন আয়া পড়ছে যাইবা না?
-কোথায়?
-যেইখানে যাওয়ার কথা সেইখানে। আমারে জিগাও ক্যান? তোমার মালসামালা কই?

অনিদ্রাজনিত ক্লান্তিতে আমি এসব ধারাবাহিক প্রশ্নোত্তরের মুখোমুখি হয়ে অপ্রতিভ বোধ করায় ব্যাগ গুছাতে সচেষ্ট হই। কিন্তু কী নেব! চড়ুই পাখির রক্তাক্ত ডানা, বিস্রস্ত পালক আর গলিত চক্ষু ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাই না।

তারপরেও আমাকে যেতে হবে। খুঁজে নিতে হবে দ্রষ্টব্য প্লাটফর্ম। আমার পুরোনো এ্যালবাম এবং ডায়েরি কোথায় কোন ফাঁকে ছিনতাইকারী অথবা তথাকথিত শুভাকাঙ্খী আত্মীয় ছিনিয়ে নিয়েছে কে জানে! তবে চড়ুই দম্পতির মৃত পালকগুলো থাকলেও চলবে। রক্তের দাগ মুছে নিলেই হল।

একটা সস্তা রুমাল কেনার টাকা আমার কাছে আছে।

আর খুব অল্প সময় বাকি। আমি ব্যাগের ভেতর যথাসম্ভব চড়ুই দম্পতির ডানা এবং পালক সংগ্রহ করতে থাকি। তারপর দৌড় দেই শেষ ট্রেনটি ধরার জন্যে।

আমার অনেক তাড়া। কিন্তু আমার কোনো তারা নেই! কোন ইচ্ছাপূরণকারী তারা আমার আশেপাশে খসে পড়ে না। চড়ুইয়ের গলিত চোখগুলো ব্যাগে নেই নি। এখন এই অলিম্পিকের স্প্রিন্টসুলভ দৌড়ে ব্যাগে সঞ্চিত ডানা এবং পালকগুলো উড়ে না গেলেই হয়!

ট্রেন এসে গেছে। আমি প্রাণপনে দোড়ুচ্ছি। জয় পরাজয়ের হিসেব করে লাভ নেই আমি জানি। ব্যাগটা হস্তগত থাকলেই হয়! তাহলে এই অবসন্ন সকালে সবাইকে অন্তত গুডমর্নিং বলতে পারি!

গুড মর্নিং মাই ফ্রেন্ডস!

ট্রেনে আসন গ্রহণ করার পরে আড়মোড়া ভাঙা আকাশের বুকে আমি অদ্ভুত একটা নতুন তারা দেখতে পাই। চড়ুইয়ের গলিত চোখ ওখানে পৌঁছে পৃথিবী এবং সৌরজগতের যাবতীয় নিয়ম অগ্রাহ্য করে ঔজ্জল্যবিহীন নিস্প্রভ রঙহীন তারা হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তবে খানিক বাদেই আমার ব্যাগের রক্তাক্ত পালকগুলো থেকে প্রবল বাতাসের ফলে সুন্দর সমান্তরাল গতিতে ঐ তারাটির দিকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে তাকে রঙময় করার জন্যে।

যাক,রক্ত মোছার জন্যে এখন আমাকে আর কোন রুমাল কিনতে হবে না। টিকেটচেকার আমার কাছে টিকেট চাইতে এলে আমি বখশিশ হিসেবে তাকে নিকষিত পালকগুলো দিয়ে দিই। এখন আর দরকার নেই ওগুলো আমার। আমাকে পর্যবেক্ষণকারী রক্তাভ মায়াতারাটা সাথে থাকলেই হল। হোক না অনেক দূরে, সেই কোন অন্তরীক্ষে! টিকেটচেকার খুশি হয়ে আমাকে বলে,
"গুড মর্নিং স্যার! হ্যাভ আ নাইস জার্নি!"
আর আমার হঠাৎ করে একটা গানের কলি মনে পড়ে সেই সময়ে,
"ঘর, ফেরা হয়নি আমার ঘর
চেনা হয়নি আমার ঘর
জানা হয়নি মনের মানুষটাকে..."





সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১১ ভোর ৬:২৮
৮৭টি মন্তব্য ৮৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রফেসদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×