somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন ডিজেল আলমের সুমুদ্র জয়ের পর নাগরিকত্ব জয়ের কাহিনী

২২ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ১০:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অষ্ট্রেলিয়ার চারিদিকে সুমুদ্র থাকায় অনেকে জীবন বাজী রেখে নৌকায় পাড়ি জমায়, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে। সে এক দুঃস্বপ্নের যাত্রা। আমাদের আলম সাহেব এসেছেন এভাবে। আজ ওনার গল্প (বাস্তব) শোনাব আপনাদের।

ছেলেটার নাম আলম, বয়স ৩০ হবে হয়ত। পেশায় ডিজেল মেকানিক।পড়াশোনায় হয়ত স্কুলের গন্ডি পার হননি। চেনার সুবিধার জন্য আমরা বন্ধুমহলে ওনার নাম দিয়েছি ডিজেল আলম। মালয়েশিতে ছিলেন অনেকদিন। ট্রাক, বাসের ইন্জিন ঠিক করতে পারেন।মালয়েশিয়ায় অবৈধ ভাবে ছিলেন, চুরি করে কাজ করতেন, মালিকের মুখ ঝামটা আর অপমান সয়ে জীবন কাটত। একদিন এক দালালের পরিচয় হয়। আশ্বাস দেন দুই হাজার ডলার দিলে ইন্দোনেশিয়ায় নিয়ে আরামে অষ্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়ে দেবেন। ডিজেল আলম রাজী হয়ে যান। ওনাকে ট্রাকের করে লুকিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় নিয়ে যায় দালাল, এক বাসায় লুকিয়ে রাখে চোদ্দ দিন।তারপর সেই কাঙ্খিত ডিন, ডিন না রাত বলাই ভালো হে, ডিজেল ভেবেছিলেন হয়ত টাইটানিকের মত জাহাজে বিলাসবহুল পরিবেশে ওনাকে নিয়ে যাবে।দেখলেন ছোট একটা ডিঙি নৌকায় ইন্জিন বসানো, নদীতে হয়ত ৪/৫ জন ওটায় চড়া যায়। কিন্তু দেখলেন ওনার মত বারোজন (বিভিন্ন দেশের) ওই নৌকায় চড়ে মহাসুমুদ্রে কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিতে হবে, অনেকটা কলম্বাসের মত অবস্হা।

দিলেন আল্লার নামে রওনা, সে এক ভয়াবহ অবস্হা। খাবার নেই, পানি নেই, তিনদিন তিন রাত, যাত্রীদের হাউমাউ করে কান্না, ফিরে যাওয়ার পথ নেই, ফিরলে ইন্দোনেশিয়ার পুলিশের হাতে ধরা, ছয় / সাত বছরের জেল, আর এখন জীবন নিয়ে টানাটানি, ভয়ে একজন মারা গেলেন, লাশ সুমুদ্রে ফেলে দেওয়া হলো, মাঝসুমুদ্রে ইন্জিন নষ্ট হয়ে গেলো, ডিজেল আলম সুমুদ্রে ভাসমান অবস্হায় ঠিক করলেন ইন্জিন, সহযাত্রীদের চোখে ডিজেল আলম সাক্ষাত ফেরেশতা ! এসে পৌছুলেন অষ্ট্রেলিয়ার কোনো এক দ্বীপে। কোস্টগার্ড এসে ধরে নিয়ে গেলো, দিয়ে দিলো ডিটেনশান সেন্টারে। জীবন শুরু সেখানেই!

ডিটেনশান সেন্টার সরকারের পরিচালনায় চলে, থাকা খাওয়া ফ্রি, সাথে নগত কিছু টাকাও দেবে, ট্রান্সপোর্ট কনসেশান আচে, যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুরতে পারা যায়, এদেরকে গভমেন্ট হিউম্যানেটেরিয়ান ভিসা দেয়, সবাইকে দেয় না, অনেক কে ডিপোর্ট করে দেয়, গভমেন্ট মনে করে জীবন হাতে নিয়ে এরা এসেছে নিশ্চয় কোনো কারন আছে।আমার এক বন্ধুর সাথে ডিজেল আলমের পরিচয় হয়। কিভাবে হয়েছে জানিনা, তবে বাংলাদেশে একই জেলায় বাড়ী হওয়ায় সে আমার কাছে নিয়ে আসে, তখন ডিজেল আলমের মুখ থেকে এই সব ঘটনা শুনি।

ডিজেল আলমের মুখে তখন একটাই চাওয়া, ভাই একটা কাজ দরকার, বাস, ট্রাক জে কোনো ইন্জিন থিক করতে পারব। ইসুজু, হিনো, লেল্যান্ড সব ইন্জিন আমি জানি। যতবলি এই দেশে ওসব ইন্জিন নেই, উনি শোনেন না। বন্ধুদল সহ ডিজেল আলমকে নিয়ে বের হলাম বিভিন্ন গ্যারেজে কাজ খুজতে। স্বাভাবিকভাবে ইংরেজী উনি কিছু জানেন না, বারবার বলেছি আপনি চুপ করে থাকবেন, যা বলার আমরা বলব।যে কোনো কার মেকানিকের কাছে জব ভ্যাকেন্সির কথা বলতেই পাশ থেকে ডিজেল আলম চিৎকার করে ওঠেন " আই ডিজেল ম্যাকানিক, ইসুজু, হিনো, লেল্যান্ড ইন্জিন", স্বাভাবিকভাবে মালিকরা বলে 'স্যরি।

সেদিন চলে আসি, আলমকে বলি কাজ খুজতে, দুই মাসপর ওনার সাথে দেখা, বললেন একটা কাজ পেয়েছেন, সপ্তাহে সাতশ ডলার মত পাই, পোষায় না, আমি দির্ঘশ্বাস ছাড়ি, মনে মনে ভাবি কত স্কিল্ড লোক মাইগ্রেশান করে এসে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আপনি তো সরকারি সাহায্য বিশাল সুখে আছেন। একমাস পর আবার দেখা, কারেন্ট এমপ্লয়ারকে যে ভাষায় গালাগালি করলেন, শুনলে মরা মানুষ কবর থেকে উঠে দাড়াবে, অভোযোগ, সপ্তাহে নয়শ ডলার পান, এত অল্প দিলে চলে, উনি ডিজেল মেকানিক, বিশাল স্কিল। আমি বললাম এটা তো খুবই ভালো ইনকাম, উনি বললেন 'আরে ভাই এই দেশে মাছি তাড়ানোর মত বাতাস হাত দিয়ে সরালেই ঘন্টায় পনেরো ডলার পাওয়া যায়, আপনি তো দেখি কিছু জানেন না", মনে মনে ভাবলাম ' হয়ত তাই

এক সপ্তাহ পর আবার দেখা, হাতে ফর্ম, দেখলাম সিটিজেনশিপের ফর্ম, কে জেনো নাম ভুল লিখে দিয়েছে ওনার, উনি "ফুলুইট" খুজছেন ওভাররাইট করার জন্য। আমি অবাক, নিজে স্কিল্ড মাইগ্রেশানে এসে চার বছর পর পাসপোর্ট পাবো, আর উনি অবৈধ নৌকায় এসে কিভাবে।উনি ফোন করে ঝাড়ি দিয়েছেন হোম অফিসকে " তোরা আমার কাগজ পত্র দিবিনা" (উনি সব কিছুর শব্দার্থ তুই করে করেন, যেমন হটস ইয়োর নেম মানে তোর নাম কি :))। ওরা বলেছে "তোর কাগজ হয়ে গেছে, কনগ্রাটচুলেশান" সব জায়গা থেকে যেমন মেডিক্যাল, ট্যাক্স সব অফিস থেকে উল্টো ফোন করে ওনাকে বলেছে ওনার কাগজ হয়ে গেছে। এর নাম হিউম্যানেটেরিয়ান ভিসা !

বাংলাদেশ থেকে কত কষ্ট আর পেপারওয়ার্ক করে স্কিল্ড মানুষ আসে, এসে চাকরি নাই টাকা নাই, মানসিক কষ্টের দিন যায়। ডিজেল আলমদের কোনো টেনশন নাই সংসার চালানোর, জীবন বাজী রেখে জুয়া খেলে কোনো রকমে এসে সব পেয়েছেন আর এখন গালাগালি করছেন মানুষকে। একটা স্টুডেন্ট পড়াশোনা শেষ করে কি পরিমান মানসিক যন্ত্রনায় থাকেন একটা ভিসার জন্য। সেসব কষ্ট আলম কখনই বুঝবেনা। তার জীবন সে গড়েছে, সব কৃতিত্ব আলমের, এখানে বলার কিছু নাই।হাসি লাগে সেখানেই যখন ভাবি বাংলাদেশে হয়ত পাশাপাশি চেনাজানা দুইটা ফ্যামিলি আছে, একটা ডিজেল আলমের আরেকটা অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী কারো, ডিজেল আলমের ফ্যামিলি হয়ত বলবে আরে অমুক তো অষ্ট্রেলিয়া যেয়ে এখনও কিছু করতে পারেনি আর আমাদের আলমকে তো বাসা থেকে ডেকে পাসপোর্ট দেয়। হা হা।

তবে দয়া করে কেউ ভুলেও নৌকায় এখানে আসার চেস্টা করবেন না। জীবন আপনার, বাজী আপনি ধরতে পারেন তবে নিশ্চিত মৃত্যু যখন সামনে আসে জীবন তখন অনেক মুল্যবান মনে হয়।

ধন্যবাদ।

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ১০:৫৩
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×